Robbar

দোষে নয়, আলুর গুণে থাকুন

Published by: Robbar Digital
  • Posted:May 30, 2024 5:23 pm
  • Updated:May 30, 2024 6:01 pm  

আলু। আমরা সবাই খাই। যুগ-যুগ ধরে। অথচ জালিম এই সমাজ আজও তার কদর বুঝল না। রান্না থেকে পাতে, বরাবর সে অবহেলার পাত্র। গুণের কদর ছেড়েই দিন, তার দোষ নিয়ে জগৎ-সংসারের যত মাথাব্যথা। মাটির নিচে বাস। তাই বলে কি স্বীকৃতি নেই বেচারা আলুর? অবশেষে ভাগ্যের চাকা বদলাল। আজ সেই শুভদিন। সারা বিশ্বজুড়ে প্রথমবার পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব আলু দিবস’। শুভক্ষণে আলুর গুণকীর্তনে এগিয়ে এল রোববার.ইন-ও। গুণ গাইলেন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

দোষ-গুণের কথা জানি না। তবে আলুতে আমার আসক্তি আছে। বুক ঠুকে (দয়া করে কিং কং ভাববেন না) সেকথা বলতে আমি ভয় পাই না। তবে ভয়ের কথায় আমার মনে পড়ে যায় গিন্নির মুখ। সংসার নামক এই মায়া-বন্ধনে (ভ্রমবশত কাঁটাতারের মনে হয়) তাঁর চোখকে ফাঁকি দেওয়া দেবতার অসাধ্য, আমি তো রক্তমাংসের পুত্তলিকা! তাই হয় কী, অফিসের পথে পা বাড়ানো আগে খাওয়ার টেবিলে বসে প্রায়শই উদ্ধার করি, একথালা ধবলকান্তি ভাতের পাশে একবাটি (গামলাসদৃশ) মাছের ঝোল আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে। সে-তো আর ঝোল নয়, সাক্ষাৎ উষ্ণপ্রস্রবণ! তার মধ্যে হাড়ভাজা মাছটা ইতিউতি ভাসে, বেহুলার ভেলার মতো তাকে ঠেকনা দিয়ে রাখে দু’-টুকরো আলু। হ্যাঁ, স্রেফ দু’টুকরো। কথায় বলে, আশায় মরে চাষা। আমি সেই আশার ছলনে ডুবুরির মতো ঝোলে কবজি অবধি ডুবিয়ে দিই। পাছে হাফ কিংবা আরও এক টুকরো আলু যদি টাইটানিকের মতো তলিয়ে গিয়ে থাকে! কিন্তু প্রতিবারেই বিফলমনোরথ হতে হয়। আর হয়ে, যখন সামনে তাকাই দেখি স্ত্রী-রত্নটি আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছেন! সে চাহনিতে সমুদ্র শুকিয়ে যায়, আমার অন্তরাত্মাও। শাক, মাছ কিছুই ঢাকতে না পেরে কানএঁটো হেসে বলি– এত ঝোল না দিলেও পারতে! সঙ্গে সঙ্গে ‘মুখ ঝামটা’ নামক দৈববাণী শুনতে পাই, “ওই দু’টুকরো! ব্যস, ওর বেশি একটাও পাবে না, বলে রাখলাম!” বলার মতো অবস্থায় তখন আমিও থাকি না। জানি, সংসার বহ্নিময়! অগত্যা ঝটপট বিরস-বদনে হাত চলে। বুঝে যাই, ‘মোগাম্বো’সুলভ এমন একজোড়া আঁখি থাকতে আমার আলুপ্রীতিকে রক্ষা করা একপ্রকার অলীক কল্পনা। অবোধ মন তবু বুঝতে চায় না, কেবলই ‘আলু… আলু…’ করে।

Are Sprouted Potatoes Safe to Eat? | Bon Appétit

সুহৃদ পাঠক, সংসারের কথা বলে আর আপনাদের মন ভারাক্রান্ত করতে চাই না। আজ-কাল যোগ্য সহমর্মী মেলে কম। পরিতাপের তুলনায় পরিহাসের লোকই জোটে বেশি। কিন্তু খোদার কসম-জান, আলু আমার ১০০ পারসেন্ট লাভ! এ ভালোবাসা সাংসারিকরা অনুধাবন করতে পারুক ছাই না পারুক, বুঝবে নিশ্চয়ই অসাংসারিকরা। মানে, ব্যাচেলররা। প্রেম বিষয়টাকে তাঁরা সযত্নে রাখেন, রাখতে গিয়ে বেপরোয়াও হন। তাতে ‘সহায়িকা বই’-এর সাফল্যের গ্যারান্টি থাকে না। ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যা জোটে, তা হল দাগা। আলুও তেমন। বিসদৃশ বডিতে দাগ ইতিউতি লেগেই থাকে। দাগা দিতেও সে ওস্তাদ। কী’রম? ধরুন, মুরুব্বিপানা করে বাজারে গেলেন, চোখকান বুজে কিলোখানেক আলু কিনে আনলেন। বাড়ি ফিরে ঝোলা থেকে কয়েকটা উমদা আলু বেছে যেই না বটিতে কেটেছেন, দেখলেন– ভিতরে সাক্ষাৎ ব্ল্যাকহোল! মানে, অ্যাক্কেরে পচা! লজ্জায় তখন দু’কান কাটা যাওয়ার জোগাড়! ব্ল্যাকহোলের জায়গায় ম্যানহোল থাকলে আমি নিশ্চিত, মা-মাসি, পিসি-জ্যেঠিমাদের কাছে খবর রাষ্ট্র হওয়ার আগেই আপনি বলে উঠতেন– ধরণী দ্বিধা হও, আমি পাতালে প্রবেশ করি!

মুখের স্বাদ ফেরাবে তেতো আলু, নিমপাতা ভাজা দিয়ে মাখলে ভাত হবে সাবাড়

পাতাল প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল, আলুর জন্মের কথা। ছোটবেলায় পড়ার বইতে ছিল– ‘ভাগীরথীর উৎস সন্ধানে’ বলে একটা লেখা, যেখানে লেখক বারবার নদীকে জিজ্ঞাসা করছেন– ‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?’ আলুকে এ-প্রশ্ন করে নিজেকে বোকা প্রতিপন্ন করতে চাই না। আলু মাটিতে ফলে সেটা সায়েন্সের বইতে পড়েছি। সেই জন্মস্থান চোখে দেখেছি যদিও অনেক পরে। একবার জয়রামবাটী যাওয়ার পথে টোটো থামিয়ে চায়ে চুমুক দিচ্ছিলাম। সেই গুমটির পিছনে দেখি দিগন্তবিস্তৃত নেড়া নেড়া মাটি-কোপানো মাঠ। যেন কয়েকশো ইঁদুরে মাটি খুঁড়েছে, তাদের হাউজিং কমপ্লেক্স গড়বে বলে। সুলুকসন্ধানে জানতে পারলাম, ওটা আলুচাষের জমি। যদিও সদ্যোজাত মনুষ্যসন্তান আর ধেড়ে খোকার মধ্যে যতটা তফাত, ততটাই পার্থক্য জমিনে জন্ম নেওয়া আলু আর বাজারে বিক্রি হওয়ার আলুর মধ্যে। আলু জন্মেই সচরাচর বাজারে আসে না। তার আগে ‘এয়ারকন্ডিশনিং’ বাড়িতে থাকে। পাবলিকে তারে কয়, হিমঘর।

…………………………………………………………………………………………………………………………………………….

সকালে বাজার করতে বেরিয়ে আপনার পা-জোড়া পাথর হয়ে গেল কোনও এক কচুরির দোকানের সামনে এসে। আসলে আপনার জিভ তখন শুধু গরম তেলে চান করে ওঠা ফুলকো, লালচে কচুরিকেই চাইছে না, যোগ্য-দোসর হিসেবে কামনা করছে দোকানের বড় ডেকচিতে আলুলায়িত আলুর তরকারিটিকেও। সেসব জাগতিক মায়াকে অগ্রাহ্য করে আপনি যদিও বা বাজারের থলি ভারী করে বাড়ি ফিরে আসলেন, কি করে অগ্রাহ্য করবেন প্রসন্নচিত্তে আপনার দিকে এগিয়ে আসা একথালা পূর্ণশশীসম লুচি, তৎসহ একবাটি আলুর চচ্চড়িকে?

…………………………………………………………………………………………………………………………………………….

হিমের কথাতে মনে পড়ে যায় শীতকালের কথা। বাজারে তখন আলুর আলাদাই রেলা চলে। এমনিতে আলু দুই ভাইবোন– জ্যোতি আর চন্দ্রমুখী (উইকিপিডিয়াতে যে নাম দেখাচ্ছে, তা আমার জানার বাইরে)। তবে শীতে আসেন তাদের দূরসম্পর্কের দাদা– নতুন-আলু। এছাড়া আলুর এক সৎভাইও আছে। নাম– রাঙাআলু। যাই হোক, শীতের কথা বলছিলাম। শীতে বাঙালি গরম-পোশাক গা থেকে খোলে না। আলুরও না। তাই খোসা সমেত দিব্যি চলে। ব্যঞ্জনে, বাহারে, তরকারিতে আর আহারে। আর অবশ্যই অবশ্যই আলুভাতে রূপে। গরম ভাতে তেল-লঙ্কা সহকারে কিংবা ঘিয়ের ঝর্ণাধারায় মাখোমাখো হয়ে তার স্বর্গীয় স্বাদ। আহা…হা..হা! বাঙালিকে তখন আর পায় কে! আজকালকার ‘ইয়ং বেঙ্গল’ প্রজন্ম ‘স্ম্যাশড পটেটো’ নিয়ে আদেখলাপনা করতেই পারে, কিন্তু মনে রাখবেন ছোটবেলায় চটকানো ভাতে ওই বস্তু আপনিও গিলেছেন, মায়ের হাতে আড়ং-ধোলাই খেতে খেতে। আসলে আলু অনেকটা দেশের প্রধানমন্ত্রীর মতো। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামো মেনে চলে। অনায়াসে ভাতে মিশে যায়, ডালে গলে যায়। মশলা মেখে দমে বসে পড়ে। কিংবা মহার্ঘ পোস্ত গায়ে মেখে আপনার নিরামিষ জিভকে চাগিয়ে তোলে। খাবারের যেকোনও ডিপার্টমেন্টে তার অবাধ যাতায়াত, সাবলীল গ্রহণযোগ্যতা। সবদিক থেকেই আলুর সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক দোষে-গুণে সুনিবিড়। ফলে  ভিনরাজ্য কিংবা বিদেশের বাসিন্দারা যতই নাক-সিঁটকে ‘আলুভাতে বাঙালি’ বলে গাল পাড়ুক, বাঙালিসন্তান সেই গঞ্জনাকে গৌরব বলে শিরোস্ত্রাণে ঠাঁই দিয়েছে।

Alu Posto—detailed recipe with video | Bong Eats recipe

গৌরবের কথায় সৌরভ মনে পড়ল। না, বেহালাবাসীর কথা বলছি না। বলছি, তার পরমপ্রিয় বিরিয়ানির কথা। বাঙালি আলু খায়, আর ভালোবেসে খায় বিরিয়ানি। বিশ্বমাঝারে বাঙালির বিরিয়ানির যে একটা নিজস্বতা আছে, তা আজ আর নতুন করে বলার নয়। শুধুই এটুকু বলার, সেই বিরিয়ানি, বিরিয়ানি নয় যদি না থাকে আলু। আজ্ঞে হ্যাঁ। আলু বিনা বাঙালির বিরিয়ানি পুরো আলুনি, মানে মুখে দেওয়ার অযোগ্য। বাঙালি ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান তক্কে আপোষ মেনে নেবে, উত্তমহীন বাংলা সিনেমাও, কিন্তু আলুহীনা বিরিয়ানি? ‘নৈব নৈব চ’! তাই তো আইপিএল ফাইনালে কেকেআর জেতার পর সোশাল মিডিয়ায় বাঙালি স্টেটাস দেয়– ‘প্রিয় হায়দরাবাদ, বিরিয়ানিতে আলু থাকবে… ইতি, কলকাতা।’ শুধু বিরিয়ানি কেন, রোব্বারের খাসির ঝোল, সেখানেও দেখুন, ছিন্নপত্রের মতো ঝোলে ভেসে থাকা পাঁঠার গায়ে জেমস বন্ডের মতো সেঁটে থাকে ডুমো আলু। সে না থাকলে রোব্বারের নস্ট্যালজিয়া বাঙালির কাছে স্রেফ আষাঢ়ে গপ্প!

Aloo in Kolkata biryani has left people undivided - Jiyo Bangla

 

আজকাল খালি মনে হয়, মর্তে আলুর আগমনই ঘটেছে জনতার রসাস্বাদনের উৎকর্ষতা সাধনে। কঠিন করে বললাম বলে বিষম খাবেন না পাঠক। আলুর প্রতি আবেগে কঠিন বাক্যবর্ষণ হচ্ছে, তাই একটু সামলে নেবেন। দু’-একটা ডেমো দিই, তাহলে ব্যাপারটা হৃদয়াঙ্গম করতে আপনাদের সুবিধা হবে।

এই ধরুন, সকালে বাজার করতে বেরিয়ে আপনার পা-জোড়া পাথর হয়ে গেল কোনও এক কচুরির দোকানের সামনে এসে। আসলে আপনার জিভ তখন শুধু গরম তেলে চান করে ওঠা ফুলকো, লালচে কচুরিকেই চাইছে না, যোগ্য-দোসর হিসেবে কামনা করছে দোকানের বড় ডেকচিতে আলুলায়িত আলুর তরকারিটিকেও। সেসব জাগতিক মায়াকে অগ্রাহ্য করে আপনি যদিও বা বাজারের থলি ভারী করে বাড়ি ফিরে আসলেন, কী করে অগ্রাহ্য করবেন প্রসন্নচিত্তে আপনার দিকে এগিয়ে আসা একথালা পূর্ণশশীসম লুচি, তৎসহ একবাটি আলুর চচ্চড়িকে? সব ছেড়ে দিন। ধরুন, ভিড়ের জঙ্গল ভেদ করে ট্রেন কিংবা বাস থেকে নেমে ভরসন্ধ্যায় বাড়ির পথ ধরেছেন। অদূরে কোনও এক কালিকা আলোর নাচন ছুটিয়ে হাতছানি দিয়ে আপনাকে আলুর চপ খেতে ডাকছে। সেই নিশিডাক পারবেন আপনি অগ্রাহ্য করতে? আমার মতো আপনার মনও তখন বলবে, এসব মায়া… মোহ…। কিন্তু ষড়রিপুর তৃতীয়টিকে অগ্রাহ্য করবেন, সে উপায় আছে নাকি!

কচুরির দোকানের মতো আলুর তরকারি, বাড়িতেই বানান, রইল রেসিপি

…………………………………………………………………………………………………………………………………………….

আরও পড়ুন সুযোগ বন্দ্যোপাধ্যায়-এর লেখা: ক্যাপ্টেন হ্যাডক ও কোটি কোটি জ্বালাধরা ফোসকা

…………………………………………………………………………………………………………………………………………….

জানি, নিন্দুকরা বলবে– ‘আলু শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর’! ‘রক্তে সুগার বাড়বে কিন্তু’! কেউ কেউ দাঁত খিঁচিয়ে বলবে, ‘বেশি খেলে বাড়ে মেদ’! ওদের কথায় কর্ণপাত করবেন না। ওরা সবক’টা ‘ষড়যন্ত্রী মশাই’। কথায় আছে, ‘শরীরের নাম মহাশয়। যা সহাবেন, তাই সয়।’ বেয়ার গ্রিলসকে দেখে শিখুন। যা পায়, নুন-চিনি ছাড়া তাই সাঁটিয়ে দিচ্ছে অবলীলায়। আপনি, হে পরম পূজ্য বাঙালি, একটু আলু ম্যানেজ করতে পারবেন না! পারবেন, নিশ্চয় পারবেন।

তবে দুটো পরামর্শ। এক, বাজারে আলুর দাম বাড়ছে, তাই বেশি করে আলু কিনুন, কিন্তু পচা আলু নয়। কথিত আছে, বস্তায় একটা পচা আলু থাকলে সে বাকিদের পচিয়ে দেয়। তাই সাবধানের মার নেই! আর দুই, পারলে লিওনেল মেসিকে ভুলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোকে সাপোর্ট করা শুরু করুন! চমকাবেন না। জেনে রাখুন, প্রাচীনকালে বাঙালি আলু কী বস্তু জানত না। রোনাল্ডোর পূর্বপুরুষ মানে ওই পর্তুগিজদের হাত ধরেই আমাদের হাটে-বাজারে আলুর আবির্ভাব ঘটে। আজ সেটাই ‘বহুরূপে সম্মুখে তোমার’ হয়ে আলুকাবলি থেকে ফুচকা– সবে’তে শোভা বাড়াচ্ছে। তা সেটার একটা প্রতিদান দিতে হবে তো! কৃতজ্ঞতা বলে একটা ব্যাপার আছে নাকি!

ও হ্যাঁ, কথায় কথায় ভুলে গিয়েছি বলতে। আলুর বিজ্ঞানসম্মত নাম– ‘সোলানাম টিউবারোসাম’। কী হল, মুখটা ওমন বাংলার পাঁচ করে আছেন কেন, পড়তে গিয়ে দাঁত নড়ছে? বাদ দিন। আলুতে কনসেনট্রেট করুন!

………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

………………………………………..