কেন লেখা, জেলে থেকে লেখা? জেলে থেকে লেখা একটা প্রকল্প, একটা রাজনীতিক প্রকল্প। একটা বানাতে চাওয়া। বন্দিশালায় চেপে থাকা বাস্তবতা, বন্দি বাস্তবতার বিরুদ্ধতায় এক অন্য বাস্তবতা বানানো। স্বপ্ন বাস্তবতা, বিশ্বাস বাস্তবতা, মুক্ত বাস্তবতা। লেখায় বন্দি করে রাখার ক্ষমতাকে, কর্তৃত্বকে প্রতিরোধ করা, কবিতায় বন্দিত্বকে অস্বীকার, ডায়েরিতে বন্দি করে রাখার ক্ষমতাকে অমান্যতা, চিঠিতে কারাগারের শাসন, নিপীড়নকে বিরোধিতা।
সাতের দশক।
পশ্চিমবাংলার প্রায় সব জেলখানায় বন্দিদের আটকে রাখা হয়েছে।
জেলখানায় রাষ্ট্র আইন দেখিয়ে, আইন বানিয়ে, আইন ভেঙে সব ধরনের অন্যায়, অবিচার, অত্যাচার করে গিয়েছে প্রতিদিন। সব জেলখানায়।
রাষ্ট্রের, শাসকের এক ভয়ংকর চেহারা জেলখানা। এমন অবস্থায় সৃষ্টি। বন্দিদের সৃষ্টি। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধতায়, রাষ্ট্রকে অস্বীকারে সৃষ্টি। আরেকটা জেলখানা বানানো। সৃষ্টির জেলখানা। রাজনীতিক বন্দিদের সৃষ্টির জেলখানা। অন্য জেলখানা। শারীরিক বন্ধনের বিরুদ্ধে, মুক্তির সৃষ্টি। মুক্তি রচনা সৃষ্টি।
আরও পড়ুন: বিষণ্ণ কমলালেবুর দেশে
স্লোগান বানানো, স্লোগান দেওয়া, ছবি আঁকা, পোস্টার আঁকা দেওয়ালে, হাতে লেখা পত্রিকা, পত্রিকায় আঁকা। হাজারিবাগ জেলখানায় ‘তূনীর’, আলিপুর সেন্ট্রাল জেলখানায় ‘উদয়ন’। ‘তূনীর’-এর সম্পাদকীয়– ‘আমাদের অস্তিত্বের চারপাশ থেকেই সৃষ্টি। নাটক লেখা, গান লেখা, গান গাওয়া, স্লোগান বানানো, স্লোগান দেওয়া।’
লেনিনের কথা মনে করা– জেলখানা কমিউনিস্টদের বিশ্ববিদ্যালয়। জেলখানায় লেখা গান। একজনের অনুপ্রেরণায় আরেকজনের লেখা, নানা ভাষায় লেখা, জেলখানায় লেখা গান জেলখানায় গাওয়া। জেলখানায় গান লেখা, গান গাওয়া রাজনীতি। জেলখানায় লেখা কবিতা। কবিতার বিষয় জেলখানা, বন্দিত্বের বিরোধিতা, ক্ষমতাকে অস্বীকার। কবিতায় লড়াইয়ের চিহ্ন। কবিতায় মুক্তি।
জেলখানায় গল্প লেখা। গল্পে জেলখানা। জেলখানা এক যাত্রাপথ। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, অত্যাচার, প্রতিরোধ, মৃত্যু, বন্ধুতা, রাজনীতি, স্বপ্ন, বিশ্বাস, লড়াই।
জেলখানায় ডায়েরি। গদ্যে, পদ্যে। জেলখানা নিয়েই ডায়েরি। কমরেডদের ভালোবাসা। সাম্রাজ্যবাদের সৃষ্টি লোহার গরাদকে বিদ্রুপ করে বলা– দেখো, তোমার শৃঙ্খলের থেকেও, আমাদের ভালোবাসা অনেক শক্তিমান।
লেখার উপকরণ। ‘খুব কষ্টে চুপিচুপি গোপনে/ একটু পেন্সিলের শিস/ আর একটুখানি কাগজ যোগাড় করেছি/ এক মেয়াদি মেটের কাছ থেকে…/ হরেক রকম গল্প বলতে হয়েছে তাকে/ ও বুঝেছিল আমার যন্ত্রণা/…কিছু বোঝা যায় না/ কি লিখছি ঝাপসা, অস্পষ্ট/ ক্ষুদে ক্ষুদে লেখা/ কাগজ তো জোটে না বলে নয়/ গোপন রাখতে হবে এ লেখাটুক।
আরও পড়ুন: ইরানের পরিচালক দারিয়ুশ মেহরজুইয়ের মৃত্যু একটি রাজনৈতিক হত্যা
চিঠি লেখার অনেক নিয়মকানুন, কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাবিধি, চিঠি লেখা পোস্টকার্ড, দেবে কর্তৃপক্ষ, মাসে একটা বা দুটো। ছোট অক্ষরে লেখা। চিঠিতে যা লেখা, চিঠিতে তাই রাখা, তাই পাঠানো হয়। মুশকিল কাঁচিবাবুকে নিয়ে, যাকেই চিঠি লেখা হোক না কেন ওই কাঁচিবাবু চিঠিগুলোকে কেটেকুটে তার মনমতো পাঠাবে। চিঠিতে বন্দিত্ব, রাজনীতি, বিশ্বাস, ভয় অমান্যতা। জন্ম নেওয়া ইচ্ছে, মুক্তির ইচ্ছে, কারারুদ্ধতাকে ভেঙে ফেলার ইচ্ছে, দারিদ্র, শোষণ, বিবরণ, ব্যাখ্যা, ইতিহাস, আদর্শ, রাজনীতি।
কেন লেখা, জেলে থেকে লেখা?
জেলে থেকে লেখা একটা প্রকল্প, একটা রাজনীতিক প্রকল্প। একটা বানাতে চাওয়া।
বন্দিশালায় চেপে থাকা বাস্তবতা, বন্দি বাস্তবতার বিরুদ্ধতায় এক অন্য বাস্তবতা বানানো। স্বপ্ন বাস্তবতা, বিশ্বাস বাস্তবতা, মুক্ত বাস্তবতা।
লেখায় বন্দি করে রাখার ক্ষমতাকে, কর্তৃত্বকে প্রতিরোধ করা, কবিতায় বন্দিত্বকে অস্বীকার, ডায়েরিতে বন্দি করে রাখার ক্ষমতাকে অমান্যতা, চিঠিতে কারাগারের শাসন, নিপীড়নকে বিরোধিতা।
কারাগারে আটকে রাখা শরীর বন্দি, তাকে অস্বীকার করে মনকে মুক্ত করা। এমন অস্বীকার ও নির্মাণের যৌথতায় বন্দি দ্রষ্টা হয়ে ওঠে, সৃজনশীল হয়ে যায়। বন্দি লেখক হয়ে যায়। হয়ে থাকে। রাষ্ট্রের বন্দি করে রাখার ক্ষমতাকে প্রতিরোধে লেখাকে, সৃষ্টিকে মুক্ত করে রাখা, শব্দে, বাক্যে, ধরনে, সমবেত স্বপ্নে, বিশ্বাস, দর্শনে, রাজনীতিকতায়।
লেখা তখন রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। অংশগ্রহণ করতে চেয়ে, করে, করতে করতে শব্দ, বাক্য তখন বন্দির, রাজনীতির ক্ষমতার প্রকাশ। বন্দি তখন অংশগ্রহণকারী। বন্দি জীবনে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণকারী। কারাগারে দেখা তখন অংশগ্রহণ সাহিত্য।
কারাগারে বন্দি রাজনীতি করার জন্যই। বন্দির আসা রাজনীতির ভূমি থেকে। লেখায় রাজনীতিক আন্দোলন। লেখায় অভিজ্ঞতা, আদর্শ, চিহ্ন, কাহিনি, উপকরণ, ভাষা, স্বর বিপ্লবী রাজনীতি থেকে গড়ে তোলা, গড়ে ওঠা। কারাগারে লেখা ‘বিপ্লবী সাহিত্য’।
জেলখানায় লেখা জেল কর্তৃপক্ষের নিয়ম, শাসন, অত্যাচারের বিরোধিতায়, এবং প্রতিরোধে। জেলখানায় লেখা ‘প্রতিরোধ সাহিত্য’।
আরও পড়ুন: হাংরি আন্দোলনের সালতামামি
বন্দি হয়ে থাকার, বন্দি করে রাখার বিরুদ্ধতায় স্বপ্ন, কল্পনা, বিশ্বাস, আশা। রাষ্ট্রের কাজ স্বপ্নকে আটকানো, স্বপ্নের ক্ষমতা মুক্ত হওয়ার, কারারুদ্ধতাকে ভেঙে ফেলা। ভেঙে ফেলা অক্ষরে, শব্দে, বাক্যে, ছন্দে, সুরে। জেলখানায় লেখা ‘স্বপ্ন সাহিত্যে’।
এমনই ভেঙে ফেলার ক্ষমতা থেকে জন্ম নেয় অক্ষর, শব্দ, বাক্য, ছন্দ, সুর। বন্দিকে বন্দিশালার বাইরে নিয়ে যায়। বিশ্বাসের গড়নে, আশার কাঠামোয় তৈরি হয় এক শব্দ পৃথিবী। এই পৃথিবীতে আপাত অসম্ভব অবস্থাতে একটা সম্ভাবনা, রাজনীতিক আশা।
জেলখানায় লেখা এক শব্দ পৃথিবী। রাজনীতি করে বানানো এক শব্দ পৃথিবী। রাজনীতি করতে করতে বানানো এক শব্দ পৃথিবী। যাকে কারাগারে বন্দি করে রাখা যায় না। শব্দ মুক্তির। শব্দ পৃথিবী মুক্ত পৃথিবী। এক চলমান মুক্ত পৃথিবী। জেলখানায় বন্দি হওয়ার আগে, জেলখানায় বন্দি হয়ে, জেলখানা থেকে মুক্ত হওয়ার পরেও।
জেলখানায় লেখা এক চলমান রচনা।