১৯৫২ সালে কাম্বোডিয়া ভ্রমণ উমাপ্রসাদের জীবনের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে বিলেতে সংরক্ষিত বুদ্ধদেবের দুই প্রধান শিষ্য মোগলন ও সারিপুত্রের পুণ্য অস্থি ভারতের মহাবোধি সোসাইটিকে ফেরত পাঠায় ব্রিটিশ সরকার। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কাম্বোজবাসীরা সেই অস্থি দর্শন করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। সেখানকার সরকারের তরফ থেকে প্রিন্স নরোদ্দম সিহানৌক পুণ্য অস্থি সমেত মহাবোধি সোসাইটির একটি প্রতিনিধিদলকে কয়েকদিনের জন্য কাম্বোডিয়ায় আমন্ত্রণ জানান। যাতায়াতের জন্য প্লেনেরও ব্যবস্থা সে দেশের সরকারই করবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন।
জাতীয় গ্রন্থাগারে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সংগ্রহ দেখলে সত্যিই অবাক লাগে– ৮০ হাজারেরও বেশি গ্রন্থ রয়েছে! প্রাচীন বইগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। এই সংগ্রহ থেকেই প্রথম রামানন্দ ভারতীর ‘হিমারণ্য’ পড়েছিলাম। কে জানে ওই বইটাই উমাপ্রসাদও পড়েছিলেন কি না! বাবার এই বিশাল সংগ্রহের বিভিন্ন বই থেকেই তাঁর হিমালয় ভ্রমণ তথা ভ্রমণের নেশার একপ্রকার সূত্রপাত ঘটে।
‘বাড়িতে বাবার ছিল বিরাট গ্রন্থাগার। রান্নাঘর, স্নানের ঘর এই ধরনের ঘর কয়খানি ছাড়া সেই তিনতলা বাড়ির এমন কোন ঘর, দালান বা হল্ ছিল না, যেখানে বই-ভরা শেল্ফ বা আলমারি নেই। সেই বই-এর রাজ্যে আমাদের ভাই-বোনদের জন্ম। সেই গ্রন্থরাজির অরণ্যের অস্তরালেই আনাচে কানাচে আমার ছেলেবেলার লুকোচুরি খেলা। ক্রমে লেখাপড়া শুরু হলে সেই বই-এর মধ্যে থেকে সংগ্রহ করে কিছু কিছু পড়ার কৌতূহল ও আগ্রহ। সেইখানেই আবিষ্কার সোয়েন হেডিনের Trans Himalaya গ্রন্থ। কৈলাস-মানস সরোবরের বর্ণনা পড়ি, ছবি দেখি। জলধর সেনের “হিমালয়” বদরীনাথ পথের সন্ধান দেয়। পিতৃদেবকে উপহার দেওয়া রত্নমালা দেবীর “হিমালয় পরিভ্রমণ” ও “কাশ্মীর ভ্রমণ” বই দুখানিও হাতে আসে । সেই সময়কার আরও যে বইগুলির কথা এখনও মনে আছে, তার কয়েকটির নাম উল্লেখ করি; শরৎচন্দ্র দাসের Journey to Lhasa & Central Tibet (এটিও গ্রন্থকার কর্তৃক পিতৃদেবকে উপহৃত)। Kawaguch-র Three years in Tibet. Savage Landor-এর In the Forbidden Land. Francis Younghusband-এর India & Tibet. Waddell-এর Amongst the Himalayas ও Lhasa & its mysteries এবং আরও একটি অতি চমৎকার সচিত্র বই – A. L. Mumm-এর Five months in the Himalayas…’
তবে ১৯১৯ সালে যখন প্রথমবার দার্জিলিং গেলেন, তাঁর মনে হয়েছিল– বই পড়ে হিমালয় সম্বন্ধে যে ধারণা তাঁর হয়েছিল আর প্রকৃত হিমালয় দর্শন একেবারেই ভিন্ন– ‘আকাশের পটে প্রকৃত হিমালয়ের বিরাট রূপের মাঝে সে-ধারণা চকিতে কোথায় হারিয়ে যায়, যেমন অকুল সাগরজলে এক ঘটি জল নিমেষে বিন্দুসম অদৃশ্য হয়।’ আবার দীর্ঘদিন হিমালয় ভ্রমণ করে তাঁর মনে হয়েছিল সেই প্রথম হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা ‘যেন শিশুর হাতে ছবির বই,– তখনও অ আ ক খ বর্ণপরিচয় হয়নি,– মুগ্ধনেত্রে শুধু বই-এর ছবি দেখা।’
আশুতোষের সংগ্রহের ভ্রমণের বইগুলি উমাপ্রসাদকে পাহাড়মুখী তথা হিমালয়মুখী করেছিল। কিন্তু ছেলেবেলায় ছুটিতে নিয়মিত মধুপুরের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়াই এক হিসেবে তাঁর ভ্রমণের, খানিক অন্য ভ্রমণের হাতেখড়ি।
‘জন্মাবধি আমাদের মধুপুরে যাতায়াত। স্কুল-কলেজের ছুটি হলেই সেইখানে গিয়ে কাটানো। টো টো করে সারাদিন ঘোরা। দিগন্তজোড়া মাঠে মাঠে। ধানক্ষেতের আলে আলে। শাল-পলাশের বনের ছায়ায়। উপলবহুল ঝরনাধারার পাশে শিলাস্তূপে সুখাসনে বসা। শীর্ণকায়া নদীর শুষ্ক বালুচরের উপর দিয়ে জুতা হাতে খালি পায়ে জলধারার উৎস সন্ধানে যাত্রার, ও ছোট ছোট পাহাড় ও টিলা দেখলেই তার উপর ওঠার সে কী স্ফূর্তি! সেই জনহীন শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে একাকী স্তব্ধ হয়ে বসে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার সে এক অপরিসীম আনন্দ। দিগন্তে নৈঋত কোণে বহুদূরে গাঢ় নীল ধনুকাকার দেখা যেত পরেশনাথ পাহাড়। শুনতাম, এই অঞ্চলের সর্বোচ্চ গিরিশিখর, প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট উঁচু। আকাশে মাথা তুলে নীলচোখে ইশারা করে যেন কাছে যেতে ডাকত!’
হিমালয় ভ্রমণকাহিনি বলতেই জলধর সেন আর উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের কথাই মনে আসে সবার আগে। তবে হিমালয় ভ্রমণের ফাঁকে ফাঁকে উমাপ্রসাদের চঞ্চল চরণ ঘুরে বেড়িয়েছে দেশবিদেশের নানা স্থানে। সে গরুর গাড়িতে চেপে পুরী থেকে কোনারক যাওয়া হোক কি নির্জন কন্যাকুমারিকায় আত্মানুসন্ধান, অথবা জাভার মন্দিরে কি বেতলার জঙ্গলে তাঁর আশ্চর্য ভ্রমণ। এই অন্যরকম ভ্রমণে আরেক উমাপ্রসাদকে খুঁজে পাই আমরা। তীর্থভ্রমণও অনেক করেছেন উমাপ্রসাদ। কিন্তু তাঁর পথচলা-তে তীর্থ নয়, ভ্রমণই মুখ্য হয়ে উঠেছে চিরকাল। ‘যাত্রাপথের আনন্দগান যে গাহে, তারি কণ্ঠে তোমারি গান গাওয়া’– এই হয়তো ছিল তাঁর মনের কথা।
উমাপ্রসাদের প্রথম পাহাড়ে চড়া হিমালয়ে নয়, মধুপুর থেকে একটু দূরে গিরিডিতে পরেশনাথ পাহাড়ে, ১৯২০ সালে। কিন্তু ঠিক আগের বছরই দার্জিলিংয়ের শৈলশহরের পিচঢালা পথে হেঁটে বেরিয়ে পাহাড়ে চড়া সম্বন্ধে তাঁর যে আত্মবিশ্বাস জন্মেছিল, সত্যিকারের পাহাড়ে চড়তে গিয়ে তা একেবারে ভেঙে যায়। জঙ্গলাকীর্ণ সর্পিলী এবড়োখেবড়ো পাথুরে পথে প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট উচ্চতার পরেশনাথ পাহাড়ে উঠতে সময় লেগেছিল পৌনে তিন ঘণ্টা। আর তখনই উপলব্ধি করেছিলেন যে, ‘সমতল পথের ও পাহাড়ী পথের দূরত্বের পরিমাপ সমান হলেও তাদের মান-মর্যাদা কত ভিন্ন, চলার গতিবেগে ও ছন্দে কত তারতম্য থাকে। পাহাড়ে উঠতে হয় ধীরে ধীরে, আপন সামর্থ্য ও দম বুঝে, এবং নিজেকে কখনও অতিমাত্রায় ক্লান্ত হতে না দিয়ে।’
অন্যরকম ভ্রমণের যে ছবি তাঁর মনে চির উজ্জ্বল রয়ে গিয়েছে, তা হল বালির চর দিয়ে গরুর গাড়িতে চেপে পুরী থেকে কোনারক যাওয়া। চাঁদনি রাতে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে সে এক অনন্ত যাত্রা– যা শেষ হয় ভোরের স্বর্ণালী আভায় কোনারকের সূর্যমন্দির আর একদল কৃষ্ণসার মৃগ দর্শনে।
হিমালয়ের বিভিন্ন এলাকা বাদে উমাপ্রসাদের সবথেকে প্রিয় কন্যাকুমারিকা। আরও স্পষ্টভাবে বললে কন্যাকুমারিকাতে তাঁর প্রথম ভ্রমণ অভিজ্ঞতা– ১৯৫৩ সালের জানুয়ারি মাসে। ‘তিন সাগরের সঙ্গমে স্থানটির অপূর্ব পরিবেশ। পুবে বঙ্গোপসাগর পশ্চিমে আরব সমুদ্র। দক্ষিণে ভারত মহাসাগর। ভারতের এই একমাত্র স্থান যেখানে একই দিনে দেখা যায় প্রভাতে সমুদ্র থেকে সূর্যোদয়, আবার, অপরাহ্নে আর এক সমুদ্রে সূর্যাস্ত! অতুলনীয় এই রমণীয় দৃশ্য। দক্ষিণ ভারত মন্দিরময়। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে এক-একটা মন্দির-শহর। চারিপাশে সুবিশাল গোপুরম। কারুকার্য শোভামণ্ডিত। দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। কিন্তু, কুমারিকার মন্দির সে তুলনায় ক্ষুদ্রাকার। আমার ধারণা. প্রকৃতির এই প্রকৃত লীলাভূমিতে ইচ্ছা করেই মন্দির এখানে ছোট করে গড়া হয়,– মানুষের হাতের সৃষ্টি যাতে বিধাতার সৃষ্ট প্রাকৃতিক রূপকে কোনমতে ক্ষুণ্ণ না করে! ভারতভূমির সেই দক্ষিণতম শেষ ভূখণ্ড সেই প্রথমবার দেখেছি। জনবিরল, অতিশান্ত তীর্থক্ষেত্র। কয়েকটিমাত্র ছড়ানো ঘরবাড়ি। দেখে পর্যটক-মন তৃপ্তি পেয়েছিল। নির্জন সমুদ্রসৈকতে শান্তমনে পুলকিত নয়নে তাকিয়ে থেকেছি। তট থেকে কিছুদূরে সাগরজলের মধ্যে মাথা তুলে সেই প্রসিদ্ধ Vivekananda Rock– স্বামিজী বিবেকানন্দের ধ্যানাসন শিলা। দিগন্তপ্রসারী অপার বারিরাশি, আর সেই সুপবিত্র শিলাখণ্ডের পাদদেশ ঘিরে উদ্বেলিত তরঙ্গমালার আছড়ে পড়া, যেন বেদিমূলে সহস্র শ্বেতকমলের পুষ্পাঞ্জলি। কল্পনার চোখে দেখি যেন সেই তেজোদীপ্ত বিরাট পুরুষ চিরধ্যানমগ্ন হয়ে তখনও তেমনই সমাসীন। কুমারিকার প্রশান্ত পরিবেশ, যাত্রীবিরল ক্ষুদ্র মন্দির. সাগরসঙ্গমের অবর্ণনীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, স্বামিজীর পুণ্যস্মৃতি-বিজড়িত সেই নিবারণ শূন্য শিলাখণ্ড এমনই গভীরভাবে মনে আনন্দ ও তৃপ্তি আনে যে কয়েকদিনই ঐখানে কাটাই!’ কিন্তু ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয়বার কন্যাকুমারিকায় গিয়ে তার পরিবর্তন দেখে এতটাই ব্যথিত হয়েছিলেন যে, একদিনের বেশি সেখানে থাকেননি।
দেশের বিভিন্ন স্থানের পাশাপাশি উমাপ্রসাদ ঘুরেছেন বিদেশেও। কিন্তু বিদেশ-ভ্রমণ শুনলে যেমন ছবি মনে ভাসে, ঠিক তেমনটা নয়। তাঁর ভ্রমণস্থানের তালিকায় রয়েছে বর্মা মানে বর্তমান মায়ানমার, শ্রীলঙ্কা কিংবা কাম্বোডিয়ার মতো সেইসময়ে তুলনায় কম আলোচিত জায়গাগুলি। ১৯৫০ সালে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন যে, রামায়ণ পড়ে আমরা শ্রীলঙ্কাকে যতটা চিনি, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী প্রকৃত শ্রীলঙ্কায় কিন্তু সেভাবে রাম-রাবণ-হনুমানের স্মৃতিবিজড়িত কোনও জায়গা নেই। একমাত্র ‘অশোকবন’ ছাড়া। কৌতূহলী হয়ে সেখানে গিয়ে উমাপ্রসাদের ভালো লেগেছিল– ‘সিংহলের পার্বত্য প্রদেশে অতি সুন্দর শৈলশহর Nuwara Eliya– (৬,১৯৯ ফুট উঁচু) নুয়ারা এলিয়া– অর্থাৎ New Lights– নবীন আলো। সেই পার্বত্য অঞ্চলেরই অপর এক অংশে– অশোকবন। সীতা এলিয়া। ভীতিবহ গভীর বনজঙ্গল নয়। সুবিন্যস্ত সুরম্য উদ্যান। Hakgala-তে সিংহলের প্রসিদ্ধ বোটানিক্যাল গার্ডেনস্। শুনলাম, বহুবিধ মূল্যবান ও দুষ্প্রাপ্য তরুলতা, বৃক্ষরাজি এই উদ্যানের সম্পদ। বিশ্বজোড়া এর খ্যাতি। শান্ত নির্জন পার্বত্য পরিবেশে চারিদিকের ফলফুলের ও বৃহৎ বনস্পতির শোভা মনোমুগ্ধকর। তারই একান্তে সাম্প্রতিককালের ছোট এক মন্দির। ভিতরে রাম-সীতা-লক্ষণ ও হনুমানের মূর্তি। শুনি, এইখানেই ছিল সেকালে অশোকবন। স্থানটির মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ দেখে মনে হল, সীতাকে এমন স্থানে রাখা বন্দিনীর প্রতি রাবণের গভীর অনুরাগেরই সূচনা করে!’
১৯৫২ সালে কাম্বোডিয়া ভ্রমণ উমাপ্রসাদের জীবনের এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সেই সময়ে বিলেতে সংরক্ষিত বুদ্ধদেবের দুই প্রধান শিষ্য মোগলন ও সারিপুত্রের পুণ্য অস্থি ভারতের মহাবোধি সোসাইটিকে ফেরত পাঠায় ব্রিটিশ সরকার। বৌদ্ধধর্মাবলম্বী কাম্বোজবাসীরা সেই অস্থি দর্শন করতে উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। সেখানকার সরকারের তরফ থেকে প্রিন্স নরোদ্দম সিহানৌক পুণ্য অস্থি সমেত মহাবোধি সোসাইটির একটি প্রতিনিধিদলকে কয়েকদিনের জন্য কাম্বোডিয়ায় আমন্ত্রণ জানান। যাতায়াতের জন্য প্লেনেরও ব্যবস্থা সে দেশের সরকারই করবে বলে তিনি জানিয়েছিলেন। তখন ভারতে মহাবোধি সোসাইটির সভাপতি ছিলেন উমাপ্রসাদের মেজদাদা বাংলার রাজনীতির অন্যতম মুখ শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। দাদার আগ্রহে ২৫০ টাকা দিয়ে সোসাইটির আজীবন সদস্য হয়ে কাম্বোডিয়া যাওয়ার সুযোগ পান উমাপ্রসাদ। নমপেন-এ পৌঁছে প্লেন থেকেই সেখানকার অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে চমৎকৃত হন তিনি। ‘এ কী! কোথায় গেল ধরিত্রীর সেই দিগন্তব্যাপী শ্যামল বিস্তার? নীচে প্রকৃতই যেন জনসমুদ্র। শব্দহীন, শান্ত, নিস্তরঙ্গ। যতদূর দৃষ্টি চলে শুধু মানুষ আর মানুষ,– হাঁটু গেড়ে বসে, জোড়হাতে, আকাশপানে মুখ তুলে প্লেনটিকে নামতে দেখে, যেন যান্ত্রিক আকাশযানের নামা নয়, স্বর্গ থেকে বাহন চড়ে ধরাধামে অবতরণ করেন কোন্ দেবতা! সেই বিশাল জনসমাবেশের মাথার উপর প্লেন বার দুই চক্কর দেয়, তারপরই মাটিতে নামে। সঙ্গে সঙ্গে চকিতে স্তব্ধ শান্ত জনসমুদ্রে যেন তরঙ্গোচ্ছ্বাস ওঠে, হাজার হাজার ভক্তিবিহ্বল কন্ঠের সমবেত ধ্বনি জাগে,– বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি, ধর্মং শরণং গচ্ছামি, সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি।– দিগ্দিগন্ত সেই স্বরে অনুরণিত হতে থাকে। সেইদিন সেই মহান দৃশ্য স্মৃতিপটে অক্ষয় হয়ে আছে। তারপরের বিবরণও শোনাই। প্লেন থেকে নেমে শুনি, পবিত্র অস্থি-র এই বিপুল সম্বর্ধনার উদ্দেশ্যে বহুদূর অঞ্চল থেকেও স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে লোকজন এসে এভাবে মিলিত হয়েছে এবং দুদিন ধরে এখানে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে,– আকাশতলে, বৃষ্টির মধ্যেও! এ তো হোল সম্বর্ধনা। এর পর Relic-দর্শনের পালা। তার আয়োজন হয় পরদিন থেকে স্থানীয় সব চেয়ে বড় প্যাগোডা-মন্দিরের সুপ্রশস্ত মুক্ত অঙ্গনে। তিন-চার দিন ধরে চলে। সেও এক অভিনব দৃশ্য। সুশৃঙ্খলাযুক্ত হয়ে কাতারে কাতারে দর্শনার্থীরা আসে– বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, বালক-বালিকা,– এমনকি, শিশুরাও জননীর কোলে। হয়ত মায়েদের বিশ্বাস, অবোধ শিশুদের ভক্তিভাব না জাগলেও শুধু সেদিকে চোখ মেলে তাকালেও পুণ্যলাভ!’
বাংলার বাঘ স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের তৃতীয় পুত্র উমাপ্রসাদের জন্ম ও মৃত্যু উভয়ই ১২ অক্টোবর। বাঙালি জনমানসের কল্পনায় যেই দিনটিতে দেবী দুর্গা সপরিবারে মর্ত্য থেকে কৈলাসে পাড়ি দেন, সেই বিজয়াতিথিতেই জন্মেছিলেন তিনি। ‘আমার ছেলেবেলা’ শীর্ষক রচনায় উমাপ্রসাদ লিখেছিলেন, তাঁকে দেবী দুর্গাই রেখে যান জননী যোগমায়ার কোলে। ৯৫ বছরের দীর্ঘ জীবনকালে (১৯০২-১৯৯৭) ৮৬ বছর পর্যন্ত ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই সুবিস্তৃত ভ্রমণজীবনে হিমালয় বাদে অন্য ভ্রমণের সংখ্যাও প্রচুর। তার কিছু কিছু তিনি গ্রন্থবদ্ধ করে গেছেন। যার মধ্যে রয়েছে তাঁর অরণ্য ভ্রমণ কাহিনিগুলি– ‘পালামৌর জঙ্গলে’, ‘আলোছায়ার পথে ও দুধওয়া’, ‘জলপথে যাত্রার বিবরণ– জলযাত্রা’ এবং অন্যান্য ভ্রমণকাহিনির মধ্যে ‘গুপ্তেশ্বর’, ‘কাবেরী কাহিনী’, ‘আফ্রিদি মুল্লুকে’, ‘দুই দিগন্ত ও আরবসাগর তীরে’। উমাপ্রসাদ শুনলে যাঁদের চোখে হিমালয়ের শুভ্র তুষারশৃঙ্গ ভেসে ওঠে, তাঁরাও এই রচনাগুলি পড়লে নির্মল আনন্দই পাবেন।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved