Robbar

‘ছড়ার ছবি’ নাকি ছবির ছড়া?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 2, 2025 6:02 pm
  • Updated:December 2, 2025 6:02 pm  

‘ছড়ার ছবি’ প্রকাশিত হয় ৫ অক্টোবর, ১৯৩৭। তার আগে কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠিতে সেই আভাস পাওয়া যায়। ১০ জুন কিশোরীমোহনকে কবি  লিখছেন, ‘এবার আমি ছেলেদের জন্য অনেক কবিতা লিখেছি নন্দলালের ছবি সম্বলিত। একটু নতুন রকম হবে।’ বাস্তবিকই নতুন রকম। নন্দলালের ছবিতে, বিশেষত পোস্টকার্ডের স্কেচে, রবীন্দ্রনাথ বহুদিন ধরেই দেখে আসছেন সত্যি-মানুষের চলাচলের জগৎ। ‘ছড়ার ছবি’তে এসে তারা ঘটিয়ে বসল এক সাংঘাতিক কাণ্ড! নন্দলালের ছবি তাঁকে দিয়ে ৩২টি ছড়াই লিখিয়ে নিল না শুধু, সৃষ্টি করিয়ে নিল একরাশ সত্যি-মানুষ।

তনুরিমা ধর

‘ওগো, চিত্রী, এবার তোমার কেমন খেয়াল এ যে—
এঁকে বসলে ছাগল একটা উচ্চশ্রবা ত্যেজে।’

‘ছড়ার ছবি’ কাব্যগ্রন্থে ‘ছবি আঁকিয়ে’ কবিতায় শিল্পী নন্দলাল বসুকে অভিনন্দিত করে লেখেন ছড়াকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গ্রন্থচিত্রকর নন্দলাল রবি-রশ্মিতে স্নাত হলেন।

১৯৩৭ সাল, সেবার গ্রীষ্মে আলমোড়া গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সেখানেই ডাকযোগে নন্দলাল প্রেরিত ছাগলের ছবিটি পান । পোস্টকার্ডে তুলি ও কালি দিয়ে আঁকা। উত্তরে কবি চিত্রশিল্পীকে লেখেন, ‘কল্যাণীয়েষু, তুমি আমাকে যে ছাগলের ছবি পাঠিয়েছ, এ উর্ব্বশীর সহোদর ভাই নয়, কিন্তু এর বাসা অমরাবতীতে। এর থেকে প্রমাণ হয়, আর্টে সুন্দর হবার জন্যে সুন্দর হবার কোনো দরকারই হয় না। আর্টের কাজ মন টানা, মন ভোলানো নয়।’ ১৯৩৭ সালের ১৭ মে লেখা এ চিঠি। কবি তখন আলমোড়ার নিরালায় লিখছেন ‘ছড়ার ছবি’, নন্দলালেরই ছবির ওপর ভর করে।

কবি যখন আলমোড়া রওনা হন, তখন কলকাতার বিভিন্ন অঞ্চলে পাটকলগুলিতে শ্রমিক-ধর্মঘট চলছিল। এই ধর্মঘটের প্রতি কবি সংবেদনশীল ছিলেন। তাঁর আন্তরিক দরদ ও বেদনাবোধ অল্পকাল পরেই নন্দলালের ছবি উপলক্ষ করে বাণীরূপ পায়। ‘মাধো’ কবিতাতে সেই অস্থির সময় ধরা পড়েছে–

‘‘কোন্খানে এক পাটকলে সে করতেছে সর্দারি।
এমন সময় নরম যখন হল পাটের বাজার
মাইনে ওদের কমিয়ে দিতেই, মজুর হাজার হাজার
ধর্মঘটে বাঁধল কোমর; সাহেব দিল ডাক;
বললে, ‘মাধো, ভয় নেই তোর, আলগোছে তুই থাক।’’

আলমোড়ায় যাওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ নন্দলালের আঁকা অনেকগুলি স্কেচ সঙ্গে নিয়ে যান। সেবার আলমোড়ায় কবির অন্যতম সঙ্গী ছিলেন অনিলকুমার চন্দ। ‘With Rabindranath at Almorah’ নামে একটি  স্মৃতিকথা লিখেছিলেন তিনি। তা থেকে জানা যায়, আলমোড়া যাওয়ার সময় কবি বইপত্রের সঙ্গে নিয়েছিলেন প্রচুর লেখার ও আঁকার সরঞ্জাম আর অতি অবশ্যই নন্দলাল বসুর আঁকা স্কেচ। এই চিত্রাবলি রবীন্দ্রনাথকে কবিতা রচনায় যে কী প্রবল উৎসাহ দিয়েছিল, তার উজ্জ্বলতম নিদর্শন ‘ছড়ার ছবি’।

ছবিকে ছড়ায় অনুবাদ কদাচিৎ দেখা যায়। ছবির প্রেরণায় কবিতা। এ  যেন মণির সঙ্গে কাঞ্চনের যোগ। আমাদের কাব্যে-সাহিত্যে রবীন্দ্রনাথ যে কাজটি করেছেন, চিত্রশিল্পে সেই কাজ করেছেন নন্দলাল, তাঁর শিল্পকর্ম অনেকাংশে রবীন্দ্রনাথের কাব্যকৃতির পরিপূরক।… এদিক থেকে নন্দলাল রবীন্দ্রকাব্যের অন্যতম ভাষ্যকার। এ প্রসঙ্গে স্বয়ং কবিগুরুর স্বীকারোক্তি–

‘তোমার তুলিকা কবির হৃদয়
নন্দিত করে, নন্দ!
তাই তো কবির লেখনী তোমায়
পরায় আপন ছন্দ।’

নন্দলাল বসু

চিত্রশিল্পী ও কবির এমন নান্দনিক আদানপ্রদান এর আগেও আমরা খেয়াল করেছি, তবে ছড়ায় নয়, গানে। নন্দলাল অঙ্কিত চিত্র অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথের প্রথম লেখা সম্ভবত ‘গীতাঞ্জলি’তে দেখি। ছবিটি নন্দলাল এঁকেছিলেন ১৯০৯ সালে, কার্টিজ পেপারে, জলরঙে। ছবিতে ছিল– মন্দিরের ভেতর গুরু শিষ্যকে দীক্ষা দিচ্ছেন। এই ছবি দেখে প্রাণিত হয়ে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন, ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা।’ কবি শান্তিনিকেতনে বসে এটি লেখেন ১৭ পৌষ, ১৩১৬। ‘ভারতী’ পত্রিকায় যা ছাপা হয় ১৩১৭, জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায়। ‘নিভৃত প্রাণের দেবতা’ যে নন্দলালের চিত্র অবলম্বনে রচিত, সে-কথা ‘ভারতী’তে উল্লেখ আছে।

‘ছড়ার ছবি’ প্রকাশিত হয় ৫ অক্টোবর, ১৯৩৭। এই কাব্যগ্রন্থে প্রতি কবিতার সঙ্গে নন্দলাল বসুর আঁকা ছবি ছিল, কখনও বা একাধিক ছবি। মোট কবিতার সংখ্যা ৩২, ছবির সংখ্যা ৩৮। ৩১টি রেখাচিত্র, ৭টি হাফটোনের ছবি। আখ্যাপত্রে উল্লিখিত হয়েছিল ‘নন্দলাল বসু কর্তৃক চিত্রাঙ্কিত’। প্রচ্ছদও তাঁরই করা। বইটির আকার ছিল ১০’’ x ৮’’। কিন্তু ছবি এঁকেই শিল্পীর দায়িত্ব শেষ হয়নি। মুদ্রণব্যয় সংক্ষেপ করার তাগিদে তাঁর কালি-তুলির ছবি তাঁকে লাইন-ড্রইংয়ে পরিবর্তিত করতে হল। ফলে মুদ্রণের কাজও সহজতর হল। ‘ছড়ার ছবি’ নিয়ে কবির ঔৎসুক্য ছিল খুব বেশি। প্রতীক্ষায় থাকতেন– ছাপা বইয়ের পাতায় এগুলি কেমনভাবে আসে, কীরকম চেহারা নেয়!

সচিত্র ‘ছড়ার ছবি’ অক্টোবরের গোড়ায় গ্রন্থরূপ নেয়। তার আগে কিশোরীমোহন সাঁতরাকে লেখা রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি চিঠিতে সেই আভাস পাওয়া যায়। ১০ জুন কিশোরীমোহনকে তিনি লিখছেন, ‘এবার আমি ছেলেদের জন্য অনেক কবিতা লিখেছি নন্দলালের ছবি সম্বলিত। একটু নতুন রকম হবে।’ বাস্তবিকই নতুন রকম। নন্দলালের ছবিতে, বিশেষত পোস্টকার্ডের স্কেচে, রবীন্দ্রনাথ বহুদিন ধরেই দেখে আসছেন সত্যি-মানুষের চলাচলের জগৎ। ‘ছড়ার ছবি’তে এসে তারা ঘটিয়ে বসল এক সাংঘাতিক কাণ্ড! নন্দলালের ছবি তাঁকে দিয়ে ৩২টি ছড়াই লিখিয়ে নিল না শুধু, সৃষ্টি করিয়ে নিল একরাশ সত্যি-মানুষ। ‘যারা লুকিয়ে ছিল কবির অভিজ্ঞতার তলদেশে, অবচেতনে, তারাই এখন ঝাঁকে ঝাঁকে জেগে উঠল ছড়ার প্রাকৃত ভাষার ডাঙায়, প্রায় বিস্ফোরণের বেগে।’ ‘ছড়ার ছবি’র মুখবন্ধে কবি লিখেছেন, ‘এই ছড়াগুলি ছেলেদের জন্যে লেখা।… ছেলেমেয়েরা অর্থ নিয়ে নালিশ করবে না, খেলা করবে ধ্বনি নিয়ে। ওরা অর্থলোভী জাত নয়।… ছড়ার ছন্দ প্রাকৃত ভাষার ছন্দ। এ ছন্দ মেয়েদের মেয়েলি আলাপ, ছেলেদের ছেলেমি প্রলাপের বাহনগিরি করে এসেছে। ভদ্রসমাজে সভাযোগ্য হবার কোনো খেয়াল এর মধ্যে নেই।’ ফলে ‘ছড়ার ছবি’তে আমরা পেয়ে গেলাম সত্যিকারের কালি-ঝুলি মাখা বাস্তব… ‘যারা অসতর্ক চালে ঘেঁষাঘেঁষি করে রাস্তায় চলে, যারা পদাতিক, যারা রথচক্রের মোটা চিহ্ন রেখে যায় না পথে পথে, যাদের হাটে মাঠে যাবার পায়ে-চলার-চিহ্ন ধুলোর উপর পড়ে আর লোপ পেয়ে যায়।’

নন্দলালের ছবি এভাবেই রবীন্দ্রনাথের ভিতরে জাগিয়ে দেয় এক প্রাকৃত রবীন্দ্রনাথকে। অথচ, এমন নয় যে, যেমনটি ছবিতে তার আক্ষরিক অনুবাদ ছড়াতে। পূর্ণেন্দু পত্রীর মতে, বরং দু’-পক্ষের যুগ্মতা থেকে পাঠক তৈরি করে নেওয়ার সুযোগ পাচ্ছেন অনুভূতির এক তৃতীয় স্তর। ‘পিস্‌নি’ নামের লেখাটিতে আছে–

‘অনেক গেছে ক্ষয় হয়ে তার, সবাই দিল ফাঁকি–
অল্প কিছু রয়েছে তার বাকি।
তাই দিয়ে সে তুললো বেঁধে ছোট্ট বোঝাটাকে,
জড়িয়ে কাঁথা আঁকড়ে নিল কাঁখে।
বাঁ হাতে এক ঝুলি আছে, ঝুলিয়ে নিয়ে চলে…’’

‘পিস্‌নি’-র সঙ্গের ছবি

অথচ আমরা ছবিতে দেখতে পাই, কাঁখের পুঁটলি ঠিক জায়গায় থাকলেও, বাঁ-হাতে ঝুলছে ঝুলির বদলে ঘটি, আর ডানহাতে সুতো-বাঁধা দু’খানা কুলো, যার উল্লেখ নেই ছড়ায়। এইখানে ছবি দেখে আর ছড়া পড়ে, পাঠকের অনুভূতিতে তৈরি হয় যে তৃতীয় স্তর– তা দিয়েই তাঁরা গড়ে নিতে পারেন জীয়ন্ত এক পিস্‌নিকে– ছড়া এবং ছবির সীমারেখায় ধরা পড়েছে যার প্রতিদিনের জীবনযাপন। অর্থাৎ, একটা দিনের পরিবর্তে পাঠক এখানে পেয়ে যাচ্ছেন নানা দিনের পিসনিকে।

‘বাসাবাড়ি’র ছবি

কালি-কলমের আর একটি অসামান্য স্কেচ ‘বাসাবাড়ি’। শিল্পীর স্বাক্ষরের নীচে স্পষ্ট লেখা ‘মণিকর্ণিকা ঘাট’, ছড়াকার সে পরিচয়কে আমল দেননি। এ ছবি তাঁর কাছে এক টুকরো শহর রাত্রিবেলার রহস্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। দিনের আলো যখন ফোটে, ‘দেনা-পাওনা জমতে থাকে, হিসাব হয় না সারা।’

‘অচলাবুড়ি’র ছবি

‘অচলাবুড়ি’ কালি-তুলিতে আঁকা। বুড়ি অচলা হলেও তার জীবন-বৃত্তান্তটি বেশ সচল। সেই এক জীবনের বৃত্তে আরও অনেকগুলি দুঃখী জীবনের না-আঁকা স্কেচ ভাষার তুলিতে রূপ নিয়েছে। ‘অচলাবুড়ি’র আরেকটি লাইন-ড্রয়িংয়ের স্কেচ আছে, তার পোষ্য কুকুরটির সঙ্গে। সে পাহাড়ি কুকুর। বুড়ির পোশাক এবং গলার মালাও সমতল মাটির পরিচয় বহন করে না।

‘শনির দশা’-র ছবি

‘শনির দশা’য় চিন্তিত-নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের মুখ লাইন ড্রয়িংয়ে এঁকে শিল্পীর মুক্তি। ছড়াকারের স্বীকারোক্তি সে আদায় করে নেয়, ‘মনে মনে আমি যে ওর মনের মধ্যে নাবছি।’… তখনই আরও একটা গল্পের ছবি পটে ফুটে ওঠে।

‘মাধো’ কবিতার মধ্যে আছে দু’টি ছবি। প্রথম ছবিটি ‘রায়বাহাদুর কিষনলালের স্যাকরা জগন্নাথ’ সপরিবারে। এটি কবিতার প্রথম ও মূল ছবি। ‘মাধো’ কবিতা রচনার প্রেরণা। কবিতার শেষে ছাপা হয়েছে দ্বিতীয় ছবি। যেখানে দেখি স্যাকরা-পুত্র মাধো, সপরিবার ভিন্ন পরিবেশে। প্রথম ছবিটি রবীন্দ্রনাথের কবিতার জনক আবার চক্রাকারে রবীন্দ্রনাথের কবিতা-শিল্পীকে দ্বিতীয় ছবি নির্মাণে উৎসাহিত করেছিল, যা অধিকতর উজ্জ্বল ও বৈশিষ্ট্যময়।

‘ছবি আঁকিয়ে’র সঙ্গে আছে দু’টি ছবি। এ কবিতার উদ্দিষ্ট শিল্পী নন্দলাল বসু স্বয়ং। প্রথম ছবি জুড়ে একটি গ্রামের দৃশ্য, এ ছবি জীবনের ছবি–

‘ছবি আঁকার মানুষ ওগো পথিক চিরকেলে,
চলছ তুমি আশেপাশে দৃষ্টির জাল ফেলে।’

দ্বিতীয় ছবির পট অধিকার করে আছে এক ‘ছাগল’। রবীন্দ্রনাথ একে ছাগাবতারের মর্যাদা দিয়েছেন, যার প্রসঙ্গ দিয়ে এ রচনার সূচনা।

শিল্পাচার্যের ‘ছড়ার ছবি’র চরিত্ররা প্রত্যেকে  মাটি-ঘেঁষা মানুষ। আটপৌরে এই ছবিগুলিতে ক্ষুরধার খুঁটিনাটি নেই, অথচ ভারি গতিময়! নন্দলালের ছবি বিষয়ে কবি অকপট, ‘আর্ট তাঁর (নন্দলালের) পক্ষে সজীব পদার্থ। তাকে তিনি স্পর্শ দিয়ে, দৃষ্টি দিয়ে, দরদ দিয়ে জানেন।’

নন্দলালের উদ্দেশ্যে লেখা রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতাটি মুদ্রিত হয় কবির তিরোধানের ক’মাস পরে, মাঘের ‘প্রবাসী’তে। নন্দলালের জন্য এই কবিতা কবি লিখেছিলেন ৩ ডিসেম্বর, ১৯৪০-এ অর্থাৎ কবির মৃত্যুর মাত্র মাস কয়েক পূর্বে। ‘প্রবাসী’তে কবিতাটির মুদ্রিত পাঠ এইরূপ–

‘কল্যাণীয় শ্রীযু্ক্ত নন্দলাল বসু…
রেখার রহস্য যেথা আগলিছে দ্বার
সে গোপন কক্ষে জানি জনম তোমার।
সেথা হতে রচিতেছ রূপের যে নীড়,
মরুপথশ্রান্ত সেথা করিতেছে ভীড়।।’

শিল্পীর জন্মদিনে এই চারটি ছত্র নন্দলালের প্রতি গুরু রবীন্দ্রনাথের শেষ এবং অশেষ আশিসমন্ত্র।

……………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন তনুরিমা ধর-এর অন্যান্য লেখা

……………………..