
জ্যোতি দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায় জরুরি অবস্থা কালে সরকার বিরোধী সম্পাদকীয় লেখার কারণে ‘কলকাতা’ কাগজের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর সম্পাদক হিসেবে তাঁকে সাতমাস জেলে বন্দি থাকতে হল সেবার। জেলে থাকাকালীন জ্যোতির মাথায় এসেছিল ডিঙি নৌকো নিয়ে সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পরিকল্পনা। এই সব কাণ্ডকারখানাই ঘটেছিল অমৃতবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার আগে।
শীতের এক রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে আমরা চলেছি ডায়মন্ড হারবার– চড়ুইভাতি করতে। সঙ্গী যাঁরা, তাঁরা প্রত্যেকে এইসব হুজুগে আনন্দলাভের বয়স পেরিয়েছেন অনেক আগেই। এই উদ্যোগের হোতা জ্যোতির্ময় দত্ত (Jyotirmoy Datta)। যাঁর মাথায় কিছু প্ল্যান এলে জ্যোতিকে রুধিবে কে? আর এই কারণেই আমার তিনি অত্যন্ত প্রিয় মানুষ। জ্যোতিদা তখন ‘অমৃতবাজার পত্রিকা’য় চাকুরিরত।
আমার স্বামী শংকর ঘোষ তখন এই পত্রিকার যুগ্ম সম্পাদক। সাংবাদিকতায় তাঁর সে-যুগে জুড়ি মেলা ভার ছিল। বেজায় গম্ভীর মানুষ। লেখাপড়া আর সাংবাদিকতাই ছিল তাঁর জীবনের ধ্যানজ্ঞান। অনুজ সাংবাদিকদের প্রতি স্নেহ এবং শাসন– দুই জারি থাকলেও এক প্রাচীরের মাঝখানে থাকা মানুষটির কাছে যাওয়া মোটেই সহজ ছিল না। সেই অসাধ্য কাজটি সম্পন্ন করেছিলেন জ্যোতি দত্ত। কীভাবে সেই প্রাচীর ভেঙে তাঁকে চড়ুইভাতিতে যেতে রাজি করিয়েছিলেন, সে ছিল আমার কাছে এক অত্যাশ্চর্য ব্যাপার।

প্রায় দিনই অফিস ফেরত স্বামীর মুখে জ্যোতির খামখেয়ালি, নানা রকম কাণ্ড কারখানার রিপোর্ট পাই আর বুঝি বরফ গলছে। কারণ আর কিছু নয়, সাংবাদিকতার যে কোনও দুরূহ কাজে জ্যোতির অনায়াস সাফল্যে শংকর ঘোষ এই অনুজ সহকর্মীটির প্রতি নিজের অজান্তেই স্নেহশীল হয়ে পড়েছিলেন। তবে অনেক সময়েই জ্যোতিদার খামখেয়ালিপনার মাশুল গুনতে হত যুগ্ম সম্পাদককেই। যেমন অমৃতবাজার পত্রিকার সম্পাদকীয় কলামেও জ্যোতির সপ্তাহে একদিন লেখার কথা। একবার এক কাণ্ড ঘটালেন জ্যোতি! নির্দিষ্ট দিনে সকাল থেকে জ্যোতির অফিসে পাত্তা নেই। ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোনের যুগ নয়। শুধু ল্যান্ডলাইনে ডায়াল লাগানো কালো ফোন ভরসা। সে ফোনেও পাওয়া গেল না জ্যোতিকে। অগত্যা যুগ্ম সম্পাদককেই সম্পাদকীয় লিখে অবস্থা সামাল দিতে হল। এই রকম নানা দুর্ঘটনা ঘটাতে জ্যোতিদাদার জুড়ি মেলা ভার ছিল। কিন্তু এসবের পরে তিনি যখন একটি অসাধারণ খবরের সূত্র নিয়ে হাজির হতেন তখন কিন্তু তাঁর সাত খুন মাপ! জ্যোতির আপনভোলা, মায়াময় ব্যক্তিত্ব এমনই যে কারও পক্ষেই বোধহয় ওঁর প্রতি রুষ্ট হয়ে থাকা সম্ভব ছিল না।
‘অমৃতবাজার পত্রিকা’ ও ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় জ্যোতিদার দু’টি কলাম প্রকাশ পেত। বাংলা কলামের নাম ছিল ‘কোমল ক্যাকটাস’ আর ইংরেজি কলামের নাম ‘প্রিকলি পিয়ার্স’। আমি ছিলাম সেই দু’টি কলামের একনিষ্ঠ পাঠক। তখনও কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার চাক্ষুষ আলাপ হয়নি। সেই যে কবি বলেছেন, ‘এখনো তারে চোখে দেখিনি, শুধু বাঁশি শুনেছি’। জ্যোতিদার সঙ্গে আলাপ হওয়ার আগেই আমার ওঁর স্ত্রী এবং বুদ্ধদেব বসুর জ্যেষ্ঠ কন্যা মিমিদি ওরফে মীনাক্ষী দত্তর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল যখন মিমিদি সাউথ পয়েন্ট স্কুলে যোগ দেন। আমি তার অনেক আগেই ওখানে পড়ানো শুরু করেছিলাম। মিমিদির কাছেও জ্যোতিদার নানা মজার কাহিনি শুনেছি। এভাবেই চিনেছিলাম জ্যোতিদাকে।
আমাদের সপ্তপর্ণী আবাসনের উল্টোদিকে থাকতেন অমৃতবাজার পত্রিকার অন্যতম প্রধান প্রতাপকুমার রায়। প্রায়ই সে বাড়িতে আমাদের নৈশভোজের আমন্ত্রণ থাকত। এরকমই এক ভোজের আসরে জ্যোতি দত্তর সঙ্গে প্রথম চাক্ষুষ পরিচয়। এরপর থেকেই জ্যোতি দত্ত হয়ে উঠেছিলেন আমার জ্যোতিদা। আর সেই দিন থেকে আমাকে উনি নাম ধরে ডাকা শুরু করেন।

জ্যোতিদাকে নিয়ে লিখতে বসলে শেষ করা মুশকিল। জ্যোতিদা জীবনে কী না করেছেন! ছায়াছবির নায়কের মতো বর্ণময় ওঁর জীবন। প্রেসিডেন্সি কলেজের উজ্জ্বল ছাত্র। কলকাতার ক্লাইভ স্ট্রিটে আপার ডিভিশন ক্লার্ক হিসেবে তিনি তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। আমেরিকা গিয়ে পিৎজা বানিয়েছেন, শিকাগো এবং আইওয়াতে গবেষণা-অধ্যাপনা করেছেন। শুধু কী তাই? তিনি নানা গুণের অধিকারী। তিনি একাধারে কবি, চিত্রকর এবং ভাস্কর। একবার ঘোড়দৌড় নিয়ে লিখতে গিয়ে তিনি শিখে ফেলেছিলেন অশ্ব-চালনা।। আর একবার মাথায় কী চাপল কে জানে! জ্যোতিদা শিখে ফেললেন গ্লাইডিং! গৌরকিশোর ঘোষের সঙ্গে অসমবয়সি বন্ধুত্বের কাহিনিও অনবদ্য। একবার আমেরিকায় মীনাক্ষীদির অনুপস্থিতে দু’জনে রান্নাঘরে না গিয়ে শুধু তরমুজ খেয়ে সানন্দে দু’দিন কাটিয়ে দিয়েছিলেন।
একবার জ্যোতিদার মাথায় এল গান্ধীবাদের খেয়াল। শুরু হল নিরামিষ খাওয়া এবং কলকাতার রাস্তায় খালি পায়ে চলা। বেশি দূর যেতে হলে ট্রামে উঠতেন তাও আবার সেকেন্ড ক্লাসে। অধুনালুপ্ত হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ডে যখন চাকরিতে ঢুকলেন, তখনও তিনি যেতেন খালি পায়ে। এ নিয়ে আপিসে সহকর্মীরা ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতেন, কিন্তু তা তিনি গায়ে মাখতেন না। একদিন খালি পায়ে আপিসে ঢুকছেন। কানে এল বরুণ সেনগুপ্ত কাকে যেন বলছেন, ‘এই যে খালিপদ এলেন’।
জ্যোতি দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায় জরুরি অবস্থা কালে সরকার বিরোধী সম্পাদকীয় লেখার কারণে ‘কলকাতা’ কাগজের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আর সম্পাদক হিসেবে তাঁকে সাতমাস জেলে বন্দি থাকতে হল সেবার। জেলে থাকাকালীন জ্যোতির মাথায় এসেছিল ডিঙি নৌকো নিয়ে সমুদ্রপথে শ্রীলঙ্কা যাওয়ার পরিকল্পনা। এই সব কাণ্ডকারখানাই ঘটেছিল অমৃতবাজার পত্রিকায় যোগ দেওয়ার আগে।
আজও মনে পড়ে সেই দিনটির কথা। আউটরাম ঘাটে আমরা। জ্যোতি চলেছেন নৌ-যাত্রায়। তিনি মুখ্য কাণ্ডারি। সঙ্গী দুই অনভিজ্ঞ সহযাত্রী– মায়া ও আজিজ। নৌকোর নাম রেখেছিলেন ‘মণিমেখলা’। যাত্রার প্রাক্কালে আমাদের গীতাদি (ঘটক) গান গেয়ে যাত্রার শুভ সূচনা করলেন। উপস্থিত শুভানুধ্যায়ীদের জয়ধ্বনির মধ্যে ডিঙি নৌকো পাল তুলে ভেসে গেল যেন কোন অচিন পানে।

আমি লক্ষ করলাম, শংকর ঘোষ মুখ গম্ভীর করে জলের দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি তো জানি প্রথম থেকেই এই ব্যাপার নিয়ে ওঁর কোনও আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আপিস যেহেতু জ্যোতির এই পরিকল্পনায় খানিকটা শরিক হয়েছেন এবং জ্যোতির অর্থকরী দিকটার কতকাংশে সামলে নিচ্ছেন– কাজেই এই ক্ষেত্রে শংকর ঘোষের মৌন থাকা ছাড়া অন্য কোনও উপায় ছিল না। জ্যোতিদের নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত বলে মনে হচ্ছিল শংকর ঘোষকে। তটভূমিতে না পৌঁছলে ওঁদের পক্ষে আপিসে কোনও খবর দেওয়া যে সম্ভব নয়, সে সম্বন্ধে শংকর তো বটেই, এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে প্রতাপ রায়ও প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। প্রথম ধাপে রায় সাহেব জ্যোতিকে মদত দিলেও এখন তিনিও অত্যন্ত চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন।
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পরে জ্যোতি একটি নৌকোর সন্ধানে ছিলেন। গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময়ে কাকদ্বীপ অঞ্চলে তিনি একটি অর্ধসমাপ্ত নৌকোর খোঁজ পান ও ২,০০০ টাকা দিয়ে সেটি কিনে ফেলেন। এর পরে শুরু হয় নৌকোটিকে সাগরযাত্রার উপযোগী করে তোলার কাজ। বইপত্র পড়ে নৌকোর একটি নকশাও তৈরি করে ফেলেন জ্যোতি। সিংহলী পুরাণে লেখা সমুদ্র দেবীর নাম অনুসারে তিনি নৌকার নাম রাখেন ‘মণিমেখলা’। দু’মাসের মধ্যে জ্যোতি নৌকো তৈরি করে ফেললেন। নৌকো চালানো দূরের কথা আকাশ থেকে পথনির্দেশ কীভাবে পাওয়া যায়, সে সম্বন্ধেও ওঁদের কোনও ধারণা পর্যন্ত ছিল না। অভিযানের কয়েক দিন আগে এক জাহাজের প্রাক্তন ক্যাপ্টেনের শিক্ষায়, তিন নাবিক নৌকো এবং তার চালনা সম্বন্ধে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করলেন। এর পরেই জ্যোতি দত্ত তাঁর পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির তদানীন্তন কর্মকর্তাদের। খবরের কাগজ বলেই বোধ হয়, এই ধরনের অবাস্তব পরিকল্পনার রোমাঞ্চকর দিকটার কথা ভেবেই হয়তো কোম্পানির মালিক রাজি হয়ে গেলেন।
জ্যোতির এই অভিযানের জন্য বরাদ্দ হয়েছিল ২০ হাজার টাকা। নৌকোর নিরাপত্তার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক জরুরি জিনিসের কথা জ্যোতির মনে পড়ল না। পরে, মনে পড়তে তড়িঘড়ি সেসব কেনা হল। নানা রকম রোমাঞ্চকর বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তিন নাবিককে। এক বিপদ থেকে রক্ষা পেলেও অন্য বিপদ আসে। এভাবেই চলতে থাকে সমুদ্রে ভেসে যাওয়া তিন নাবিকের দিনগুলি। কখনও তিমির চোখে পড়েন আবার কখনও হাঙরের। প্রতিবারই জ্যোতি এক অদ্ভুতভাবে বিপদ থেকে রক্ষা পেয়ে যান। ইতিমধ্যে ঝঞ্ঝা ইত্যাদিতে মণিমেখলা এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে, অভিযান পরিত্যক্ত হয়। কলকাতার আপিসে খবর এলে, সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন। প্রাণ নিয়ে নাবিকেরা ফিরে আসছে– এই সংবাদে ভারি আনন্দিত হয়ে ওঠেন। মণিমেখলাকে ফের চালু করে তিন নাবিক অক্ষত শরীরে কলকাতায় ফিরে এলে তাঁদের প্রায় বীরের সম্মান দিতে এত লোকের সমাগম হয় যে, প্রিন্সেপ ঘাটের পল্টুন জেটি প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। তাঁদের স্বাগত জানাতে ঘাটে সেদিন উপস্থিত ছিলেন সস্ত্রীক প্রতাপকুমার রায়, শংকর ঘোষ এবং অমিতাভ চৌধুরী প্রমুখ।

মিমিদির কাছে আমার গাড়ি চালানোর গল্প শুনে নাকি জ্যোতিদা একেবারে চমৎকৃত হয়েছিলেন। ওঁর লেখা ‘আমার নাই বা হল পারে যাওয়া’ গ্রন্থের প্রথম পাতায় রয়েছে জ্যোতিদার স্বাক্ষর-সহ স্নেহবার্তা– ‘আলপনাকে সস্নেহে, একা একা কলকাতার রাস্তায় গাড়ি চালানোর দুঃসাহসের জন্য সেলাম-সহ; জ্যোতিদা’। জ্যোতিদার লেখা দেখে চোখে জল আসছে আমার। ২৮ তারিখ সকালেই জ্যোতিদার প্রয়াণের খবর পেয়েছি। সেদিন আমার বই ‘অদূর অতীত’ সন্ধ্যাতে প্রকাশ পেয়েছে, যাতে আছে জ্যোতিদাকে নিয়ে ‘সংবাদ-শার্দূল’ নামাঙ্কিত একটি রচনা। ভেবেছিলাম, বই হাতে পেলেই নিজে গিয়ে হাতে তুলে দেব। সে সুযোগ দিলেন না। মিমিদি চলে যাওয়ার পরে কন্যা তিতিরের সাহচর্য ও যত্ন সত্ত্বেও বড্ড একা হয়ে গিয়েছিলেন জ্যোতিদা। আজ সেই একাকিত্বের অবসান ঘটল বোধ হয়।
আমার কাছে জ্যোতিদা চিরদিনই ছিলেন জীবনীশক্তিতে ভরপুর এক নবীন যুবক- বয়স এবং দৃষ্টিহীনতা যাঁকে কোনওভাবে পরাস্ত করতে পারেনি। আজ জ্যোতিদার সঙ্গে এক যুগের অবসান ঘটল। তাঁর সারা জীবনটাই ছায়াছবির দুর্ধর্ষ দুঃসাহসী নায়কের মতো রোমাঞ্চকর। ঘুমের মধ্যে জীবন থেকে নিষ্ক্রমণও ঘটল নায়কের মতোই। জ্যোতিদাকে এবার আমার শেষ সেলাম।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved