Robbar

স্বল্প আঁচড়ে গভীর দাগ কাটায় বিশ্বাস করতেন রমাপ্রসাদ বণিক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 27, 2025 9:38 pm
  • Updated:December 27, 2025 9:42 pm  

রমাপ্রসাদ বণিক আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন– ‘পৃথিবীতে মূর্খরাই তো মেজরিটি, তাই আমাদের থিয়েটার একটু কম পপুলার বলে হতাশ হবারও কোন প্রয়োজন আছে বলে অন্তত আমি মনে করি না।’ আসলে তাঁর আশঙ্কা এই যে, থিয়েটারকে পপুলার করতে গিয়ে আমরা যেন বুদ্ধিদীপ্ত থিয়েটারের সর্বনাশ না ঘটিয়ে ফেলি।

অনির্বাণ বাউল

ক্যাট আইজ, নিষ্পাপ হাসি ও লাজুক স্বভাবের বাচ্চা ছেলেটি একদিন মঞ্চে বিড়ালের অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছিল। সংলাপহীন। তার দাদা লিখছেন– ‘রমাপ্রসাদের তখন মাত্র ছয় বছর বয়স। শিশু রমাপ্রসাদ মূকাভিনয়ের জন্য প্রশংসিত হয়েছিল। কারণ, ওই বয়সে সে বিড়ালের মতো চালচলন লক্ষ করে অভিনয় করেছিল।’

রমাপ্রসাদ বণিক তখন সেন্ট লরেন্স হাইস্কুলের ছাত্র। সপরিবারে তাঁরা পার্কসার্কাস ট্রামডিপোর কাছে থাকতেন। চার ভাইবোনের মধ্যে রমাপ্রসাদই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। তাঁদের পাড়াতেই তখন একটা নাট্য সংস্থা ছিল– চিলড্রেন্স লিটল থিয়েটার (CLT), সেখানে ছোটদের নিয়ে মুখোশ-নাটকে অভিনয় করানো হত। তখন তাঁদের অভিনয় হত ‘বিশ্বরূপা’ থিয়েটারে। একবার কোনও কারণবশত ওই সংস্থার পরিচালক তাঁর কান মুলে দিয়েছিলেন। তারপর শত অনুরোধ সত্ত্বেও ছোট্ট রমাপ্রসাদকে সেই সংস্থায় আর পাঠানো যায়নি। সেই বয়সেও তাঁর আত্মসম্মানবোধ ছিল প্রখর।

রমাপ্রসাদ বণিক

এরপর ‘বহুরূপী’ নাট্যদলে রমাপ্রসাদ বণিকের পথচলা শুরু। থিয়েটারের হাতেখড়ি আচার্য শম্ভু মিত্রের কাছে। ১৯৬২ সালে ‘পুতুল খেলা’ নাটকে একটি ছোট্ট ছেলে ‘রন্টু’-র ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর জীবন, নাট্যচিন্তা ও প্রয়োগ পরিকল্পনায় যে ‘বহুরূপী’ নাট্যদলের প্রভাব রয়েছে তা তাঁর স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়। বহুদিন শম্ভু মিত্রের নির্দেশনায় তিনি কাজ দেখেছেন, শিখেছেন এবং প্রয়োজনে জেনেও নিয়েছেন। বড় হয়ে তৃপ্তি মিত্রের নির্দেশনায় অভিনয় করেছেন। ফলে তাঁর কাজের মধ্যে শম্ভু মিত্র ও তৃপ্তি মিত্র দু’জনের প্রভাবই রয়েছে। জীবনের প্রথম পর্যায়ে তিনি কুমার রায়, অমর গাঙ্গুলি, কালীপ্রসাদ ঘোষ প্রমুখ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ, তরুণ বয়সেই রমাপ্রসাদ হয়ে উঠেছিলেন থিয়েটারের একনিষ্ঠ কর্মী।

বাবা-মায়ের সঙ্গে শিশু রমাপ্রসাদ

একটা সময় ‘বহুরূপী’ থেকে বেরিয়ে এসে ‘চেনামুখ’ (১৯৮১) নাট্যদল তৈরি করলেন– অরিজিৎ গুহ, অনসূয়া মজুমদার ও সুব্রত মজুমদার প্রমুখ সঙ্গীদের নিয়ে। তাঁর নির্দেশনায় সেই দলের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনা ‘রাণী কাহিনী’ (১৯৮১)। এরপর ‘আগশুদ্ধি’ (১৯৮৩), ‘পাখি’ (১৯৮৬), ‘শরণাগত’ ও ‘ইচ্ছে গাড়ি’ (১৯৮৯) প্রভৃতি প্রযোজনার নির্দেশনার দায়িত্বেও ছিলেন। এই পর্যায়ে তাঁর নাট্যচিন্তার মধ্যে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রভাব লক্ষ করা যায়। অজিতেশও একসময় বলেছিলেন– ‘রমাপ্রসাদদের দেখলে এখন নতুন করে বাঁচতে ইচ্ছা করে।’

উৎপল দত্তের ‘চৈতালী রাতের স্বপ্ন’ (১৯৮৯) নাটকে ‘পাক’ চরিত্রে অভিনয় করে প্রশংসা পেয়েছিলেন রমাপ্রসাদ। নয়ের দশকের গোড়ার দিকে যাত্রা ও বাণিজ্যিক থিয়েটারে তিনি নিয়মিত নির্দেশনা করেছেন। পাশাপাশি টেলিভিশনে সিরিয়াল পরিচালনার কাজও করেছেন। ১৯৯১ সালে ‘থিয়েটার প্যাশন’ নাট্যদল তৈরি করেন এবং আমৃত্যু এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু জীবনের শেষ পর্যায়ে (২০০২-২০১০) বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি তিনি করেছিলেন– থিয়েটারের নবপ্রজন্মকে পথ দেখিয়েছিলেন। এই সময় ‘নেহরু চিলড্রেনস্ মিউজিয়াম’-এ তিনি নিয়মিত খুদে শিক্ষার্থীদের অভিনয়ের তালিম দিয়েছেন। সফলভাবে মঞ্চায়িত করেছেন দশটি মৌলিক নাটক। পাশাপাশি অন্য থিয়েটার, অযান্ত্রিক, পূর্ব-পশ্চিম, হাওড়া কদম, টাকী নাট্যম, বারাসাত অনুশীলনী ও তমলুক বহুব্রীহি ইত্যাদি কলকাতা ও অন্যান্য জেলার একাধিক নাট্য সংস্থার সঙ্গে নিরন্তর কাজ করেছেন।

কিন্তু আজকের প্রজন্মের কাছে, রমাপ্রসাদ বণিকের থিয়েটার তথা নাট্যচিন্তন কতটা প্রাসঙ্গিক? কারণ আজকের থিয়েটারের ভাষা, নাটকের আঙ্গিক ও প্রয়োগ-কৌশল সময়ের নিয়মে অনেকটাই বদলে গিয়েছে। রমাপ্রসাদ বণিক বিশ্বাস করতেন– “উদ্দেশ্যটা সম্পর্কে সচেতন না হলে ‘বিষয়’ নির্বাচন করাও কঠিন।” একটা সঠিক নাটকের ‘বিষয়’ খুঁজে বের করতে হলে তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং বোধের প্রয়োজন হয়। নাটকের ‘বিষয়’ যদি সঠিক হয়, তবে প্রযোজনার মান বৃদ্ধি পায় এবং উদ্দেশ্যকে অনেকটা গভীরে নিয়ে যেতে পারে।

নাটক নির্মাণের সময় রমাপ্রসাদ বণিক মূলত চারটি ক্ষেত্রের উপর নির্ভর করতেন– বিষয়-নির্বাচন, প্রয়োগ কৌশল, প্রযোজনার আঙ্গিক এবং অভিনয়। আজ যাঁরা থিয়েটার করতে আসছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই এই উদ্দেশ্যগুলো সম্পর্কে সঠিক কোনও ধারণা না নিয়েই চলে আসছেন। কথা বললে বোঝা যায়। কেউ হয়তো সমাজ পরিবর্তনের জন্য থিয়েটার করতে এসেছেন। আবার কেউ মনে করেন, সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য থিয়েটার করা প্রয়োজন। অনেকেই আছেন, যাঁরা কোনও উদ্দেশ্য ছাড়াই থিয়েটার করতে চান। কোনও ইচ্ছেকে ছোট না-করেই, মনে হয়, উদ্দেশ্যটা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না-থাকলে ‘বিষয়’-এর গভীরে যাওয়া সম্ভব নয়। নাটকের ‘বিষয়’ নাটকের চরিত্র নির্ণয় করে। নদীর স্রোত যেমন নদীর গতিপথ প্রবাহিত করে, ঠিক তেমনই নাটকের ‘বিষয়’ যদি বৃহত্তর সমস্যার কথা বলে, তবেই সেই নাটকের একটা সামগ্রিক চিত্র তৈরি হয়– যা মানুষের মনের গভীরে বোধের সৃষ্টি করে।

তা হলে নাটকে বিষয়ের পরিধি কতটা হওয়া উচিত? নাটকের বিষয়ের মধ্যে কী ধরনের সমস্যার কথা উঠে আসবে? অথবা নাটকের বিষয়ের মধ্যে যদি কোনও অনুসন্ধান বা বিশ্লেষণ থাকে, যা দর্শকের মনের মধ্যে প্রশ্ন তৈরি করতে পারে, তবে সেই নাটকের আবেদন দর্শকের মনের মধ্যে রেখাপাত করে। শুধুই দুর্বোধ্য বিষয় নয়, স্বল্প আঁচড়ে গভীর দাগ কাটাই স্রষ্টার কাজ। আবার নাটকের বিষয়ের মধ্যে নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত থাকাও বাঞ্ছনীয়। কারণ দর্শক নাটক দেখতে আসেন, গল্প শুনতে নয়। রমাপ্রসাদ বণিক সাধারণ বুদ্ধি-সম্পন্ন মানুষের জন্য নাটক নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন, যেখানে রয়েছে বিষয়ের গভীরতা ও সত্যের অন্বেষণ। তাঁর রচিত এবং নির্দেশিত ‘একলা পাগল’ (২০০৫) নাটকে উঠে এসেছে বাংলা ভাষার সংকটের কথা। আপাতদৃষ্টিতে এই নাটকের ‘বিষয়’ একটি খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে একজন বাংলার শিক্ষিকা ‘ভূমি-আন্টি’-র লড়াই মনে হলেও, নাটককার উদ্বিগ্ন হয়েছেন, যে আর ৫০ বছর পর বাঙালি বাংলায় কথা বলতে লজ্জা পাবে! অর্থাৎ, ‘বিষয়’ নির্বাচনের সময় উদ্দেশ্যটা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন।

পরিবারের সঙ্গে রমাপ্রসাদ বণিক

নাটকের নির্দেশনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। আমাদের থিয়েটারে অনেকেই আছেন পরীক্ষামূলক প্রযোজনার (Experimental Theatre) নামে অত্যন্ত ‘দামি’ নাটককেও বিকৃত করে তুলছেন। আমাদের সময়ের এমন অনেক নামী নাট্যদল রয়েছে যাঁরা ‘ওয়ার্কশপ প্রোডাকশন’-এর নামে বিভ্রান্তি তৈরি করছেন। কিছু বিশিষ্ট নাট্য পরিচালককেও বলতে শুনেছি, ‘একটু মজা করে’ কাজটা করলাম। শুধুই ‘মজা’ করা নয়, নাটকের প্রয়োগ পদ্ধতিতে থাকবে সৃষ্টির ‘আনন্দ’। অত্যন্ত সাধারণ নাটককে বা কোনও ছোটগল্পকে একজন ক্ষমতাবান পরিচালক একটি অসাধারণ প্রযোজনায় বা পূর্ণাঙ্গ নাটকে রূপান্তরিত করতে পারেন। যেমন রমাপ্রসাদ বণিককে দেখেছি ‘পূর্ব-পশ্চিম’ প্রযোজিত ‘পটল বাবু ফিল্মস্টার’-এ (২০০৯), সত্যজিৎ রায়ের একটা ছোটোগল্পকে পূর্ণাঙ্গ প্রযোজনায় রূপান্তরিত করতে। অর্থাৎ মূল্যবান বিষয় নিয়ে নাটক করতে হলে পরিচালকের ভাবনাটাকেও সমান মূল্যবান হতে হবে। 

কন্যার সঙ্গে রমাপ্রসাদ ও তাঁর স্ত্রী

ভালো প্রযোজনা কখনওই মানুষ ফিরিয়ে দেয় না। কিন্তু তাৎক্ষণিক আনন্দ দেওয়া আমাদের থিয়েটারের উদ্দেশ্য নয়। তাই আমরা থিয়েটারে যতই অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলি না কেন, আর অন্যদিকে আমরা যদি থিয়েটারে অশ্লীল শব্দের ব্যবহার করি– এই দুটোই একে অপরের পরিপন্থী। যা আমাদের থিয়েটারের সর্বনাশ করছে। নবপ্রজন্মের থিয়েটার কর্মীরা বুঝতে পারছেন না তাঁদের কী করা উচিত। তাৎক্ষণিক আনন্দ দিয়ে শুধুমাত্র মানুষকে ভুলিয়ে রাখাই আমাদের থিয়েটারের কাজ নয়। মহৎ উদ্দেশ্যের কথা মাথায় রেখেই থিয়েটার করতে হয়। এখন যদি কেউ প্রশ্ন করেন দর্শক না এলে নাটক মঞ্চস্থ করে কী হবে? প্রযোজনার গুণমান বাড়লেই দর্শকের সংখ্যা বাড়বে। যেভাবে একটা সময় বিভাস চক্রবর্তী, মেঘনাথ ভট্টাচার্য, দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রমাপ্রসাদ বণিক প্রমুখ নাট্যব্যক্তিত্বরা কাজ করে গেছেন, ঠিক সেভাবেই নাটকের নব প্রজন্মের কর্মীরা নিজেদের উদ্বুদ্ধ করবেন এঁদের পাথেয় করে।

ছেলেবেলায় ‘ডাকঘর’ নাটকের অভিনয়ে

এখনও আমাদের থিয়েটারে ‘এন্টারটেইনমেন্ট ভ্যালু’টাকে অনেকেই রপ্ত করতে পারেননি। প্রযোজনার প্রয়োগপদ্ধতিতে ও আঙ্গিকে দর্শককে আকৃষ্ট করতে পারলেই থিয়েটারে দর্শক ফিরে আসবে। কিন্তু শুধুমাত্র দর্শকের কথা মাথায় রেখে থিয়েটার করলেই চলবে না। রমাপ্রসাদ বণিক নির্দেশিত একাধিক প্রযোজনা দর্শকের মনের মধ্যে অনুরণন সৃষ্টি করতে পেরেছিল। চেনামুখের ‘ইচ্ছে গাড়ি’ (১৯৮৯), থিয়েটার প্যাশনের ‘ভ্যাবলাই ভালো’ (২০০৩), বারাসাত অনুশীলনীর ‘এক রসিক দৌবারিক’ (২০০৪), পূর্ব-পশ্চিমের ‘অংশুমতী’ (২০০৬), অযান্ত্রিকের ‘প্রথম পাঠ’ (২০০৬), অন্য থিয়েটারের ‘আছে আছে স্থান’ (২০০৮), টাকী নাট্যমের ‘গুড মর্নিং নিশিকান্ত’ (২০০৮), নেহরু চিলড্রেনস্ মিউজিয়ামের ‘লুক্সেমবার্গের লক্ষ্মী’ (২০০৯) ইত্যাদি প্রযোজনার কথা উল্লেখ করা যায়। 

নাটকের দক্ষ প্রয়োগকৌশল ও প্রযোজনার আঙ্গিকের সঙ্গে সঙ্গে, অভিনয়ের দিকটা যদি সবল না হয় তাহলে নাটকের গভীর বিষয়কেও দুর্বল মনে হতে পারে। আজকের বাংলা থিয়েটারে ভালো অভিনেতার সংখ্যা যে খুব বেশি এমন নয়। একটা সময় যেমন শম্ভু মিত্র, তৃপ্তি মিত্র, উৎপল দত্ত ও অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট অভিনেতাদের অভিনয় দেখার জন্য রঙ্গমঞ্চে দর্শক আসতেন। সেই ‘ক্রেজ’ আজকের থিয়েটারে কোথায়? এখন ব্যক্তিগত অভিনয়ের দক্ষতায় পেক্ষাগৃহে দর্শক আনার ক্ষমতা খুব কম অভিনেতারই রয়েছে। তাই ব্যক্তিগত অভিনয়ের দিন বোধহয় এখন শেষ হয়ে এসেছে। এই কারণেই দলগত অভিনয়, ভালো নাটক ও উৎকৃষ্ট মানের প্রয়োগ কৌশল আজকের থিয়েটারের একটা হাতিয়ার হতে পারে। এর সঙ্গে প্রয়োজন থিয়েটারের যোগ্য ‘শিক্ষক’ এবং নিয়মিত থিয়েটারের চর্চা। তবেই থিয়েটারের নবপ্রজন্ম নতুন করে ভাবতে পারবে এবং ভবিষ্যত-এর চারা গাছ বিকশিত হবে।

আটের দশকে ‘চেনামুখ’ পর্যায়ে নির্দেশক রমাপ্রসাদ বণিকের হাত ধরে একদল নতুন প্রতিভার উন্মেষ ঘটেছিল– অনসূয়া মজুমদার, খরাজ মুখোপাধ্যায়, চন্দন সেন, শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়, লাবণী সরকার, ইন্দ্রাশিস লাহিড়ী প্রমুখ। আবার এ প্রজন্মের বিভিন্ন নাট্যদল (‘কলকাতা রমরমা’, ‘যাদবপুর রম্যানী’ ও ‘সহজ’ ইত্যাদি) রমাপ্রসাদ বণিকের আদর্শকে সামনে রেখে থিয়েটার করছেন, এঁরা প্রায় সকলেই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে তাঁর ছাত্র-ছাত্রী। 

আমাদের থিয়েটারের একটি প্রধান প্রতিবন্ধকতা হল আর্থিক সমস্যা। যাঁরা নতুন থিয়েটার করতে আসছেন তাঁদের কাছে চলার পথটা মসৃণ নয়। গ্রুপ থিয়েটারকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। থিয়েটারের ‘হোল-টাইমার’ (পুরো সময়ের জন্য যাঁরা থিয়েটারের কাজ করবেন) তৈরি করতে হবে। যাঁরা থিয়েটার নিয়ে সর্বক্ষণ ভাবতে পারবেন এবং নতুন উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে থিয়েটারকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। একজন প্রতিভাবান থিয়েটার-কর্মীকে বিকল্প জীবিকার উদ্দেশ্যে চাকরি করতে হয়, সিরিয়ালে অভিনয় করতে হয় বা বিজ্ঞাপনের অফিসে কাজ করতে হয়। ফলে কোথাও গিয়ে থিয়েটারের সামগ্রিক বিকাশের পথে জীবিকাই পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ শুধুই শখের থিয়েটার চর্চা করে লাভ নেই। থিয়েটার করেই যদি আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায়, তবেই ভবিষ্যতের থিয়েটার শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকবে। 

আবার, অনেকেই মনে করেন থিয়েটারকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য দর্শকের কথা মাথায় রেখে প্রযোজনা তৈরি করা উচিত। তবে একথা মনে রাখতে হবে, অযোগ্য মানুষের হাতে শিল্পের দায়িত্ব চলে গেলে তার শেষ রক্ষা করা সম্ভব নয়। প্রসঙ্গত, রমাপ্রসাদ বণিক আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন– ‘পৃথিবীতে মূর্খরাই তো মেজরিটি, তাই আমাদের থিয়েটার একটু কম পপুলার বলে হতাশ হবারও কোন প্রয়োজন আছে বলে অন্তত আমি মনে করি না।’ আসলে তাঁর আশঙ্কা এই যে, থিয়েটারকে পপুলার করতে গিয়ে আমরা যেন বুদ্ধিদীপ্ত থিয়েটারের সর্বনাশ না ঘটিয়ে ফেলি। কিন্তু, এইভাবে আর কতদিন আমাদের থিয়েটার বেঁচে থাকবে? মুষ্টিমেয় কিছু থিয়েটার কর্মীর অঙ্গীকার ও ‘আর্থিক লোকসান’– এই থিয়েটার আর কতদিন বহন করবে? কী করবে থিয়েটারের নবপ্রজন্ম? এই কারণেই বোধহয় রমাপ্রসাদ বণিক জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে ‘নেহরু চিলড্রেনস্ মিউজিয়াম’-এ থিয়েটারের নবপ্রজন্মকে তৈরি করতে চেয়েছিলেন। ছোট ছেলেমেয়েগুলোর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন– ‘ওদের বুকের ভিতর বারুদ আছে, বোধের আগুনটুকু জ্বালিয়ে দেওয়া আমাদের কাজ।’