গুরু অবনীন্দ্রনাথের মতো কঠিন স্বরে নন্দলাল বসু কখনও বলেন না যে, সবাইকে শিল্পের পাঠ দেওয়া যায় না। ‘আমড়া গাছকে আম গাছ করার চেষ্টা’ করা বৃথা। ছাত্রের মনের গভীরে ঘা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন তার ভিতরে থাকা সেই নিদ্রিত চিত্রীকে। তাঁর শিল্পশিক্ষার গোড়ার কথা হল– চিত্তের এই উদ্বোধন।
ব্যক্তিমানুষের চেয়ে কখনও-বা তাঁর বিশেষণ আমাদের কাছে বড় হয়ে দেখা দেয়। তাঁর প্রতি সম্ভাষণ বয়ে আনে এক স্বতন্ত্র অর্থ। তবে অকস্মাৎ এমনটা ঘটে না, এর আড়ালে জড়িয়ে থাকে সম্বোধিত মানুষটির সারা জীবনের তপস্যা। ‘মহাত্মা’ বলতে আমরা যে বুঝি গান্ধীজিকে, সে কি এমনিই? আবার ‘নেতাজি’র কথায় চকিতে ভেসে ওঠে সুভাষচন্দ্রর দৃপ্ত মুখমণ্ডল। অন্যদিকে ‘গুরুদেব’ অর্থে তো কোনও জটাজুটধারী সন্ন্যাসী নন– আজও সামনে এসে দাঁড়ান আমাদের আশ্রয়, ‘দুঃখদিনের রক্তকমল’ হাতে সেই রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু ‘মাস্টারমশাই’– এই সম্বোধনে এক লহমায় আমরা কাকে চিনতে পারি, তিনি কি ছড়ি হাতে কড়া ধাতের এক পণ্ডিতমশাই? না। ‘মাস্টারমশাই’ বলতে যাঁর সামনে বিনম্র দাঁড়াতে চাই, তিনি শিল্পী নন্দলাল বসু। ছাত্রদের তিনি শুধু চিত্রকলার পাঠ দেন না, কেবল বুঝিয়ে দেন না ছবির পটে টেনে দেওয়া রঙের রহস্য। ছবির মধ্য দিয়ে তিনি শিখিয়ে দেন জীবনের শিক্ষা। স্নেহশীল অভিভাবকের মতো পরম স্নেহে আগলে রাখেন তাঁর ছাত্রদের। ছাত্রদের মনের গহন থেকে টেনে নিয়ে আসেন তাদের শিল্পীসত্তার বীজ। তাই কী এক আশ্চর্য ম্যাজিকে ‘মাস্টারমশাই’ শব্দটিকে স্মরণ করতেই তাঁর ছাত্ররা আবেগবিহ্বল হয়ে ওঠে।
না, গুরু অবনীন্দ্রনাথের মতো কঠিন স্বরে তিনি কখনও বলেন না যে, সবাইকে শিল্পের পাঠ দেওয়া যায় না। ‘আমড়া গাছকে আম গাছ করার চেষ্টা’ করা বৃথা। গুরুর বিপরীত পথে হেঁটে নন্দলাল ছাত্রের মনের গভীরে ঘা দিয়ে জাগিয়ে তোলেন তার ভিতরে থাকা সেই নিদ্রিত চিত্রীকে। তাঁর শিল্পশিক্ষার গোড়ার কথা হল– চিত্তের এই উদ্বোধন। জাপানি ভাবুক ওকাকুরা কাকুজোর কাছে তিনি একদা জেনেছিলেন শিল্পের সার কথাটুকু। ওকাকুরার মতে, প্রকৃত শিল্প দাঁড়িয়ে থাকে তিনটি উপাদানের ওপর। এগুলি যথাক্রমে ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য, নেচার বা প্রকৃতি এবং ওরিজিনালিটি, অর্থাৎ স্বকীয়তা। নন্দলালের শিল্পভাবনা এই একই সুরে গাঁথা হয়েছিল। তিনিও বিশ্বাস করতেন ঐতিহ্য বা পরম্পরা, প্রকৃতি আর সৃজনশীলতার মধ্যেই ধরা আছে শিল্পের প্রাণের মহিমা– তার প্রাণভোমরা। কথাগুলি আজীবন তাঁর ছাত্রদের স্মরণ করিয়েছেন, তাদের মনে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন এই বোধ। সেই জাপানি ভাবুকের বিধৃত শিল্প-আদর্শকে তিনি আরও খোলসা করে ভেঙে বলেছেন, ‘যেখানে ট্র্যাডিশন নেই, আছে শুধু নেচার আর ওরিজিনালিটি, সে শিল্প সব সময়েই যেন শৈশবে থাকে, তার একটা অতীতের ভিত্তি থাকে না… আবার যেখানে নেচার নেই, শুধু ট্র্যাডিশন আর ওরিজিনালিটি আছে, সেখানে শিল্পের মধ্যে তাজা প্রাণ থাকে না’।
আজকের এই দিনে ছাত্র নন্দলাল আর তাঁর গুরু অবন ঠাকুরের বিষয়ে একটা গল্প না বললেই নয়। নন্দলাল তখনও শান্তিনিকেতনে আসেননি, কলকাতায় থাকেন। ‘উমা’ শিরোনামে একটা বড় ছবি সদ্য শেষ করে জোড়াসাঁকোয় গুরু অবনীন্দ্রনাথকে দেখাতে নিয়ে এসেছেন। গুরু ছবিটির যথেষ্ট প্রশংসা করেও বললেন, ‘ছবিটায় যে একেবারে রং নেই’। নন্দলাল বেশ চিন্তিত, কারণ তিনি সচেতনভাবেই এই ছবিতে রঙের উজ্জ্বলতা পরিহার করেছেন। তবুও গুরু বলেছেন, পরদিন সকালে কিছু রং নিয়ে ছবির সামনে বসেছেন– ভাবছেন, কোথায় কী রং লাগাবেন। এমন সময় বাড়ির দরজার সামনে কার যেন মোটর গাড়ির শব্দ শোনা গেল, আর তারপরেই অবনীন্দ্রনাথের উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর! ‘নন্দলাল, নন্দলাল’ বলে দ্রুত ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন অবন ঠাকুর। দ্যাখেন, শিষ্য ছবির সামনে স্থির হয়ে বসে আছেন। ছবিতে রঙের ছোঁয়া তখনও লাগেনি। ব্যস্ত হয়ে গুরু বলে উঠলেন, ‘গতকাল বিকেলে তোমায় বলেছিলাম, উমার ছবিতে কোনও রং নেই বলে। তুমি চলে যাওয়ার পর ভেবে দেখলাম, তখন বুঝতে পারলাম। তোমার উমার তো কোনও বাইরের রঙের প্রয়োজন নেই, উমা যে তপস্বিনী। সমস্ত রাত এই ভাবনায় ঘুমোতে পারিনি, ভয় হচ্ছিল যদি কোনও রং ছবিটায় লাগিয়ে ফেলো। যা হোক, রক্ষে, তুমি যে ছবিটায় রং লাগাওনি। এত ভোরে ছুটে এলাম তোমাকে রং লাগাতে বারণ করব বলে।’
কী আশ্চর্য, এই তো সত্যিকার শিক্ষক। যিনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে দৌড়ে এসেছেন ছাত্রের দরজায়, কবুল করছেন তাঁর নিজের ভুল। এমন নজির কি আজকে সহজে আমাদের চোখে পড়ে? আর সেই ছাত্র, সে কী ভাবলেন গুরুর কথা শুনে! নন্দলাল খুশি হলেও গুরুর নির্দেশকে মান্যতা দিয়েছিলেন। কিন্তু কীভাবে দিয়েছিলেন গুরুবাক্যের মান্যতা? গুরুবাক্য রক্ষা করতে তিনি উমার হাতের আঙুলে পরিয়ে দিলেন এক হালকা সবুজ ঘাসের আংটি। সেই অঙ্গুরীয়ের মৃদু সবুজ আভায় ভরে উঠল তপস্বিনী উমার হাতের আঙুল। গুরু-শিষ্যের এই ঘটনা আজকের দিনে রূপকথার মতো শোনায়। আজকের দিনে এই দুই শিক্ষকের প্রতি আমাদের নীরব প্রণতি জানিয়ে রাখি।