Robbar

ভূতের গল্পের জং ধরা ছায়ায় শেতাঙ্গ রাজনীতির ঝলক

Published by: Robbar Digital
  • Posted:September 13, 2024 3:53 pm
  • Updated:September 13, 2024 3:53 pm  

লি ড্যানিয়েলসের যেকোনও ছবির মূল্যবান দিক তার অভিনয়। ‘দ্য ডেলিভারেন্স’ ব্যতিক্রম নয়। ইবোনি-র চরিত্রে আন্দ্রা ডে কিংবা সিন্থিয়া-র চরিত্রে মনিক নজরকাড়া। কিন্তু দর্শকের ভালো লাগার সবটা নিজের দিকে কেড়ে রাখেন অ্যালবার্টা জ্যাকসনের চরিত্রে অভিনয় করা গ্লেন ক্লোজ। তাঁর চাউনি, তাঁর ছেনালি, কেমোথেরাপিতে তাঁর চুল উঠে যাওয়া মাথায় বার বার ‘উইগ’ পরার মুহূর্ত, কমবয়সি এক কৃষ্ণাঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর শরীরী-প্রেম- এক কথায় অনবদ্য। গ্লেন ক্লোজ যে কত বিরাট মাপের অভিনেত্রী, তা উপলব্ধি হয় সেই দৃশ্যে যখন তিনি কালো বাইবেলটা হাতে করে ‘ডিমন’-এর মুখোমুখি হবেন, এদিকে সেই ‘ডিমন’ তাঁর নাতি ড্রে-কে ভর করেছে।

ভাস্কর মজুমদার

‘প্রতিনিধিত্ব’ একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বীক্ষা। সামাজিক সমস্ত পরিসরে সকল রকম মানুষের অংশগ্রহণ থাকবে– আদর্শগতভাবে সেটাই কাম্য। সেই সঙ্গে শিল্প, সাহিত্য, সিনেমা, খেলা– কোনওটাই একটি গোষ্ঠী প্রভাবিত করবে, তা বাঞ্ছনীয় নয়। কিন্তু বাস্তবে হয় এর উল্টো। সবদিকে একটি ধরনের শ্রেণির আধিপত্য চোখে পড়ে। ইউরোপ-আমেরিকাতে আরও প্রকটভাবে। যেমন ধরা যাক, সিনেমা।

২০০২ সালে হ্যালে বেরি, ডেঞ্জেল ওয়াশিংটন আর সিডনি পয়টারের অস্কার বিজয়ের পর দর্শকের প্রথম উপলব্ধি হয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরাও অস্কার পেতে পারে, যেখানে আমেরিকান সিনেমার প্রথম লগ্ন থেকেই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষেরা উপস্থিত! তারও বহু বছর পর ‘মুনলাইট’ (২০১৬) শ্রেষ্ঠ ছবির অস্কার পেল যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ জীবন ও সমকামিতার কথা বিধৃত।

Moonlight ความลับของสองเราในคืนเหงาที่มีดวงจันทร์เป็นพยาน
সিনেমা: মুনলাইট

এখন আমেরিকার সিনেমা পরিসরে সাদা চামড়ার ভিড়ে কৃষ্ণাঙ্গ জীবনের কথা খানিকটা করে বলা শুরু হয়েছে। স্পাইক লি যেখানে একটি মাত্র নাম ছিলেন বহু দশক আলোচিত কৃষ্ণাঙ্গ সিনেমানির্মাতা হিসেবে, সেখানে এখন আভা দ্যুভার্নে, স্টিভ ম্যাকুইন, ব্যারি জেনকিন্স, জর্ডন পিলি-দের ছবি নিয়ে বহু আলোচনা হচ্ছে। এঁদের মধ্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নাম লি ড্যানিয়েলস। ২০০৯ সালে ‘প্রিসিয়াস’ সিনেমা দিয়ে তিনি জাত চিনিয়ে ছিলেন।

Precious: Based on the Novel "Push" by Sapphire | Rotten Tomatoes
‘প্রিসিয়াস’ (২০০৯) সিনেমার পোস্টার

আমেরিকার মতো মহাদেশে কৃষ্ণাঙ্গ, নারী কিংবা যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের কী দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার এক গুরুত্বপূর্ণ (এবং এখন প্রায় ঐতিহাসিক) দলিল– ‘প্রিশিয়স’। লি-এর সিনেমা নির্মাণের কৌশল মোটের ওপর বাস্তবোচিত, মাটির কাছাকাছি এবং খানিকটা ডকুমেন্টারির প্রকরণ ধার নেওয়া। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক ‘দ্য ডেলিভারেন্স’ ছবিটি, যা নেটফ্লিক্সে হাজির হয়েছে সদ্য, তাতে যেন মনে হচ্ছে লি নতুন পথের সন্ধান শুরু করেছেন। এবারে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বন’ করে তিনি একেবারে একটা ভূতের গল্প ফেঁদেছেন। কী সেই কাহিনি?

The Deliverance (2024) – Plot & Trailer | Netflix Horror Movie | Heaven of Horror
নেটফ্লিক্সে সদ্য প্রকাশিত ‘দ্য ডেলিভারেন্স’

তিন সন্তান– নেট, শান্টে আর ড্রে-এর জননী ইবোনি জ্যাকসন নতুন একটি বাড়িতে ভাড়া এসেছেন। স্বামীর সঙ্গে তার সম্পর্ক প্রায় ছিন্ন হয়ে গেছে এবং আদালত তার স্বামীকেই সন্তান প্রতিপালনের দায়িত্ব দিতে আগ্রহী কারণ ইবোনি-র মত্ততা ও হিংসার ইতিহাস আছে। তবু ইবোনি-র অনুনয়ে বাচ্চারা তার কাছে থাকে কিন্তু চাইল্ড প্রটেক্টিভ সার্ভিসেস থেকে সিন্থিয়া নামক একজনকে নিযুক্ত করা হয়েছে। এখন ইবোনি ও তাঁর তিন সন্তানের সঙ্গে একই বাড়িতে বাস করছেন ইবোনি-র শ্বেতাঙ্গ মা অ্যালবার্টা। অ্যালবার্টা সদ্য খ্রিস্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। তিনি ক্যানসার আক্রান্ত। মেয়ে ইবোনি-র সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায় হলেও ইবোনি মায়ের অজান্তেই তাঁর চিকিৎসার অনেকটা খরচ বহন করে। নাতিনাতনিদের সঙ্গে অ্যালবার্টার সম্পর্ক ভালো। কিন্তু মুশকিল হল নতুন বাড়িটি যেন তাঁদের কারও মনঃপূত হচ্ছে না।

33 Facts about Lee Daniels - Facts.net
পরিচালক লি ড্যানিয়েলস

বাড়ির বেসমেন্ট থেকে দুর্গন্ধ ছাড়ে আর তিন সন্তানের একেবারে ছোটটি অর্থাৎ ড্রে ওই বেসমেন্টে বার বার যায় এবং অদ্ভুত ব্যবহার করে। কাহিনি খুবই চেনা ছকে গড়িয়ে চলে। ইংরেজি সিনেমায় ‘ভূতের গল্প’ যেমন হয়, সেই ‘একজর্সিস্ট’ সিনেমার সময় থেকে আজ অবধি সেই ডিমন (দৈত্য) ভর করা এবং তা থেকে খ্রিস্টীয়-দৈব উপায়ে পরিত্রাণ পাওয়া– সেই ধারাই ‘দ্য ডেলিভারেন্স’-এ বজায় থেকেছে। কিন্তু লি ড্যানিয়েলস– ‘শ্যাডো বক্সার’, ‘দ্য পেপারবয়’, ‘প্রিসিয়াস’, ‘দ্য বাটলার’, ‘ইউনাইটেড স্টেটস ভার্সেস বিলি হলিডে’-এর পরিচালক লি ড্যানিয়েলস (এমনকী হ্যালি বেরি যে ছবির জন্য অস্কার পেয়েছিলেন সেই ‘মন্সটার্স বল’-এর প্রযোজক ছিলেন লি) কী করে এমন একটা অতি-ব্যবহৃত, ক্লিশে কাহিনি কাঠামো বেছে নেন? তবে কী জনপ্রিয়তার মোহে পড়েছেন পরিচালক? ঠিক তা নয়।

……………………………………………………..

আমেরিকার মতো মহাদেশে কৃষ্ণাঙ্গ, নারী কিংবা যৌনসংখ্যালঘু মানুষদের কী দুরবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, তার এক গুরুত্বপূর্ণ (এবং এখন প্রায় ঐতিহাসিক) দলিল– ‘প্রিসিয়াস’। লি-এর সিনেমা নির্মাণের কৌশল মোটের ওপর বাস্তবোচিত, মাটির কাছাকাছি এবং খানিকটা ডকুমেন্টারির প্রকরণ ধার নেওয়া। কিন্তু তাঁর সাম্প্রতিক ‘দ্য ডেলিভারেন্স’ ছবিটি, যা নেটফ্লিক্সে হাজির হয়েছে সদ্য, তাতে যেন মনে হচ্ছে লি নতুন পথের সন্ধান শুরু করেছেন। এবারে ‘সত্য ঘটনা অবলম্বন’ করে তিনি একেবারে একটা ভূতের গল্প ফেঁদেছেন।

……………………………………………………..

আসলে ওই যে প্রতিনিধিত্ব-র আদর্শ যা কোনও দিন বাস্তবায়িত হয় না, সেই আবহে সংখ্যালঘুর কথা বলতে গেলে অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের জনপ্রিয় পথ গ্রহণ করতে হয়। লি ড্যানিয়েলসও তাই করেছেন। এ-নির্মাণের গভীরে প্রবেশ করলে উপলব্ধি হয় ওই যে বলছে ‘ডিমন’ নাকি দুর্বলতাতে, নোংরাতে ভর করে তাতে স্পষ্ট হয় কৃষ্ণাঙ্গ জীবনে ঘৃণার প্রভাব। অ্যালবার্টা ছিলেন বহুপুরুষগামী। বিশেষত কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ। ইবোনি-র পিতা কে, তা অ্যালবার্টাও জানে না। ইবোনি-র শৈশব চরম অত্যাচারিতের শৈশব। একেকদিন একেক জন সঙ্গী অ্যালবার্টার জীবনে প্রবেশ করত। এমনই একজন পুরুষ ইবোনিকে ধর্ষণ করে। সেই ভয় থেকে ইবোনি কখনও মুক্তি পায়নি।

Review: 'The Deliverance' is a dramatic telling of a true story - The Eastern Echo
‘দ্য ডেলিভারেন্স’ সিনেমায় ইবোনি চরিত্রে অভিনেত্রী আন্দ্রা ডে

অন্য দিক থেকে দেখলে এ-ও বুঝতে অসুবিধা হয় না এই যে অ্যালবার্টার যৌনস্বাধীনতা (কিংবা সেক্ষেত্রে যে-কোনও নারীর যৌনস্বাধীনতাই) তা কী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ সহজে গ্রহণ করতে পারে? পারে না। স্বাধীন-নারী যেন ‘নষ্টা’। স্বাধীন বিশেষত যৌনস্বাধীন নারী যেন পরিশেষে পুরুষতন্ত্রের হাতে ক্রীড়নক। তাই এই যে অ্যালবার্টার খ্রিস্টধর্মে দীক্ষা, তা যেন শুদ্ধ হতে। এমনকী, ইবোনি যে ‘ডিমন’-কে শেষাবধি প্রতিহত করতে পারছে তাও যেন সে মনে মনে খ্রিস্টধর্মের অনুসারী হয়েছে বলেই!

………………………………………………………

আরও পড়ুন ভাস্কর মজুমদার-এর লেখা: অত্যাচারী এবং অত্যাচারিত, দু’জনের প্রতিই মায়াভরা বিশ্লেষণ

………………………………………………………

লি ড্যানিয়েলসের যেকোনও ছবির মূল্যবান দিক তার অভিনয়। ‘দ্য ডেলিভারেন্স’ ব্যতিক্রম নয়। ইবোনি-র চরিত্রে আন্দ্রা ডে কিংবা সিন্থিয়া-র চরিত্রে মনিক নজরকাড়া। কিন্তু দর্শকের ভালো লাগার সবটা নিজের দিকে কেড়ে রাখেন অ্যালবার্টা জ্যাকসনের চরিত্রে অভিনয় করা গ্লেন ক্লোজ। তাঁর চাউনি, তাঁর ছেনালি, কেমোথেরাপিতে তাঁর চুল উঠে যাওয়া মাথায় বার বার ‘উইগ’ পরার মুহূর্ত, কমবয়সি এক কৃষ্ণাঙ্গ ডাক্তারের সঙ্গে তাঁর শরীরী-প্রেম- এক কথায় অনবদ্য। গ্লেন ক্লোজ যে কত বিরাট মাপের অভিনেত্রী, তা উপলব্ধি হয় সেই দৃশ্যে যখন তিনি কালো বাইবেলটা হাতে করে ‘ডিমন’-এর মুখোমুখি হবেন, এদিকে সেই ‘ডিমন’ তাঁর নাতি ড্রে-কে ভর করেছে। সেই অভিব্যক্তি ভোলার নয়।

Glenn Close in the Deliverance
অ্যালবার্টা চরিত্রে গ্লেন ক্লোজ

যে তথাকথিত সত্য ঘটনা অবলম্বন করে লি ড্যানিয়েলস ‘দ্য ডেলিভারেন্স’ নির্মাণ করেছেন, সেই ঘটনায় গ্লেন ক্লোজ অভিনীত চরিত্রটি ছিল না। অর্থাৎ লি জেনে বুঝেই এমন একটি চরিত্র নির্মাণ করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের জীবনযুদ্ধ বিধৃত করা পরিচালক তবে শ্বেতাঙ্গ রাজনীতির কয়েক ঝলক তাঁর এবারের নির্মাণে রাখলেন। কিন্তু নিছক ভূতের গল্পের জং-ধরা ছায়াতে কীভাবে আরও অনেক গল্পের কথা বলা যায়, তা লি ড্যানিয়েলস তাঁর ‘দ্য ডেলিভারেন্স’ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। ঋদ্ধ হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নেই।

………………………………………..

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন

………………………………………..