ইরানিয়ান নারীদের আন্দোলন কিন্তু নতুন নয়। ১৯১০ সাল থেকেই ইরানিয়ান নারীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে লড়ছেন। ১৯৬৩ সালে আদায় করে নেয় ভোটাধিকার। অন্তর্বাস পরে হেঁটে যাওয়া মেয়েটির নাম আহু দরিয়াই। আহুর প্রতিবাদ অবশ্যই কুর্ণিশ জানানোর যোগ্য। শাসক ও শোষকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিশ্চিত শাস্তি জেনেও তিনি তাঁর প্রতিবাদ থেকে দূরে সরে যাননি। কিন্তু প্রশ্ন হল, গোটা পশ্চিমী মিডিয়া থেকে ভারত আহু দরিয়াইকে কুর্নিশ জানালেও তারা কেন চুপ গত একবছর থেকে চলা প্যালেস্টাইনের গণহত্যা নিয়ে। নারীবাদীর পাঠ শেখানো পশ্চিমী দুনিয়ার সিলেকটিভ ফেমিনিস্টদের প্রশ্ন করার সময় এসেছে এবার। গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
অন্তর্বাস পরে মাথা উচুঁ করে হেঁটে যাচ্ছে একটি নারী। কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করেই। না, এটা কোনও সমুদ্র সৈকতের ঘটনা নয়। এটা ইসলামিক দেশ ইরানের ঘটনা। যে দেশে মাথায় হিজাব না পরলে মাহসা আমিনি হতে হয়। হ্যাঁ, সেই মাহসা আমিনি, যাঁকে ২০২২ সালে ইরানের নীতিপুলিশ গ্রেপ্তার করে ও পুলিশি হেফাজতে থাকাকালীন যাঁর মৃত্যু হয়। এবং যাঁর মৃত্যুর প্রতিবাদে আমরা দেখেছি নারী জীবন আজাদি-র প্রশ্নে তীব্র আন্দোলন। অন্তর্বাস পরে হেঁটে চলা এই নারীর হাঁটা তাই সাধারণ কোনও হেঁটে চলা নয়। এই হাঁটা মুক্তির পথে, নিশ্চিত মৃত্যু কিংবা কারাবাস জেনেও। আমরা জানি না এর পরে সেই নারীর জন্য কী অপেক্ষা করছে। শেষ খবর পাওয়া অবধি ইরানিয়ান পুলিশ জানিয়েছে মেয়েটির মাথা খারাপ। অবশ্য যে নারী চেনা ছকের বাইরে, যাঁকে রোজকার নিক্তি দিয়ে মাপা যায় না, যাঁর জিভের অস্তিত্ব সমাজ টের পায়, যাঁকে খাঁচায় বেঁধে রাখা যায় না, তাঁকে বা তাঁদের হয় ‘পাগল’ না হয় ‘ডাইনি’ সন্দেহে পাগলা গারদে পুরে দেওয়া হয় বা পিটিয়ে মারা হয়। ইরান থেকে ভারত– সবজায়গার নীতিপুলিশের একই অবস্থান। পার্থক্য কোথাও নীতিপুলিশ রাষ্ট্রের দ্বারা সরাসরি নিযুক্ত আর কোথাও রাষ্ট্র তার নিজস্ব নীতি নির্ধারণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে ঘুরপথে নীতিপুলিশের সৃষ্টি করে। তাই আমাদেরই দেশ যোগীর রাজ্যে ‘রোমিও স্কোয়াড’ তৈরি করে লাভ জিহাদের নামে মহিলাদের পছন্দের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা কোনও নীতিপুলিশের হস্তক্ষেপের থেকে কম নয়। এই বছরের জুলাইয়ের খবর, লাভ জিহাদ আইনের আরও কঠিন পরিবর্তন আনতে চলেছে যোগী সরকার।
তবে ইরানিয়ান নারীদের আন্দোলন কিন্তু নতুন নয়। ১৯১০ সাল থেকেই ইরানিয়ান নারীরা নিজেদের অধিকার নিয়ে লড়ছেন। ১৯৬৩ সালে আদায় করে নেয় ভোটাধিকার। অন্তর্বাস পরে হেঁটে যাওয়া মেয়েটির নাম আহু দরিয়াই। আহুর প্রতিবাদ অবশ্যই কুর্ণিশ জানানোর যোগ্য। শাসক ও শোষকের চোখরাঙানি উপেক্ষা করে নিশ্চিত শাস্তি জেনেও তিনি তাঁর প্রতিবাদ থেকে দূরে সরে যাননি। কিন্তু প্রশ্ন হল, গোটা পশ্চিমী মিডিয়া থেকে ভারত আহু দরিয়াইকে কুর্নিশ জানালেও তারা কেন চুপ গত একবছর থেকে চলা প্যালেস্টাইনের গণহত্যা নিয়ে। নারীবাদীর পাঠ শেখানো পশ্চিমী দুনিয়ার সিলেকটিভ ফেমিনিস্টদের প্রশ্ন করার সময় এসেছে এবার। প্যালেস্টাইনের জেনোসাইড কিন্তু এবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছে সাদা চামড়ার নারীবাদীদের অন্তঃসারশূন্যতা। আহু দরিয়াইয়ের প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে ইরানকে আবার কোণঠাসা করার চেষ্টা চালাচ্ছে পশ্চিমী মিডিয়া থেকে শুরু করে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার প্রশ্নে ইজরায়েলের পাশে দাঁড়ানো সমস্ত বন্ধু দেশ। গোটা পৃথিবীকে স্বাধীনতা থেকে সভ্যতার পাঠ শেখানোর নামে নিজের হুজ্জুতি চালানো আমেরিকা ২০০১ সালে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে আক্রমণ করার একটি অজুহাত ছিল নারীদের স্বাধীনতা। আর সেই অজুহাতকে সমর্থন জানায় শ্বেত নারীবাদীরা। এই ২০২৪-এ এসে সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রের নীরবতার মধ্যে উজ্জ্বল তারা হয়ে প্যালেস্টাইনের পাশে আছে ইরান। বুশ, লর্ড ক্রেমার (যিনি ইজিপ্টে মুসলিম নারীদের হিজাব পরা প্রগতিশীলতার পরিপন্থী মনে করেন, আবার ইংল্যান্ডে তিনি নারীদের ভোটাধিকার অপ্রয়োজনীয় মনে করতেন)-এর মতো নব নির্বাচিত আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প আবার ‘নারী মুক্তি স্বাধীনতা’র নামে ইরানকে কোণঠাসা করতে চাইবে। প্যালেস্টাইন প্রশ্নে ট্রাম্পের অবস্থান খুব স্পষ্ট। আমেরিকা মনে করে সভ্যতার এবং নারী স্বাধীনতার পাঠ দেওয়ার ঠিকাদার একমাত্র তারা। এত বছরের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত একজন নারীকে প্রেসিডেন্ট করার ব্যর্থতা নিয়ে আমেরিকা নেমে পড়েছে সারা পৃথিবীকে নারীমুক্তির শিক্ষা দিতে। তাই আহু দরিয়াইয়ের অন্তর্বাস পরা ছবি প্রতিবাদের মুখ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত তাবড় তাবড় মিডিয়া হাউসের সমস্ত ব্রেকিং নিউজে। আবার চাগাড় দিয়ে উঠেছে পশ্চিমী দুনিয়ার সাদা বা শ্বেত নারীবাদ, যারা প্যালেস্টাইনের নারী, শিশুদের মাংসের টুকরো দেখে শিউরে না উঠলেও নারীদের হিজাবে দেখে শিউরে ওঠে। আসরে নামে নারীদের মুক্তির জন্য।
ভারতীয় মিডিয়াগুলোতে যথারীতি খাপ বসেছে ইরানের নীতিপুলিশ নিয়ে। উদ্বিগ্ন লিবারালরা আহু দারিয়াইয়ের ছবি পোস্টিয়ে নিজেদের বিপ্লবী কাম তুষ্ট করছেন। তাতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু গত অক্টোবরের ৭ তারিখের পর থেকে শুধু এইবারের চলা গণহত্যায় ৪০ হাজারেরও বেশি প্যালেস্টিনীয়কে হত্যা করা হয়েছে, ম্যাপ থেকে প্যালেস্টাইনের মুছে ফেলার শেষ ধাপের দিকে এগোচ্ছে ইজরায়েল। সেই ছবি কোথাও জায়গা পাচ্ছে না ভারতে। উল্টে প্রো-ইজরায়েলি প্রোপাগান্ডা দিয়ে ভিলিফাই করা হচ্ছে এদেশের সংখ্যালঘুদের। সংখ্যাগুরু ধর্মান্ধতার কবলে এ দেশের নারীরাও। সংখ্যালঘু আফরিন ফাতিমার বাড়ি যেমন বুলডোজার দিয়ে ভেঙে ফেলা যায় এদেশে, তেমনই এক কুকি মহিলাকে নগ্ন প্যারেড করানো যায়। তেমনই প্রেমের অপরাধে জেলে পুরে ফেলা যায়।
ইরানীয় নারীদের মুক্তি নিয়ে সরব ভারতীয়রা অন্ধ হয়ে বসে দলিত, আদিবাসী, মুসলিম নারীদের উপর রোজকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। সিনেমা থেকে বিজ্ঞাপন সবেতেই নারীকে পণ্য বানানোর চেষ্টা। উগ্র ধর্মান্ধতার দিকে এগিয়ে চলা ভারতে স্তন ক্যানসার সচেতনতার বিজ্ঞাপনে ‘স্তন’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘কমলালেবু’ ব্যবহার করতে হয়, যা নারীমুক্তির প্রশ্নে ভারতের বর্তমান চরম পিছিয়ে পড়ার সর্বোৎকৃষ্ট ও সাম্প্রতিকতম উদাহরণ।
…………………………………………
আহু দরিয়াই, মহসা আমিনি, আফরিন ফাতিমা, গুলফিসা ফাতিমা– সবাই হাঁটছেন নিজের মতো করে। তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের দাবি, মুক্তির দাবি তাঁদের নিজেদের। পথও তাঁদের একান্ত নিজেদের। সেই দাবির দখলদারি তাঁরা মানবেন না। আগে থামুক জেনোসাইড। অরুন্ধতী রায় যেমন বলেন, ‘আমি বলি না যে শোষিতরা শোষকের বিরুদ্ধে কোন পথে আন্দোলন করবেন, তা তাঁরা ঠিক করবেন নিজেরাই!’
………………………………………….
আহু দরিয়াই-কে কুর্নিশ। কিন্তু তাঁকে সামনে রেখে নারীদের বাঁচানোর নামে ইরানকে সারা বিশ্বে কালিমালিপ্ত করার পশ্চিমী চক্রান্তকে ধিক্কার। ধিক্কার শ্বেত নারীবাদীদের ও সাবর্ণ ভারতীয় নারীবাদীদের, যারা প্যালেস্টাইনের নারীদের অধিকারের প্রশ্নে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। নারীবাদকে চুরি, নারীদের বাঁচানোর নামে সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা বহুদিন। মধ্য প্রাচ্য ও প্রাচ্য দেশগুলোর নারীরা দীর্ঘদিন ধরে নিজেদের স্বাধীনতার প্রশ্নে নিজেরাই আন্দোলন করে আসছেন যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গেই। পশ্চিমী নারীবাদীদের সিলেকটিভ প্রতিবাদের ন্যারেটিভে তাঁদের মুক্তি নেই।
আহু দরিয়াই, মহসা আমিনি, আফরিন ফাতিমা, গুলফিসা ফাতিমা– সবাই হাঁটছেন নিজের মতো করে। তাঁদের স্বাধীনতা অর্জনের দাবি, মুক্তির দাবি তাঁদের নিজেদের। পথও তাঁদের একান্ত নিজেদের। সেই দাবির দখলদারি তাঁরা মানবেন না। আগে থামুক জেনোসাইড। অরুন্ধতী রায় যেমন বলেন,
‘আমি বলি না যে শোষিতরা শোষকের বিরুদ্ধে কোন পথে আন্দোলন করবেন, তা তাঁরা ঠিক করবেন নিজেরাই!’
………………………………………….
পড়ুন অর্ক ভাদুড়ির লেখা: ‘পাশের দেশের ঘটনা’ বলে আমাদের সান্ত্বনা পাওয়ার কিছু নেই
………………………………………….
আহু দরিয়াইয়ের দরকার নেই আমেরিকার বা এইসব সিলেকটিভ ফেমিনিস্টদের। তাঁরা নিজেরাই পারবেন সব নীতিপুলিশদের সামনে নিজেদের হিজাব পরার বা না পরার স্বাধীনতার প্রশ্নে নিজেদের পছন্দের হয়ে লড়াই করতে।
যেমন ইরানিয়ান কবি ও চলচ্চিত্রকার ফারো ফারুখজাদ লিখেছেন,
আমি হলাম জ্বলন্ত মোমবাতি
যা ধ্বংসস্তূপকেও আলোকিত করে
আমি নিভে গেলে
ধ্বংস হবে সব খাঁচা।