মুশতাকের গল্পের মহিলারা খুব কম জায়গায় ধর্মের নামে শোষিত হয়েছে। তালাক, সম্পত্তির অধিকার বা বহুবিবাহের কথা আলগা করে ছুলেও ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর মহিলাদের সমস্যা ও প্রতিবাদ ধর্মের গণ্ডির মধ্যেই সীমিত। মুশতাকের কাজেও এই গণ্ডির প্রতিফলন। তাঁর নারীবাদী সমাজসংস্কার ধর্মের বাইরে বেরতে পারেনি। তাতেও তাঁকে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের ক্রোধের শিকার হতে হয়। যখন মহিলাদের মসজিদে ঢুকে নামাজের অধিকারের দাবি তোলেন, তখন তাঁর প্রাণের ওপর হামলা হয়। মুসলিম মহিলাদের নিয়ে লেখেন বলে মুসলমান সমাজ তাঁর সমালোচনা করে, তিনি নাকি গোষ্ঠীর সম্মানহানি করছেন।
আইনজীবী, সাংবাদিক, নারীবাদী সমাজকর্মীর সঙ্গে কর্নাটকবাসী বানু মুশতাকের আরেক পরিচয় এখন– বুকার বিজয়ী লেখক। সত্তরোর্ধ্ব মুশতাকের ১২টি গল্পের সংকলন ও দীপা ভাস্তির অনুবাদ ‘হার্ট ল্যাম্প’ এই বছর বুকার পায়। ২০২২-এ গীতাঞ্জলি শ্রী আর এই বছর মুশতাকের জয়ের দৌলতে আঞ্চলিক ভাষার ভারতীয় সাহিত্য বিশ্বে অন্য মর্যাদা পেল।
কর্নাটকের হাসান শহরে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে মুশতাকের জন্ম। সেই সময়ের সামাজিক বাধা অতিক্রম করে মুশতাক কলেজ-ইউনিভার্সিটি পাশ করেন এবং ২৬ বছর বয়সে প্রেম করে বিয়ে করেন। তবে বিয়ের পর শুরু হয় বাধা। বিয়ের ১৮ দিনের মাথায় বরের অনুরোধে স্কুলশিক্ষকের চাকরি ছেড়ে দেন। বিয়ের কিছুদিন পরেই তাঁর প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় কন্নড় সংবাদপত্র ‘প্রাজামাতা উইকলি’-তে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির পছন্দ হয়নি মুশতাক লেখালেখি করুক। তার ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয় বোরখা! বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে লেখক জানান যে, ২৯-এ পা দিতে দিতে বাচ্চার জন্ম দেন এবং পোস্টপার্টাম ডিপ্রেশনে ভুগতে শুরু করেন। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এতটা পর্যায়ে যায় যে, মুশতাক একদিন বাড়িতে থাকা সাদা পেট্রোল গায়ে ঢেলে নিজেকে জ্বালাতে যান। তাঁর বর সময়মতো আটকে দেন তাঁদের বাচ্চাকে পায়ের সামনে রেখে।
এরপর শুরু হয় তাঁর প্রতিবাদ। চাকরি, লেখালেখি, সাংবাদিকতা, সমাজের কাজ। কিন্তু যিনি প্রায় মৃত্যুর দোরগোড়া থেকে ফিরে আসেন, যার প্রতিবাদী সত্তা ঘরের চার দেওয়াল, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া বোরখা মেনে নিতে পারে না, সেই মুশতাকের ‘হার্ট ল্যাম্প’-এ কিন্তু প্রতিফলন হয়নি প্রতিবাদের।
গল্পের মেহেরুন একদিন তার ছোট মেয়ে নিয়ে চলে আসে বাবার বাড়ি। বছর ৩০-এর মেহেরুনের পাঁচটা বাচ্চা। তার বর অন্য প্রেমে আসক্ত। মেহেরুনের ফিরে আসা মেনে নিতে পারে না তার বাবা-মা। দাদাদের দিয়ে তাঁকে বরের বাড়ি ফেরত পাঠান। যে বাড়িতে ছোট থেকে এত যত্ন, আদর, তাদের কাছে নিজের কষ্ট ও ক্রোধের স্বীকৃতি না পেয়ে মেহেরুন, অনেকটা মুশতাকের মতো আত্মঘাতী হতে চায়। বাচ্চাদের কান্নায় ও আর্তনাদে হুশ ফেরে। মাতৃসত্তা তাকে জাগিয়ে তোলে।
জামিলা তার মুতাওয়াল্লি (ওয়াকফ সম্পত্তির তত্ত্বাবধায়ক) দাদা উসমানের কাছে হকের সম্পত্তি দাবি করতে আসে। উসমানের রাগ যে বোনকে এত ভালোবেসে বড় করেছে, যার ঢাকঢোল বাজিয়ে বিয়ে দিয়েছে, সে কেন তার অধিকারের সম্পত্তি চাইতে আসবে। কিন্তু ঠিক এইসময় তাদের লোকালয়ের এক ধর্মীয় রাজনৈতিক ঘটনায় সবাই মেতে ওঠে। জামিলার বর তাকে বলে এখন সম্পত্তি না চাইতে। উসমান তো বটেই, জামিলাও তাতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। কারণ সে তার বরের নির্দেশ অনুযায়ী সম্পত্তি চেয়েছিল। তার ইচ্ছা ছিল না নিজের অধিকার আদায় করার।
আরেক গল্পের প্রধান চরিত্র এক আইনজীবী। তাঁর কাছে এক মহিলা বরের বিরুদ্ধে নালিশ নিয়ে আসে। বর মৌলবি যার কি না গবি মাঞ্চুরিয়ান পছন্দের খাবার। উত্তর ভারতীয় এই খাবার কন্নড় পরিবারের মেয়েটি কিছুতেই ঠিক বানাতে পারে না। তাই বরের কাছে মার খেতে হয়। সেই শুনে আইনজীবী সিদ্ধান্ত নেন মহিলার বিয়ে ও জীবন বাঁচাতে হবে গবি মাঞ্চুরিয়ানের রেসিপি খুঁজে দিয়ে।
ইউসুফের বউ আরিফা আর মা মেহেবুবার সম্পর্ক খারাপ। বাড়ি তাই প্রায় দুই ভাগ। মেহেবুবা একদিকে থাকে আর চুপচাপ আরিফার রাগ সহ্য করে। বউয়ের রাগ যখন তুঙ্গে চলে যায়, তখন ইউসুফ ঠিক করে মায়ের বিয়ে দিয়ে দেবে। মাকে ভালো রাখার জন্য। মাকে সিদ্ধান্ত জানায় না। মায়ের জন্য সম্বন্ধ ঠিক করে, বাড়ি সাজায়, মাকে জানায় না। ইউসুফের এই কাজে আরিফাও যখন বিরক্ত হয়ে শাশুড়ির কাছে ক্ষমা চেয়ে বিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে, তখন ছেলের সংসারের শান্তির জন্য মেহেবুবা নিজের বিয়েকে বলিদান হিসেবে মেনে নেয়।
বানু মুশতাকের আরিফা, মেহেবুবা, মেহেরুন, জামিলা– সবই আমাদের চেনা চরিত্র। তাঁদের দুঃখ, ক্রোধ, বিপর্যয় ভারতের, থুড়ি, দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সব ঘরের গল্প। মুশতাক বারবার বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন যে তিনি তাঁর আশপাশের কাহিনি লেখায় তুলে ধরেছেন। কর্নাটকের মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারের মহিলাদের গল্প। উনি বাস্তব ঘটনা পেশ করেছেন লেখার মধ্য দিয়ে। মুশতাকের বুকার জেতার পর অনেক বিশ্লেষক বলেছেন যে এই বাস্তব গল্পগুলোর মধ্যে হয়তো আমাদের ধর্ম বনাম নারীবাদী বিশ্লেষণ খোঁজা উচিত নয়। কিন্তু ধর্মের নামে মহিলাদের শাসন ও শোষণও আমাদের বাস্তব। তিন তালাক এখনও চলে। তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধ হলেও, তালাকের নামে গৃহহিংসা প্রচলিত। মুসলিম মহিলাদের সম্পত্তিতে সমান অধিকার নেই, আর যেটুকু আছে, সেটাও তাঁরা পান না। হিল্লা বিয়ে চলে। অর্থনৈতিক কারণে বহুবিবাহের প্রচলন কমলেও ধর্মীয় বিধান এখনও চালু আছে। মুশতাকের গল্পের মহিলারা খুব কম জায়গায় ধর্মের নামে শোষিত হয়েছে। তালাক, সম্পত্তির অধিকার বা বহুবিবাহের কথা আলগা করে ছুলেও ‘হার্ট ল্যাম্প’-এর মহিলাদের সমস্যা ও প্রতিবাদ ধর্মের গণ্ডির মধ্যেই সীমিত। মুশতাকের কাজেও এই গণ্ডির প্রতিফলন। তাঁর নারীবাদী সমাজসংস্কার ধর্মের বাইরে বেরতে পারেনি। তাতেও তাঁকে মুসলিম পিতৃতন্ত্রের ক্রোধের শিকার হতে হয়। যখন মহিলাদের মসজিদে ঢুকে নামাজের অধিকারের দাবি তোলেন, তখন তাঁর প্রাণের ওপর হামলা হয়। মুসলিম মহিলাদের নিয়ে লেখেন বলে মুসলমান সমাজ তাঁর সমালোচনা করে, তিনি নাকি গোষ্ঠীর সম্মানহানি করছেন।
ধর্ম বনাম নারীবাদী চিন্তাভাবনাকে দূরে রাখলেও মোশতাকের গল্পের মহিলারা ম্লান হয়ে যায়, কারণ তারা সমাজের সৃষ্টি করা পরিচয়ের লক্ষণরেখা– মা, বোন, বউ-এর বাইরে পা বাড়াতে পারেনি। মেহেরুন সারা গল্পে নিজের গুরুত্ব খুঁজে পায় তাঁর বাচ্চাদের কান্নায়। জামিলার নিজের অধিকারের সম্পত্তি দাদার কাছ থেকে চেয়ে নেওয়ার কথা ভাবতে পারে না। মেহেবুবা ছেলের শান্তির জন্য ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিকাহতে রাজি হন। আর আইনজীবী, পেশাগতভাবে এক মহিলাকে গার্হস্থ্য হিংসা থেকে না বাঁচিয়ে, তাঁর বিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেন।
আমাদের ভূখণ্ডের সাহিত্যের ইতিহাস ঘাঁটলে এই ধরনের মাতৃত্ব, সতীত্বর টোপ ভেঙে বেরনোর প্রচুর গল্প পাওয়া যাবে। মুসলিম মহিলা লেখকও পাব যারা বহু আগেই এই চিন্তাভাবনার বলিষ্ঠ প্রতিবাদ করেছেন। রোকেয়া সাখওয়াত হোসেনের তীব্র প্রতিবাদী কণ্ঠ বা ইসমত চুঘতাইয়ের ধারালো শৈলী আমাদের বহু দশক (রোকেয়ার ক্ষেত্রে শতক) ধরে অনুপ্রেরণা দেয়। সুলতানাকে এক শতকেরও বেশি বছর আগে রোকেয়া স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছেন। চুঘতাই-এর বেগমজান বা লাজ্জো পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নিজেদের বাসনা ও বেঁচে থাকার অধিকার ছিনিয়ে নিতে শিখেছে। রোকেয়া বা চুঘতাইয়ের লেখায় কোনও ভান নেই। ধার্মিক ও সামাজিক গণ্ডি পেরিয়ে উচ্চকণ্ঠে লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী কথা বলে গেছেন।
………………………………
পড়ুন বানু মুশতাক-কে নিয়ে বিদিশা চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: বানু মুশতাকের লেখা সংস্কৃতিগতভাবে আলাদা, তবুও নারীপৃথিবীর অভিজ্ঞতায় খুব আলাদা নয়
………………………………
তবে বাস্তব অবশ্যই সাহিত্যের চেয়ে কঠিন। গল্পের মেহেরুন তাঁর মায়ের কাছে কাঁদে তাঁকে পড়তে দেওয়া হয়নি বলে। সে হিজাব পরে কলেজ যেতে রাজি ছিল, যাতে তাঁর পড়া বন্ধ না হয়। এই গল্প ঘরে ঘরে। ২০১৫-তে আমি দিল্লিতে স্নাতকোত্তের ছাত্রী। দিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন’স স্টাডি ডিপার্টমেন্টে একটি সেমিনার চলার সময় সেখানকার বহু হিজাবধারী ছাত্রীদের কাছে শুনি শরীর না ঢাকলে বাড়ি থেকে পড়তে পাঠাবে না। প্রায় ১০০ বছর আগে যখন রোকেয়া মেয়েদের স্কুল শুরু করেন, তখন তাঁকেও সমাজের চাপে মেয়েদের শরীর, মুখ ঢেকে স্কুলে আনতে হত। না-হলে পড়া আটকে যাবে। এটাই বাস্তব। কিন্তু লেখক রোকেয়া শব্দ দিয়ে বাস্তবকে জব্দ করেছেন। আর যখন মহিলাদের আকাঙ্ক্ষা, বেঁচে থাকার লড়াই সমাজের কাছে স্বীকৃতি পাইনি, সেই সময় দাঁড়িয়ে ইসমত চুঘতাই তাঁর গল্পের মহিলাদের সত্তার মর্যাদা দিয়েছেন, পৌরুষত্ব ও নারীত্বের কৃত্রিম সীমানা লঙ্ঘন করেছেন।
তবে আজকের ধর্মীয় রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে মুশতাকের কাজের গুরুত্ব অন্য জায়গায়। মুসলিম মহিলাদের নির্দিষ্ট ধর্ম নির্ধারিত সমস্যা নিয়ে কথা তুললেই একটি গোষ্ঠী রাজনৈতিক খেলা শুরু করে। মুসলিম মহিলাদের মুখ থেকে তাদেরই প্রতিবাদের ভাষা কেড়ে বিষয়টাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেয়। আর তাই মুসলমান সমাজ, নিজেদের সত্তা ও স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য এই ধরনের মহিলাদের কথা ও ক্রোধ ধামা চাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। সম্প্রদায় বনাম ব্যক্তির লড়াইয়ে বিশেষত সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রে– মহিলারা সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাঁদের ব্যক্তিসত্তার বলিদান দেওয়া হয় সম্প্রদায় বাঁচানোর তাগিদে। এই পরিস্থিতিতে মুশতাকের ধার্মিক গণ্ডি বজায় রেখে, ধার্মিক পিতৃতন্ত্রকে সরাসরি আঘাত না করেও মুসলমান সমাজের মহিলাদের পীড়নের কথাগুলো জরুরি। বিশ্বব্যাপী পাঠকের কাছে এই বাস্তবটা পৌঁছে দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।
…………………………….
ফলো করুন আমাদের ওয়েবসাইট: রোববার ডিজিটাল
…………………………….