গালাগালির ভাষা দিয়েই নির্মিত হয় নারীর প্রতি ভাষিক অবরোধ। খাদ্য, ফল, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্র, এই সব কিছুকে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করা হয় নারীকে আক্রমণ করার জন্য। যেমন, ‘রসে ভরা কমলা’, ‘টাইট মাল’, ‘কচি ডাব’, ‘অ্যাটম বোম’, ‘তানপুরা’, ‘গাড়ির চেসিস’, ‘ডবল ডেকার’, ‘গ্যারেজ বড়’, ‘কালনাগিনী’, ‘কাশবন’, ‘কচিমাল’, ‘ডবকা মাল’, ‘ইন্ডিয়া গেট’ ইত্যাদি। শব্দগুলো নারীকে অপমান করার জন্য ব্যবহৃত এবং তাই নারী শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি করে তাদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন।
প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ সুকুমার সেন তাঁর ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘যে শব্দ বা পদ ভদ্রলোকের কথ্য ভাষায় ও লেখ্য ভাষায় প্রয়োগ হয়না এবং যাহার উৎপত্তি কোনও ব্যাক্তি বিশেষের বা দল বিশেষের হীন ব্যাবহার হইতে, তাহাই ইতর শব্দ বা স্ল্যাং।’ আজকে অহরাত্র এই স্ল্যাং বিপুল শব্দকোষে, বাংলা ভাষার ব্যবহারে, বিশেষ করে ঠাট্টা-ইয়ার্কি, গালাগালি, এবং দৈনন্দিন কথোপকথনের মধ্যে– বারবার করে ঘাত নেমে আসছে একটাই সম্প্রদায়ের ওপর– নারী সম্প্রদায়ের ওপর।
ভাবুন তো! এই যে আমাদের ভাষার এত বৈচিত্র্য, এত সমৃদ্ধি, এতসব রঙিন খিস্তি– এসবই তো এক মহা পিতৃতান্ত্রিক যজ্ঞের ফসল! যখন একজন পুরুষ আরেকজন পুরুষকে গালি দেয়, তখন যৌনতা বা ধর্ষণের ইঙ্গিত না থাকলে সে গালির গ্রহণযোগ্যতাই থাকে না! স্রেফ ‘ঢ্যামনা’ বললে কি আর গালি জমে? শুনলেই বোঝা যায়, এতে কোনও রস নেই! ‘মাগী’র ম্যাসকুলিন শব্দ ‘মিনসে’-তে সেই খানদানী রগরগে ব্যাপারটাই নেই। মাগীর তেজের কাছে, মিনসে বড় শুকনো। আরেকটা শব্দ, ঢ্যামনা। ঢ্যামনা থেকে, ঢ্যামনামি। এগুলো ম্যাসকুলিন শব্দ হলেও নিস্তেজ। ঢ্যামনা তেজহীন কারণ ঢ্যামনা মানে নির্বীর্য পুরুষ।
কিন্তু ম্যাসকুলিন গালিতে পৌরুষের এত অভাব কেন?
একজন আমাকে বলেছিলেন, ছোটবেলাতে ‘ভাতারখাগী’ শুনলেই, মনে হত এক মোটাসোটা মহিলা থুপুস হয়ে বসে পরম আহ্লাদে এক থালা ভাত খাচ্ছে!’ কিন্তু গালাগালি থেকে খিস্তি হয়ে ওঠার যে স্নান না করা, গায়ে গন্ধ হওয়া, মল-মূত্র মেখে বসে থাকার পথটা; সেখানে পদে পদে নারীদের জন্য খিস্তির একেবারে রাজপাট। ভাতারখাগীর থেকেও রগরগে গালি হচ্ছে ‘বারোভাতারী’। লক্ষণীয়, সরাসরি রেন্ডি, খানকি বা বেশ্যা নয়; ঘুরিয়ে, রসে ডুবিয়ে, সংখ্যা জুড়ে শব্দটাকে ধারালো করা হয়েছে। ১২ সংখ্যাটা এই খিস্তিতে একটা নবমাত্রার সংযোজন যেন।
আবার মেয়েদের প্রতি খিস্তির যে মণিহারি পসরা, তাতে জামা একটু ছোট হলে ‘বেশ্যা’, রাতে একটু দেরি করে বাড়ি ফিরলে ‘নষ্ট’ মেয়ে, মুখের ওপর যুক্তি দেখালে ‘রেন্ডি’। ‘বেশ্যা’ শব্দটা একরকম, কিন্তু যখন ‘বেশ্যার জাত’ বলা হয়, তখন তা যেন একেবারে জাতিগত শুদ্ধিকরণ। ‘বেশ্যা’-র অর্থসম্প্রসারণ এখানে প্রবলভাবে রাজনৈতিক। নারী মানেই বিল্বপত্র শুদ্ধ, নয়তো সোজা বেশ্যা। আর পুরুষের জন্য? পুরুষকে ‘খানকির ছেলে’ বলা যায়, কারণ মা তুলে গালাগালি সব ভাষায় পুরুষকে অপমানের অন্যতম স্বীকৃত উপায়৷ আহা! কী অনন্যসাধারণ ভারসাম্য!
………………………………………….
এই যুগে দাঁড়িয়েও, জন্মপ্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাতেই পুরুষ অসহায় দর্শক মাত্র। এমনকী সন্তান লালনেরও বিরাট একটা অংশ তার নাগালে নেই। এই সম্পূর্ণ নারীর রাজত্বে, সন্তান ধারণ থেকে জন্মদান ও প্রাথমিক পরিচর্যায়; পুরুষ নিজেকে বেমানান করে রেখেছে আদিকাল থেকে; সে অবশ্য নিতান্ত দায়িত্ব এড়াতেই। তাই বাইরে থেকে নানা কায়দাকে সম্বল করে; পৈতে, সুন্নত, ব্যাপটিজম সর্বস্ব দিয়ে পিতৃনাম আরোপ করে দেওয়ার হাজারও অনুষ্ঠান পালিত হয়। জাতককে আচারের মাধ্যমে পিতার করে নেওয়া।
………………………………………….
গালাগালির ক্ষেত্রে পুরুষের যৌনাঙ্গ তার পুরুষত্বের একমাত্র মাপকাঠি! ‘দাঁড়ায় না’– এই বাক্যটি এক কথায় যে কোনও পুরুষের সম্পূর্ণ পরিচয় হতে পারে! ইন্টারসেক্স মানুষদের অপমান করে ‘হিজড়া’ শব্দটিও বহুল প্রচারিত! অথচ ‘হিজড়া’ একটি সম্প্রদায়ের নাম; ঠিক যেমন ‘বাউল’ একটি সম্প্রদায়। ‘ছক্কা’ ব্যবহৃত হয় সমকামী পুরুষ বোঝাতে, মেয়েলি পুরুষদের জন্য ‘বৌদি’। এসব শব্দ মুড়ি-মুড়কির মতো হাটে-বাজারে, স্কুলে, অফিসে বিলোয়! এদিকে, কারও ওপর প্রভাব খাটাতে চাইলে কী করতে হবে? ‘গাঁ… মেরে দে!’– সহজ, কার্যকর এবং যৌন হিংসাকে ভাষার অঙ্গ করে তোলার চমৎকার অস্ত্র এক অমোঘ বাক্য!
কাজেই লক্ষণীয়, গালির প্রায় প্রতিটি শব্দের মধ্যেই আছে যৌন সম্পর্ক বা যৌনাঙ্গ নিয়ে ইঙ্গিত। তাই বদমাশ, পাজি, বেয়াড়া, এইধরনের যৌনগন্ধহীন শব্দগুলো গালি হিসেবে ম্যাড়মেড়ে, আউটকাস্ট।
ইংরাজিতে ‘ইউ ডগ’ হল বাহবা; হলিউডি বহু ক্ষেত্রে ব্যবহার দেখা যায় সেই পুরুষের ক্ষেত্রে, যে কাঙ্ক্ষিত রমণীর শয্যাসঙ্গী হয়ে এসে বত্রিশ পাটি বের করে যুদ্ধজয়ের রস শুনিয়েছে বন্ধুমহলে। কিন্তু ‘বিচ’ বলতে বোঝায় বহু পুরুষের শয্যাসঙ্গিনীকে। অর্থাৎ, নারীর স্বেচ্ছা-যৌনতা খিস্তির এক গুরুত্বপূর্ণ উৎসবিন্দু। শুধু ‘ছিনাল’ শব্দটা শুনতে লাগে একটু আদুরে অথচ চোর, এরকম মেছো বিড়ালের মতো, অথচ ‘ছিনাল মাগী’, একলাফে খিস্তির বুর্জ খালিফা।
‘সান অফ আ বিচ’ শুনতে তেমন মেজাজি নয়, কিন্তু ‘মাদার…দ’ যাকে বলা হল সে তেড়ে উঠবেই। গালাগালির রসে মেয়েদের বা যৌনগন্ধ বাদ দিলে খিস্তি নামক আর্টটাই নির্জলা।
মাগীর উল্টো মরদ শব্দটা কিন্তু গালাগালই নয় আসলে। বরং বেশ একটা প্রতাপশালী মুকুটসম। আবার একটা মেয়ের দিকে ‘মদ্দা মেয়েমানুষ’ ছুড়ে দেওয়া মানে চরম অপমান। ‘মদ্দা মেয়েমানুষ’-রা মুখে মুখে, অকাট্য যুক্তি দিয়ে লড়াই করে থাকেন সাধারণত– যা রমণীসুলভ নয়। আসলে পুরুষ এবং নারীর মূল্যায়নের মাপদণ্ডটাই ভিন্ন! নারীর জন্য যা অবমাননাকর, ঠিক সেটাতেই পুরুষরা মহারাজ। এ যেন গোপাল ভাঁড়ের গল্প! যেসব খিস্তিতে কোনও নারীর সঙ্গে যৌন সংসর্গ করবার ইঙ্গিত, তার ব্যবহার অত্যন্ত বেশি কারণ তার মধ্যে একটা বীরভাব প্রকাশ পায়। ‘তোর মাকে…’, ‘তোর বোন কে…’ এইসব গালিতে একটা রেপ-রেটরিক স্পষ্ট। এখানে খিস্তিকর্তার বীরভাবের মধ্যেই ধর্ষণকামীর জয়ের হাসি ঝলকায়।
এতক্ষণ গেল পুরুষের মধ্যেই আধিপত্যের লড়াইতে ব্যবহার হওয়া নারীদের কথা, যে যুদ্ধের সঙ্গে নারীর ন্যূনতম সম্পর্কও নেই। এবার আসি যে অশ্লীল, অকথ্য শব্দের মাধ্যমে নারীকে অবদমন, হেয় প্রতিপন্ন, তুচ্ছ বা অপমান করা যায়; সমাজের তৈরি সেই সম্ভারেও।
গালাগালির ভাষা দিয়েই নির্মিত হয় নারীর প্রতি ভাষিক অবরোধ। খাদ্য, ফল, বাদ্যযন্ত্র, অস্ত্র, এই সব কিছুকে বিকৃত অর্থে ব্যবহার করা হয় নারীকে আক্রমণ করার জন্য। যেমন, ‘রসে ভরা কমলা’, ‘টাইট মাল’, ‘কচি ডাব’, ‘অ্যাটম বোম’, ‘তানপুরা’, ‘গাড়ির চেসিস’, ‘ডবল ডেকার’, ‘গ্যারেজ বড়’, ‘কালনাগিনী’, ‘কাশবন’, ‘কচিমাল’, ‘ডবকা মাল’, ‘ইন্ডিয়া গেট’ ইত্যাদি। শব্দগুলো নারীকে অপমান করার জন্য ব্যবহৃত এবং তাই নারী শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গের সঙ্গে সাদৃশ্য তৈরি করে তাদের বিকৃতভাবে উপস্থাপন। এখানে লক্ষণীয় যে, এই বিভিন্ন নির্জীব অলংকরণ যখন নারী শরীরের, তখন তার মধ্যে নারী শরীরকে কেবলমাত্র যৌন কামনা নিবৃত্ত করার উপাচার হিসেবেই দেখা হচ্ছে, প্রতিটি অঙ্গের বিকৃতিকরণের মধ্যে তাই যৌন ইঙ্গিত অবিচ্ছেদ্য।
আমাদের মহান সমাজে, এই সমস্ত গালিগুলোই ভাষার অলঙ্কার! আর এই অলঙ্কারে নারীর শরীর, মন, কর্মদক্ষতা, সামাজিক অবস্থান বা তাঁর যৌনতা ছাড়া আর কীই বা থাকবে? পুরুষতন্ত্র নিজের পুঁজি নষ্ট করে গালি বানাবে না– তাই গালির সঙ্গে ক্ষমতার রাজনীতি থাকবে না, সেও একটা অসম্ভব ভাবনা। স্থান-কাল-পাত্র বুঝে গালির প্রয়োগ করাটা এক চতুর ঐতিহ্যই বটে!
সমাজে বিভাজন ধরে রাখার সবচেয়ে সহজ অস্ত্র ভাষা, আর এই অস্ত্র রক্ষার জন্য আমাদের পরম যত্নশীল সমাজপ্রেমীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন। শব্দচয়ন আর ভাষার ব্যবহারের ভেতর যে সূক্ষ্ম ক্ষমতার খেলা লুকিয়ে আছে, তার প্রয়োজনীয়তা তাই অসীম!
দেখা যাচ্ছে যে, পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারীদের নতজানু করে যত আমোদ পেয়েছে, ততটা রাজত্ব, যুদ্ধজয়, রাজনীতি, জুয়া খেলা, চুরিচামারি, বিপুল ঠকানো– কিছু করেই পায়নি আর সেভাবে!
এই যুগে দাঁড়িয়েও, জন্মপ্রক্রিয়ার প্রায় পুরোটাতেই পুরুষ অসহায় দর্শক মাত্র। এমনকী সন্তান লালনেরও বিরাট একটা অংশ তার নাগালে নেই। এই সম্পূর্ণ নারীর রাজত্বে, সন্তান ধারণ থেকে জন্মদান ও প্রাথমিক পরিচর্যায়; পুরুষ নিজেকে বেমানান করে রেখেছে আদিকাল থেকে; সে অবশ্য নিতান্ত দায়িত্ব এড়াতেই। তাই বাইরে থেকে নানা কায়দাকে সম্বল করে; পৈতে, সুন্নত, ব্যাপটিজম সর্বস্ব দিয়ে পিতৃনাম আরোপ করে দেওয়ার হাজারও অনুষ্ঠান পালিত হয়। জাতককে আচারের মাধ্যমে পিতার করে নেওয়া। পারিবারিক সম্পত্তির পরিকাঠামোর দড়ি যাতে পিতৃকুলের হাতে থাকে, তার জন্য শুধু বাপের পদবি আরোপ করে দেওয়াই যথেষ্ট নয়। পদে পদে, রান্নাঘরে– বৈঠকখানায়– চৌকাঠে যুগ যুগ ধরে দাঁড় করানো আছে বিবিধ নিয়ম, আচার। কোনও ভাবেই জিততে দেওয়া যাবে না নারীকে, উঠতে দেওয়া যাবে না পুরুষের ওপরে।
………………………………………
আরও পড়ুন সম্প্রীতি মুখার্জী-র লেখা: ধর্ষণ সংগঠিত অপরাধ, ধর্ষণের বিরুদ্ধে আমরা কি সংগঠিত?
………………………………………
তাই তো পত্নীর কথা মেনে চলা পুরুষ ‘স্ত্রৈণ’; কারণ নিম্নবর্গীয় নারী সম্প্রদায়ের কথাকে মান্যতা দিয়ে চলা পুরুষ, যথেষ্ট পুরুষই নয়। ঠিক এই রাস্তাতেই অধিকাংশ নারীকেন্দ্রিক খিস্তির উদ্ভব। যে মানসিকতা নারীকে বন্দি করে রাখতে চেয়েছে বাড়ির অন্দরমহলে, যে পিতৃতন্ত্রের চোখ রাঙানিতে লক্ষণরেখা টানা হয়েছে নারীর স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার পথে; সেই সুচারু বুদ্ধির আবেগেই তীক্ষ্ণ ভাষা নির্মাণ ও তা দিয়ে আক্রমণ, নিয়মের বাইরে পা ফেলতে চাওয়া নারীদের জন্যে।
তাই নারীর প্রতি ব্যবহৃত ভাষা যুগ যুগ ধরে একটা অসাধারণ সাংস্কৃতিক লিগ্যাসি! ব্যতিক্রমী কিছু গেঁয়ো ভাষাবিদরা যখন নারী অবমাননার গালিগুলো নিয়ে উচ্চবাচ্য করেন, তখন শুনতে খটকা লাগে! কী সুন্দর এই ভাষাশৈলী, কী নান্দনিক শব্দশিল্প– গালির মধ্যেও এত সৌন্দর্য, এত অনুভূতি! কে বলল, গালি নারীর অপমানের হাতিয়ার? এটি তো বরং ভাষার উৎকর্ষতার চূড়ান্ত উদাহরণ!
তাই ভাষায় নারীর অপমান বন্ধ করার প্রয়োজন কী? বরং চলুক, বিকশিত হোক! সংস্কৃতি বলে কথা!
…………………………………………
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………