‘ফায়ার’ মুক্তির পর হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম যদি আমাদের মতো কাউকে দেখতে পাই
Published by: Robbar Digital
Posted on: June 20, 2024 2:57 pm
Updated: June 20, 2024 3:22 pm
এক বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র আমাদের ইন্টারভিউ নিতে চায়। আমরা শর্ত দিয়েছিলাম, সেক্ষেত্রে কাউনসেল ক্লাবের পোস্টবক্স নাম্বার দিতে হবে। খুব রিস্কি ছিল ব্যাপারটা। ৩ এপ্রিল, ১৯৯৯ ইন্টারভিউটা বেরয়। আমাদের নেওয়া রিস্ক কাজে লেগে যায়। সেই পোস্টবক্স নাম্বারে তিনশোরও বেশি চিঠি এসেছিল। অনেকেই ঠিকানা বা ফোন নাম্বার দেয়নি। যারা দিয়েছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। এরপর আমরা আর বেশি দেরি করিনি। মূলত ছয়জন মিলে তৈরি হল ‘স্যাফো’। আবির-সাগরিকা, পিয়া-কিকি এবং আমি আর আকাঙ্ক্ষা মিলে সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করে ফেলি। স্যাফোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মীনাক্ষী সান্যালের একান্ত সাক্ষাৎকার, স্যাফোর ২৫ বছর উপলক্ষে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
বিদিশা চট্টোপাধ্যায়
সম্প্রতি থাইল্যান্ড সমকামী বিয়ে আইনসম্মত করল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম দেশ হিসাবে এই পদক্ষেপ খুবই জরুরি। এই সিদ্ধান্ত আমাদের দেশকে প্রভাবিত করবে? আপনি আশাবাদী?
খবরটা খুব আনন্দের। অনেক লড়াইয়ের ফসল। কিন্তু আমি আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিশ্রুতি এবং পরবর্তী অ্যাকশন নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নই। বেশ কিছু রাজনৈতিক দল ম্যানিফেস্টোতে এলজিবিটিকিউ রাইটস নিয়ে অনেক প্রতিজ্ঞা করেছে। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমেই অধিকার আদায় করা সম্ভব বলে আমি মনে করি।
আপনি তো ‘ম্যারেজ ইকুয়ালিটি রাইটস’-এর পক্ষে পিটিশনার হিসেবে ছিলেন। আজকে যখন বহু মানুষ বিয়ে থেকে বেরতে চাইছে, বিয়েকে ‘পিতৃতান্ত্রিক’ হিসাবে চিহ্নিত করছে, তখন সমকামী মানুষের বিয়ের অধিকার চাওয়া হচ্ছে। এই বিষয়টাকে যদি পাঠকের কাছে স্পষ্ট করেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে বিয়ের পক্ষে নাই হতে পারি। কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্র যদি অধিকার দেয়, তাহলে সকলেরই সেই অধিকার থাকা উচিত। এবং বিয়ে খুব চালাক একটা ইনস্টিটিউশন। কিন্তু কেউ যদি বিয়ে করতে চায়, আমি তাকে প্রশ্ন করব না, কিন্তু ভাবতে বলব। বিয়ে আসলে একটা ‘খুড়োর কল’। রাষ্ট্র সবসময়ে বিয়ের মাধ্যমে নানা অধিকার দেয় মানুষকে। যারা বিয়ে নিয়ে পিটিশন দিয়েছিল, তারা অত্যন্ত ধনী সমকামী মানুষ। আমিও ধুমধাম করে বিয়ে করব, আমার সম্পত্তি আমি আমার বৈধ সঙ্গীকে দিয়ে যাব– এই যে আকাঙ্ক্ষা, সেটার মধ্যে ভুল কিছু না থাকলেও একটা প্রিভিলেজের গল্প আছে। যাদের কিচ্ছু নেই, তাদের কথা কেউ ভাবছে না। ২০২৩-এ হওয়া পাবলিক হিয়ারিংয়ে একটি মেয়ে বলেছিল, আমি সিঁদুর পরতে চাই, তাতে অন্তত অন্য পুরুষের হাত থেকে বাঁচতে পারব, প্লিজ আপনারা কিছু করুন। একজন ট্রান্সম্যান সেখানে বলেছিল, সমাজ বিয়ে করে পরিবার তৈরি করার কথা বলে, আমি বিয়ে করতে চাই কারণ আমি এমন এক পরিবার তৈরি করতে চাই, যেখানে শুধু ভালোবাসা থাকবে। তেমন পরিবার সম্ভব, বলেছিল উত্তরপ্রদেশের এই ট্রান্সম্যান। তার মানে শুধু উৎসবের আকাঙ্ক্ষা ছাড়াও মানুষ বিয়ে করতে চায়, নিজেদের বাঁচাতে ও ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে। সেইটা আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।
‘স্যাফো’ তৈরি হওয়ার আগে আপনার জীবন সম্পর্কে জানতে চাই। কীভাবে এই প্রতিবাদের পথচলা শুরু হল?
২২ বছর বয়সে বিয়ের চাপ এড়াতে বাড়ি ছাড়া হই। পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করে পাটিয়ালা চলে যাই। সেখানে পড়াশোনা আর চাকরি। সেখান থেকে পাটনায় চলে যাই একটি ইংরেজি দৈনিক সংবাদপত্রে চাকরি নিয়ে। ১৯৯০-এর শেষের দিকে। ১৯৯২ সালে ডিসেম্বরে সেই চাকরি ছেড়ে দিই নৈতিক কারণে। ফিরে এসে চাকরির পরীক্ষা দিই। এর মাঝে আমি শাড়ি বিক্রিও করেছি। এরপর দুর্গাপুরে স্টিল অথরিটিজ অফ ইন্ডিয়ায় চাকরি পাই। এই যে নিজের শহর থেকে দূরে থাকা, সেটা তো আমার সেক্সসুয়াল ওরিয়েন্টেশনের কারণেই। আমার বাবা-মা অত্যন্ত ভালো মানুষ ছিলেন। তাঁদের সেই সময়ে আমি কী-ই বা বলতাম। কীভাবে বোঝাতাম যে আমি লেসবিয়ান। তার চেয়ে ভালো দূরে চলে যাওয়া। চাকরির ছুতো নিয়ে ভেগে যাওয়া যাকে বলে। নতুন শহরের একাকিত্বও মেনে নিলাম। সেই সময়ে আমার একজন বন্ধু ছিল– নাভ্রাতিলোভা। যা কিছু অন্যের সঙ্গে বলা যায় না, সেটা আমি একা হলেই নাভ্রাতিলোভাকে বলতাম।
কলকাতায় ফিরে এলেন কীভাবে?
কিন্তু কলকাতা ফেরার ইচ্ছেটাও ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছিল। মনে মনে ঠিক করেছিলাম, যেদিন কলকাতা যাব, সেদিন একটা সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করব। আকাঙ্ক্ষা, যে স্যাফোর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, তার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ ছিল। আকাঙ্ক্ষা আর আমি এক স্কুলে, এক ক্লাসে পড়তাম। ও ছিল ফার্স্ট গার্ল, আমি ছিলাম লাস্ট বেঞ্চার, আড্ডাবাজ। স্কুলে আমাদের যে খুব বন্ধুত্ব ছিল, এমন নয়। কিন্তু আমি ওর ব্যাপারে প্রোটেক্টিভ ছিলাম। ওকে কেউ বুলি করলে রুখে দাঁড়াতাম। কাজের ছুটিতে কলকাতা গেলে ওর সঙ্গে দেখা করতাম। ওর বাড়ি খুবই রক্ষণশীল ছিল। তখন আমি শনিবার করে দুর্গাপুর থেকে কলকাতায় আসতাম। হাওড়াতে নেমে কখনও বাস ধরে শিয়ালদহ, কখনও বা যাদবপুরে দেখা করতাম। ’৯৮-এ কলকাতায় ট্রান্সফার হওয়ার আগে ’৯৩-’৯৪-এ আমরা দু’জন মিলে একটা ফ্ল্যাট কিনি। ’৯৬ সালে সেই ফ্ল্যাটটা হাতে পাই। আমরা ১৭ শতাংশ ইন্টারেস্টে হোম লোন নিয়েছিলাম। এবং সেটাও আমার নামে নিতে হয়েছিল। ব্যাঙ্ক থেকে বারবার বলেছিল, দু’জনের নামে লোন নিতে, বদলে নিজেদের মাসতুতো বোন হিসাবে পরিচয় দিতে হবে। আমরা সেটা কিছুতেই মেনে নিইনি। ওরা বলেছিল, ম্যাম দিস ইজ নট আমেরিকা, দিস ইজ ইন্ডিয়া। আমি বলেছিলাম, এটা ইন্ডিয়া বলেই আমাদের আরও বেশি করে নিজেদের কথা বলা দরকার। তার ঠিক দশ বছর বাদে জয়েন্ট লোন হাসিল করেছি। বহুজনকে বলেছি, আমাদেরকে দেখিয়ে তোমরা লোন পাবে, রাষ্ট্র যাই বলুক। পরে আমরা সব জায়গায় পরস্পরকে নমিনি করেছি।
এই সময়ের কলকাতার সঙ্গে সেই সময়ের কলকাতার নিশ্চয়ই অনেক ফারাক। কেমন ছিল সেই সময়টা? কুইয়ার মানুষদের কী কী সহ্য করে হত?
তখন এমন সময় ছিল, যে দুটো মেয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে লোকে ভাবত বন্ধু। তারা হয়তো বা লেসবিয়ান হতেও পারে– এটা কেউ ভাবতে পারত না। এখন আবার উল্টো। একটা মেয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে রাস্তা দিয়ে গেলে তাকে হয়তো লেসবিয়ান বলবে। ততদিনে আমি আর আকাঙ্ক্ষাও বুঝে গিয়েছি যে, আমাদের মধ্যে শুধুই বন্ধুত্ব নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু রয়েছে। এরই মধ্যে ১৯৯৮-এ ‘ফায়ার’ মুক্তি পায়। আমার মনে আছে, আমরা চ্যাপলিন হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতাম যদি আমাদের মতো কাউকে দেখতে পাই। পাইনি । গে গ্রুপ ‘কাউনসেল ক্লাব’-এর খোঁজ পেয়ে সেখানে মাঝেমধ্যে যেতাম। কিন্তু ওখানে যারা আসত, তারা খুব হই-হুল্লোড়ে মেতে থাকত। সেখানে আমাদের নিজেদের মনের কথা বলার বিশেষ সুযোগ ছিল না। ওদের সব বিশ্বাসের সঙ্গে মেলাতেও পারতাম না। একটা হায়ারার্কি থাকলেও মানুষগুলো ভালো ছিল। তবে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক বোধ খুব একটা প্রগাঢ় ছিল না। তাই আমরা খুব বেশিদিন ওখানে যাইনি। কিন্তু ওদের মাধ্যমেই এক বাংলা দৈনিক সংবাদপত্র আমাদের ইন্টারভিউ নিতে চায়। আমরা শর্ত দিয়েছিলাম, সেক্ষেত্রে কাউনসেল ক্লাবের পোস্টবক্স নাম্বার দিতে হবে।
এটায় তো রিস্ক ছিল…
খুব রিস্কি ছিল ব্যাপারটা। কারণ আমরা তখন সবাই ক্লজেটেড, অর্থাৎ কেউ আমরা প্রকাশ্যে নিজেদের যৌন পছন্দের কথা বলতে পারতাম না। আকাঙ্ক্ষা প্রথম শুনে ভয় পেয়েছিল। কারণ ওর বাড়ি সাংঘাতিক গোঁড়া। যাই হোক, ওরা সাক্ষাৎকারের সঙ্গে পোস্টবক্স নাম্বার দিতে রাজি হয়। ৩ এপ্রিল, ১৯৯৯ ইন্টারভিউটা বেরয়। আমাদের নেওয়া রিস্ক কাজে লাগে। পোস্টবক্স নাম্বারে তিনশোরও বেশি চিঠি এসেছিল। অনেকেই ঠিকানা বা ফোন নাম্বার দেয়নি। যারা দিয়েছিল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। মূলত ছয়জন মিলে তৈরি হল ‘স্যাফো’। আবির-সাগরিকা, পিয়া-কিকি এবং আমি আর আকাঙ্ক্ষা মিলে সাপোর্ট গ্রুপ তৈরি করে ফেলি। ব্রিটিশ কাউন্সিল ‘ব্রেকিং দ্য সাইলেন্স’ নামক একটা সেমিনারের আয়োজন করে ‘স্যাফো’-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে। সেটা বেশ শোরগোল ফেলে দিয়েছিল সে সময়ে। ব্রিটিশ কাউন্সিলের ছাদটা আমাদের বাড়ি হয়ে গিয়েছিল। অফিস ফেরত সবাই গিয়ে ওখানে জড়ো হতাম। আস্তে আস্তে, এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে আমরা ৩০ জন হলাম। সবাই মিলে প্রথম আমরা মিটিং করলাম, সেটা ২০ জুন। সেটাই স্যাফোর জন্ম তারিখ। তখন স্যাফো কেবলমাত্র একটা সাপোর্ট গ্রুপ। বন্ধুত্বের, সমমানসিকতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া। নানা ফন্দিফিকির করতাম, যেমন বিয়ে ভাঙার একশো আট উপায় (হাসি)। নানা ধরনের মানুষ যোগাযোগ করতেন সাহায্য চেয়ে। কেউ কেউ স্রেফ কথা বলে দু’দণ্ড শান্তি পেতেন। সেই গল্প বলে শেষ করা যাবে না।
২৫ বছর ধরে ‘স্যাফো’ কীভাবে এগিয়েছে?
লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল উইমেন এবং পরবর্তীকালে ট্রান্স-ম্যাসকুলাইন পার্সনদের ওপর হওয়া হিংসাকে অ্যাড্রেস করা, তাদের ইমোশনাল সাপোর্ট দেওয়া– এটাই ছিল মূল কাজ। তখনও আমরা ‘মৈত্রী’-র সদস্য ছিলাম। আবির এবং আকাঙ্ক্ষা নিয়মিত যেত ওখানে। মেয়েদের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। এবং আমরা বরাবর বলে এসেছি, যে কোনও মেয়েদের ইস্যুতেই আমাদের অংশ নিতে হবে। ইনক্লুসিভিটির কথা বলতাম সবক্ষেত্রে, সবাইকে নিয়ে পথ চলার কথা, সবাইকে গ্রহণ করা। আমরা সবসময়ই নারীবাদী কাঠামোর মধ্যে থেকেই কাজ করতে চেয়েছি। আমি নিজেও নারীবাদী। একদম শুরুর দিকে আমাদের কাছে কোনও উদাহরণ ছিল না, জানতাম না কীভাবে কাজটাকে এগিয়ে নিয়ে যাব। তখন ইন্টারনেটও নেই। নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে কাজ করেছি। তখন আমরা ফ্লুরোসেন্ট স্টিকার বানাতাম। ‘আপনি কি মেয়ে হয়ে আরেকজন মেয়েকে ভালোবাসেন? অমুক হেল্পলাইনে ফোন করুন’। সেইসব স্টিকার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের টয়লেটে, সিনেমা হলে, বাসের লেডিস সিটে, ট্রেনে সেঁটে দিয়ে আসতাম। কোলাবরেটিভ অনুষ্ঠানও করতাম অনেক। বহু স্বেচ্ছাসেবক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সেসময়ে। স্বেচ্ছাসেবক সংস্থা ‘স্বয়ম’ বলল আমরা সপ্তাহে একদিন, দু’-ঘণ্টার জন্য টেলিফোন দেব। সেটাই আমাদের প্রথম হেল্পলাইন। এক সংস্থাকে আর্জি জানালাম, ‘হোম’-এ বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া সমকামী মেয়েদের আশ্রয় দিন। অন্যদের রিকোয়েস্ট করলাম জীবিকার ব্যবস্থা করুন, তা সে যত ক্ষুদ্রই হোক। ৩৭৭ ধারা থাকা সত্ত্বেও প্রান্তিক মানুষদের ওপর হওয়া হিংসাকে ‘মৈত্রী’-র সঙ্গে জোট বেঁধে অ্যাড্রেস করা শুরু করলাম। যারা গার্হস্থ্য হিংসার শিকার হয়ে সাহায্য চাইতে আসত, তারা বেশিরভাগই মফসসলের মানুষ। কেউ আসছে কাঁথি থেকে, হলদিয়া থেকে, কুলটি থেকে, আসানসোল থেকে। বাড়ি থেকে লুকিয়ে এসে তারা মিটিংয়ে যোগ দিত। বিয়ে এড়ানো, নিজের পায়ে দাঁড়ানো– এই ধরনের পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করতাম। কীভাবে সিস্টেমের মধ্যে থেকে বেঁচে থাকা যায়, সেই কৌশল বোঝানোর চেষ্টা করতাম। আমরা উপার্জন করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর ওপর জোর দিতাম বেশি। আমাদের বাড়িতেই মিটিং হত। ছোট্ট ঘরে উপচে পড়ত ভিড়। কত অল্পবয়সিরা আসত দূর-দূর থেকে।
এখন তো স্যাফো বা এলজিবিটিকিউ আন্দোলন বড় জায়গা তৈরি করে নিয়েছে সমাজে। কীভাবে আন্দোলনের জায়গাটা তৈরি করলেন আপনারা?
আমরা নানা ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছি। বহু ছাত্র-ছাত্রী আমাদের সঙ্গে ‘স্বকণ্ঠে’ বিক্রি করেছে বইমেলায়। এই ‘অ্যালাইশিপ’ তৈরি করতে বহু সময় লেগেছে। একদিনে হয়নি। ‘লেসবিয়ান রাইটস, হিউম্যান রাইটস/ লেট আস জয়েন লেট আস ফাইট’– এই স্লোগান নিয়ে আমরা রাস্তায় নেমেছিলাম। সেটা ছিল ‘সেভেন্থ ন্যাশনাল কনফারেন্স অফ অটোনমাস উইমেন মুভমেন্ট’। ২০০৬ সালে কলকাতায় আয়োজিত হয়। ‘স্যাফো’-র দায়িত্ব ছিল ৩০০০ অংশগ্রহণকারীর অ্যাকোমোডেশনের দায়িত্ব। এই কনফারেন্সে সেই প্রথম ‘সেক্সুয়াল এক্সপ্রেশন’-এর বিষয়টা অফিশিয়ালি স্থান পেল। সময়ের সঙ্গে কাজের ধরন পাল্টাতে হয়েছে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছে। মূলত আমাদের কাজ ছিল ‘সেনসিটাইজেশন’, সংবেদনশীলতা। এখনও তাই। আমাদের মনে হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে যদি ‘আইপিসি ৩৭৭’-কে চ্যালেঞ্জ করতে হয়, তাহলে জাতীয় স্তরে করতে হবে। আমাদের রিসার্চওয়ার্ক করে ডকুমেন্ট বানাতে হবে। এই যে একের পর এক সমকামী মেয়ের সুইসাইড– সেইসব ঘটনা জড়ো করে ‘ফ্যাক্ট বেজড’ ডকুমেন্ট তৈরি করেছি। সেইসব বিভিন্ন রিপোর্ট সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছে যখন জাতীয় স্তরে আমাদের পিটিশন ফাইল করা হয়। আমরা তিনটে ন্যাশনাল ‘এলবিটি’ মিট করেছি। এই পঁচিশ বছরে ডিজিটাল মুভমেন্টের একটা শক্তিশালী উপস্থিতি তৈরি হয়েছে আর পাশাপাশি ‘কার্সার মুভমেন্ট’-এর চটকদারি এসেছে। আমরা মজা করে বলি, ‘কার্সার মুভমেন্ট’। অর্থাৎ, সোশাল মিডিয়ায় ঘরে বসেই বিপ্লব করা। সবটাই ওপর-ওপর। কিচ্ছু না জেনে, খোঁজ না করে, গুগল সার্চ করে যা উঠল কপি পেস্ট করে দিলাম। এটারও চল আছে। সোশাল মিডিয়ার যেমন জোরালো অবদান আছে, তেমন সেটার ভিতর একটা শূন্যতাও আছে। পথে নামা অনেক কমে গিয়েছে।
এখন তো পরবর্তী প্রজন্মও শক্তিশালী হয়ে এগিয়ে এসেছে ‘স্যাফো’-তে, নতুন প্রজন্ম কীভাবে কাজ করছে? তাদের পথচলার কথা জানতে চাই।
কাজ করতে গিয়ে আমার মনে হয়েছিল আমাদের পরবর্তী জেনারেশন তৈরি করতে হবে, যেভাবেই হোক। আমরা যখন থাকব না, এবং এই সংস্থা হঠাৎ ভ্যানিশ হয়ে যাবে– এটা হতে পারে না। ’৯৯ সালে আমরা ছিলাম সাপোর্ট গ্রুপ– ‘স্যাফো কালেকটিভ’। বাট দিস ওয়াজ নট এনাফ। আমাদের অধিকার দাবি করতে হবে। হিংসা ও অত্যাচার রুখতে আমাদের সামনে এগিয়ে আসতে হবে জোরালোভাবে। ২০০৩-এ তৈরি হল ‘স্যাফো ফর ইকুয়ালিটি’-র প্ল্যাটফর্ম, যেটা অ্যাক্টিভিস্টদের প্ল্যাটফর্ম। ‘লেসবিয়ান’, ‘বাইসেক্সুয়াল উইমেন’ এবং ‘ট্রান্সম্যাসকুলাইন পার্সন’-দের অধিকার আদায়ের উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি। যারা স্বেচ্ছায় এই অ্যাক্টিভিজমে যোগ দিতে চায়, তারাই এগিয়ে আসবে– এমন কথা হল। কিন্তু কাউকে জোর করা হবে না। সেক্সুয়াল এক্সপ্রেশন বা জেন্ডার ওরিয়েন্টেশন যাই হোক না কেন– যে কেউ যোগ দিতে পারবে। এখনও এই নিয়ম। এখন জুন মাস এলেই, চাকরির প্রতিশ্রুতির ঢল নামে। কারণ প্রান্তিক যৌনতার মানুষের চাকরি দেওয়া এখন নিয়ম হয়েছে। সব বড় বড় সংস্থা সেই ‘বক্স’-এ টিক মারতে চায়। এর সঙ্গে কিন্তু পরোক্ষভাবে যোগ রয়েছে ‘পিঙ্ক মানি’ র। আমাদের দ্বিতীয় প্রজন্ম এই কর্পোরেট দুনিয়ার সঙ্গে নেগোশিয়েট করে। আমরা যখন কাজ শুরু করেছিলাম, তখন এসবের ধারেকাছে ঘেঁষতে চাইনি। কারণ খুব অল্প ফান্ড নিয়ে কাজ করেছি, তাই সেটা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু এখন কোয়েল, নীলদের মধ্যস্থতা করতে হয় বৃহত্তর স্বার্থে। তবে আমাদের স্ট্যান্ড খুব পরিষ্কার, নিজেদের ভাবমূর্তি সাফাইয়ের জন্য আমাদের ব্যবহার করলে চলবে না, সেনসিটাইজেশন প্রোগামের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এইভাবেই কত লেসবিয়ান, বাইসেক্সুয়াল মহিলা, ট্রান্স ম্যাস্কুলাইন ব্যক্তিরা উপকৃত হচ্ছে। কিন্তু ২৫ বছর পর আগামী দিনে টিকে থাকতে গেল নিজেদের অ্যাডাপ্ট করতেই হবে। আজ থেকে কুড়ি বছর আগে সেসব কোথায়! সেই সময় ‘সংলাপ’– এনআইএফটি-তে একজনকে ফ্রি অফ কস্ট কোর্স করতে সাহায্য করেছিল। মেয়েটি ভালো আঁকত। সেই শিক্ষাগত যোগ্যতা থেকেই সে এখন উপার্জন করছে। আমাদের ‘Referral Networking’ খুব স্ট্রং ছিল। যেহেতু সমস্ত ইস্যুতে সবার পাশে থাকতাম, তাই অন্যান্য সংস্থাও আমাদের পাশে দাঁড়াল।
কুইয়ার মানুষদের প্রতি হিংসা আজ নতুন নয়। এই ২৫ বছরে অনেক কিছুই কাছ থেকে দেখেছেন। কিছু ঘটনার কথা শুনতে চাই। এই পঁচিশ বছরে কিছু কি বদলেছে?
একটা ঘটনার কথা বলি। বারসতের ঘটনা, দু’টি মেয়ে– তারা প্রেম করত। একজনের বাবা ছিল ডাকসাইটে প্রোমোটার। অন্য মেয়েটি থাকত তার জেঠুর বাড়িতে। নিজের ভাই ও জেঠুর ছেলের সঙ্গে বড় হয়েছিল। একদিন এই মেয়ে দু’টির ব্যক্তিগত চিঠি দুই ভাইয়ের হাতে পড়ে যায়। তারা হুমকি দেয় অন্য মেয়েটির বাড়িতে জানিয়ে দেবে। এই হুমকি দিয়ে জ্যাঠতুতো দাদা এবং নিজের ভাই মিলে ধর্ষণ করত মেয়েটিকে, দিনের পর দিন। মেয়েটি মুখ বুজে সেটা সহ্য করত, অন্য মেয়েটিকে বাঁচাবে বলে। আমার সঙ্গে দেখা হওয়ার কিছু দিন পরেই মেয়েটির বিয়ে হয় এবং বিয়ের এক মাসের মধ্যে সুইসাইড করে। এইরকম অসংখ্য ঘটনা আছে। হুগলির ঘটনা বলি। সেখানে মা নিজের মেয়ের ব্যাপারে জানতে পেরে বাড়িতে দুষ্কৃতী এনে মেয়েটির ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা দিয়ে দেয়। এবং বলে, ‘যা গিয়ে সিঁদুর পরিয়ে দে’। অর্থাৎ, মেয়েটিকে কোনও দুষ্কৃতী ভোগ করলেও মাফ, কিন্তু অন্য মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসা মেনে নেবে না। মেয়েটি বুদ্ধি করে বিয়েতে সম্মতি দেয়, কিন্তু শর্ত দেয় পরের দিন জনসমক্ষে সিঁদুর পরাতে হবে। সেই রাতেই মেয়েটি বাড়ি থেকে কিছু টাকা আর জামাকাপড় নিয়ে পালায়। অনেক রাতে হাওড়া পৌঁছে আমাদের বাড়িতে ফোন করে। সকালে মেয়েটি আমাদের বাড়ি চলে আসে। ও আমাদের সঙ্গে অনেকদিন ছিল। এমন ঘটনার কোনও শেষ নেই। আরও এক ঘটনা না বললেই নয়। মেয়েটি সমকামী বলে, বাবা-মা তার অফিসে গিয়ে বলে এসেছিল আমাদের মেয়ে লেসবিয়ান, ওকে স্যাক করুন, নইলে অন্য মহিলারা বিপদে পড়বে। এটা কিন্তু মফসসলে নয়, কলকাতার ঘটনা। তখন বুঝেছিলাম শুধু চোখের জল মুছিয়ে হবে না, নারীবাদী আন্দোলনের মধ্যে আমাদের নিজেদের জায়গা তৈরি করতে হবে। বামপন্থা ‘রোটি কপড়া অউর মকান’-এর কথা বলে। মেয়ে সমকামী বলে পুরুষকে বিয়ে না করতে চাইলে, তাকে বাড়ি থেকে বের করে দিচ্ছে। সেটাও তো ‘রোটি কাপড়া মকান’-এর হক থেকে বিচ্যূত করা। কোভিডের পর এই কুইয়ার মানুষগুলো আরও বেশি সমস্যায় পড়ল চাকরি খোয়ানোর পর। সেই সময় কোয়েল, নীল, অর্চি, মধুরিমা, ঋ, কলিকা, অঙ্কনা ও বাকি যারা আছে নানাভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল। কোভিডে চাকরি চলে যাওয়ায় বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয় এক যুগলকে। সেই ট্রান্স ম্যাসকুলাইন পার্সন তার পার্টনারকে নিয়ে গড়িয়াহাটের ব্রিজের তলায় কলের জল খেয়ে কাটিয়েছে তিন রাত। আমরা রেসকিউ করি। এমনও হয়েছে, ভরা কোভিডে, আমরা পুলিশ পারমিশন নিয়ে বিয়ে আটকেছি হলদিয়াতে গিয়ে। পিতৃতন্ত্র এমন বস্তু, ভরা কোভিডে মানুষ মারা যাচ্ছে, কিন্তু বিয়ে আটকাচ্ছে না। ২০২৩ সালে কুইয়ার ক্যান্টিন ‘পড়শী’র জন্ম হল। এটা একই সঙ্গে ট্রেনিং প্রোগ্রাম ভেন্যু, লাইব্রেরি, পারফরম্যান্স সেন্টার এবং সাবসিডাইজড ক্যান্টিন।
স্যাফো-র প্রতি বিশ্বাস, ভরসা আছে বলে অনেকেই কি সাহস পাচ্ছে না?
সময়ের সঙ্গে একটা পরিবর্তন হয়েছে, অনেকেই বেপরোয়াভাবে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে গ্রহণযোগ্যতা নেই বলে, অত্যাচারিত হচ্ছে বলে। সেটা আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কম হত। আর আমরা এখন পুলিশের সাহায্য নিতে পারি ৩৭৭ উঠে যাওয়ার পর। আজকের স্যাফো আইনি লড়াই লড়তে অনেক বেশি প্রিপেয়ারড। আমি নিজে পিটিশনার ছিলাম ‘ম্যারেজ ইকুয়ালিটি অ্যাক্ট’-এর লড়াইয়ে। গত পঁচিশ বছরে অনেক কিছু বদলালেও, এই প্রান্তিক মানুষদের ওপর হিংসা আবহমান। ২০২৩ সালে দিল্লিতে হওয়া ‘জন সুনওয়হি’-তে অ্যাক্টিভ মেম্বার হওয়ার ফলে, হিংসার কাহিনি আক্রান্তদের মুখ থেকে শুনেছি। সেখানেও সেই এক গল্প। ভাই বোনকে ধর্ষণ করছে। মেয়েটা জানায়, ‘আমার মা জানত যে, ভাই আমাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষণ করে, তবু আমাকেই মিথ্যেবাদী বলেছে মা।’ তারপর মেয়েটি তার প্রেমিকার সঙ্গে পালিয়ে আসে। ওই দুটো দিন ধরে শুনেছি দীর্ঘ হিংসার কাহিনি। আসলে শুধু আইনি রিফর্ম নয়, মানুষের, এই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো প্রয়োজন।
পিকাসোর গের্নিকাকে দুর্গার চালচিত্রে ব্যবহার করেছি সময়ের দাবি মেনেই
২৫ অক্টোবর, জন্মদিন পাবলো পিকাসোর। সদ্য শেষ হওয়া দুর্গাপুজোয়, সনাতন দিন্দা দুর্গাপুজোর চালচিত্র হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন পিকাসোর ছবি: ‘গের্নিকা’। ১৯৩৭ সালের এই ছবি কীভাবে আজকে জরুরি হয়ে উঠল?