রানির মূর্তির আদর্শ হিসেবে ভেনাস নয়, পরিবর্তে শিল্পী বাছাই করেছিলেন গ্রিক দেবী অ্যাথেনার মূর্তিকে। কারণ, অ্যাথেনা হলেন বিজয়ীর প্রতীক। আসলে কোম্পানির শাসন যখন এদেশের মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছে, দিকে দিকে সিপাই বিদ্রোহের গনগনে আঁচ যখন এদেশের মানুষের হৃদয়ের উত্তাপকে স্তিমিত করেনি, এরকম সময় রানি ভিক্টোরিয়া এলেন শাসনভার হাতে নিয়ে। সকলেই মনে করলেন, এবার শুরু হল ‘ভারতের ভাগ্যাকাশে সুদিনের ঘনঘটা’।
১০.
কলকাতা তখন ভিক্টোরিয়াময়। গায়নে-বাদনে, সিগারেটের কার্ডে, বাড়ির দেওয়ালে কিংবা রাস্তায় তখন কলকাত্তাইয়া ভিক্টোরিয়া যুগ গমগম করছে। এখনও ভারতীয় যাদুঘরে দেখা মেলে সেই যুগের সাক্ষী একখানি কুইন ভিক্টোরিয়ার মূর্তি। দৃপ্ত ভঙ্গিতে পা ফেলে ফেলে এদেশের মানচিত্রে যেন তাঁর সগৌরব আগমন। ইংরেজ ভাস্কর মার্শাল উড এদেশের মানচিত্রে সম্রাজ্ঞীর উজ্জ্বল উপস্থিতির গন্ধকে বুনে দিয়েছিলেন শ্বেতপাথর মানে ‘স্টোন অব লাইট’-এর গায়ে।
১৮৭৫-এ মূর্তিটি খোদাই করেন উড। এর পরে ১৮৭৭-এ ‘ইম্পিরিয়াল অ্যাসেম্বলেজ’ প্রদর্শনী উপলক্ষে ভাস্কর উড স্বয়ং এটি জাহাজ বয়ে নিয়ে এসেছিলেন দিল্লিতে। ওই বছরই ভিক্টোরিয়া ভারত সম্রাজ্ঞী অর্থাৎ ‘এম্প্রেস অব ইন্ডিয়া’ উপাধি পান। সেই উপাধি গ্রহণ উপলক্ষে বর্ধমানরাজ মহ্তাবচন্দ্ প্রদর্শনী থেকে মূর্তিটি কিনে উপহার দিলেন ইংরেজ সরকারকে। তাঁর ইচ্ছে কলকাতায় ভিক্টোরিয়ার মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হোক।
সেইমতো ইংরেজ সরকার ঠিক করেন ভিক্টোরিয়ার ভারত-সম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণের প্রথম বার্ষিকী উদযাপনের সময় অর্থাৎ, ১৮৭৮-এ এই মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হবে ভারতীয় জাদুঘরে। সেই মতো দিনক্ষণ ঠিক করে এলেন ভাইসরয় লর্ড লিটন, মূর্তি উন্মোচিত হল। সঙ্গে বর্ধমান-রাজাকে ধন্য ধন্য করলেন সবাই। সেই থেকে আজও উদযাপনের ভিক্টোরিয়া মূর্তি সময়ের ‘কাহানি’ বলতে বলতে জাদুঘরে ‘চলমান’। রানির অভিষেকের সময়ের মূর্তি বলেই এমন মূর্তিতে ধরা পড়েছে তাঁর যৌবন বয়সের সতেজতা।
কিন্তু এমন যৌবন সতেজ মূর্তির আদর্শ কোথায় পেলেন উড?
এই প্রশ্নের উত্তরেই আমাদের আশ্চর্য ভাবে ফিরে যেতে হয় উডের শিল্প ভাবনার দিকে। না, রানির মূর্তির আদর্শ হিসেবে ভেনাস নয়, পরিবর্তে শিল্পী বাছাই করেছিলেন গ্রিক দেবী অ্যাথেনার মূর্তিকে। কারণ, অ্যাথেনা হলেন বিজয়ীর প্রতীক। আসলে কোম্পানির শাসন যখন এদেশের মানুষের মনে বিদ্রোহের আগুন জ্বেলেছে, দিকে দিকে সিপাই বিদ্রোহের গনগনে আঁচ যখন এদেশের মানুষের হৃদয়ের উত্তাপকে স্তিমিত করেনি, এরকম সময় রানি ভিক্টোরিয়া এলেন শাসনভার হাতে নিয়ে। সকলেই মনে করলেন, এবার শুরু হল ‘ভারতের ভাগ্যাকাশে সুদিনের ঘনঘটা’। আর তাই তিনি আসছেন বিজয়ীর ভঙ্গিতে। আনন্দে আবেগে পাথুরেঘাটার মহারাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর প্রকাশ করলেন ‘ভিক্টোরিয়া গীতিমালা’। ছাউনির দিশি সিপাইদেরও বার্তা দেওয়া গেল এবার নতুন যুগের সূচনা। তাই সব মিলিয়ে ভিক্টোরিয়ার এই জয় যুদ্ধক্ষেত্রের জয় নয়, এই জয় এদেশের মানুষের হৃদয় জয় করার জয়। যার ডানহাতে রাজদণ্ড, যে রাজদণ্ড বণিকের মানদণ্ড নয়। তাই ভিক্টোরিয়া হলেন এদেশের মানুষের মন জয়ের অ্যাথেনা। সেই স্বপ্নই বুনে দেওয়া হল শ্বেতপাথরের শরীরে।
তথ্য সূত্র: The Hindoo Patriot, December, 31 1877
ছবি: আলোক নূর ইভানা
…. ভাবমূর্তি-র অন্যান্য পর্ব ….
পর্ব ৯। মূর্তি দিয়েই লর্ড বেন্টিঙ্ককে প্রতিষ্ঠা করা হল সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদকারী হিসেবে
পর্ব ৮। কলকাতায় ইংরেজ স্থাপত্যের অভিনব জলের ফোয়ারা, কিন্তু সিংহের আদল কেন?
পর্ব ৭। আরেকটু হলেই নিলামে উঠতেন ভাইসরয় মেয়োর মূর্তি!
পর্ব ৬। হাইকোর্টের থামের নকশায় প্রতিফলিত ইংরেজের ভাবমূর্তি
পর্ব ৫। ইংরেজ ভাবনার জীর্ণ স্মৃতি নিয়ে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের রোমান ‘মিনার্ভা’
পর্ব ৪। ত্রিবেণী টোলের পণ্ডিত উজ্জ্বল করলেন হেস্টিংসের ভাবমূর্তি
পর্ব ৩। বঙ্গভঙ্গের ছায়া মুছতে অঙ্গমূর্তির পরিকল্পনা করেছিলেন লর্ড কার্জন
পর্ব ২। হেস্টিংসের মূর্তি আসলে অত্যাচারীরই নতুন ভাবমূর্তি
পর্ব ১। শাসককে দেবতা বানানোর অভিপ্রায়েই কলকাতায় পথে-প্রান্তরে ইংরেজরা বসিয়েছিল মূর্তি
রিয়েঙ্কা ইউক্রেনের স্থানীয় ফুটবল দল নাইভা-র হয়ে গলা ফাটাত মাঠে গিয়ে। যুদ্ধের সময় চার মাস রুশ সেনার অধীনে বন্দিত্ব এবং ছাড়া পেয়ে ফ্রন্টলাইনে রাইফেল নিয়ে থাকা। গত ২১ মে মাত্র ২১ ছোঁয়া রিয়েঙ্কা চলে যায় গানশটে! গ্যালারিতে সেই মুখ, টিফো– লেখা– ‘পিস হ্যাজ আ প্রাইস’।