বাংলার এই ‘অন্য ধারার রথকাররা’ প্রচারের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে থেকে গেলেন। শিল্পের কৌলিন্যের মর্যাদা তাঁরা কোনওদিনই পাননি। অথচ একাগ্র চিত্তে বাংলার এই লুপ্ত হতে বসা শিল্পকে নিজেদের হাতে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেদের নান্দনিক সত্তাটিকে প্রবলভাবে উজ্জীবিত রেখেছেন। শিশু-কিশোরদের ঐক্যবদ্ধ আনন্দই আজও এই শিল্পের প্রাণভোমরা।
এ রথের আগে কোনও রাজা এসে সোনার ঝাড়ু দিয়ে রাস্তা পরিষ্কার করেন না। এ রথে নেই কোনও জনসমুদ্র। পুলিশের ব্যারিকেড, নিশ্চিদ্র নিরাপত্তার প্রয়োজন হয় না এ রথের জয়যাত্রায়। মন্ত্রোচ্চারণের থেকেও বেশি এ রথের শোভা বাড়িয়ে চলে শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের কলকাকলি। এ রথের মধ্যেই বঙ্গ জীবনের শৈশবগুলো মাধুর্য পায়। আর তথাকথিত বাচ্চাদের এই রথের মধ্যেই বাঙালি একটা সময় তার সৃজনশীলতাকে পূর্ণতা দিত। কৌলিন্য ও শারীরিক উচ্চতায় তথাকথিত বনেদিবাড়ির রথের থেকে এই রথ আকারে ছোট হলেও, তার শরীরে শিল্পের ছোঁয়া অনিন্দ্য হয়ে উঠত। কিন্তু কালের করাল গ্রাসে শহর ও শহরতলিতে বাঙালির এই ছোট রথগুলিতে আর সেই শিল্পের মাধুরী নেই। এখন তার শরীর গোটাটাই রঙিন সেলোফেনে মোড়া। কাঠের বদলে সেখানে স্থান পেয়েছে প্লাস্টিকের ঘোড়া। চাকাতেও নেই কাঠের কৌলিন্য। শহুরে শৈশবের ভরসা প্লাস্টিকের চাকা।
কিন্তু আজও এ বঙ্গভূমিতে এমনও কিছু জেদি রথকার রয়ে গিয়েছেন যাঁরা সময়ের চাহিদাকে তোয়াক্কা না করে সৃজন ও মননশীলতার তুঙ্গস্পর্শী পর্যায়ে নিজেদের নিয়োজিত করেছেন। তাঁদের নির্মিত শিশুদের জন্য ছোট রথের মধ্যে আজও নান্দনিকতা বিরাজ করে। আধুনিক বাঙালির কাছে কলকাতা সাংস্কৃতিক রাজধানী হলেও বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর কিন্তু তার গরিমা আজও বজায় রেখেছে। স্থাপত্য, শিল্প, সংগীত, সাহিত্য– সবেতেই আবহমান সময় ধরে বাংলার মুখ উজ্জ্বল করে এসেছে মল্ল রাজাদের স্মৃতি-বিজড়িত বিষ্ণুপুর। আর এই প্রাচীন জনপদের বুকেই অনিন্দ্যসুন্দর রথ নির্মাণ করে চলেছে চকবাজার বাহাদুরগঞ্জ সূত্রধর পাড়ার দুই ভাই তপন ও স্বপন শীল। পিতা গোবিন্দ শীলের থেকে রথ তৈরি কৌশল শিখেছিলেন তাঁরা। রথ নির্মাণে সেই ধারা বজায় রেখে চলেছেন।
রথ নির্মাণের ক্ষেত্রে শিরীষ, আম, চাকলদা, আকাশমণি কাঠ ব্যবহার করা হয়। বছরের অন্যান্য সময়ে কাঠের ব্যবহারিক আসবাব তৈরি করলেও রথের সময় তাঁদের ব্যস্ততা আরও বেড়ে যায়। স্বপন শীল জানিয়েছেন, এ বছর তিনি প্রায় ২৫০-টার মতো রথ তৈরি করেছেন। ফাল্গুন মাস থেকে কাজ শুরু হয়েছে। অন্যদিকে ছোট ভাই তপন শীল জানিয়েছেন যে তাঁর তৈরি রথের সর্বোচ্চ উচ্চতা সাড়ে তিন ফুট এবং সর্বনিম্ন উচ্চতা এক ফুট। বিষ্ণুপুরের ঐতিহ্যশালী পোড়ামাটির মন্দির শৈলীর অনুরূপ রথ নির্মাণ করেন তাঁরা। তাঁদের তৈরি রথের মাথায় পাঁচটি পতাকা স্তম্ভ। যা বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরের পঞ্চরত্ন শৈলীর কথা মনে করিয়ে দেয়। রথের প্রবেশদ্বার পোড়ামাটি মন্দিরের খিলানের মতো করা হয়েছে। খিলানের গায়ে ও রথের অন্যান্য অংশে ফুল ও লতাপাতা আঁকা হয়েছে। এতে রথ নির্মাণের লোকজ ভাব ফুটে উঠেছে। রথের প্রতিটা তলার ঠিক উপরে চারধারে রেলিং দেওয়া হয়েছে। তুলির টানে সেই রেলিংগুলোকে অনুপম সুন্দর করে তোলা হয়েছে। দোতলা ও তিনতলা রথের ক্ষেত্রে সেই রেলিংগুলোকে অর্ধবৃত্তাকারভাবে বসানো। এতে বাংলার চারচালার মন্দিরশৈলীর বিন্যাসকে বোঝানোর চেষ্টা করে হয়েছে। এই রথগুলির চাকা এবং ঘোড়া কাঠের তৈরি। ঘোড়ার শারীরিক অভিব্যক্তি উদ্যত ভঙ্গিতে ছুটে চলার মতো। দোতলা ও তিনতলা রথের প্রতিটি তলে চারটি করে পতাকা দেওয়া। একতলার সামনের দিকটি প্রসারিত, যেন মন্দিরের প্রবেশপথ। আর সেই প্রসারিত স্থানে রয়েছে সাদা রঙের ঘোড়া। তুলির টানে অলংকৃত। ঘোড়ার কাঁধের সঙ্গে বাড়তি কাঠ দিয়ে রথের একতলার দুই স্তম্ভের সঙ্গে সংযুক্ত করা। এছাড়াও ঘোড়ার পিছন দিককার পায়ের অংশটি রথের সঙ্গে যুক্ত।
তপন শীল এমন একটি রথ তৈরি করেছেন, যেটি প্রকৃত অর্থেই পঞ্চরত্ন মন্দিরশৈলীর বাস্তবধর্মিতাকে বহন করে নিয়ে চলেছে। সেখানে সত্যিকারের মন্দিরের মতোই পাঁচটি চূড়া তৈরি করা হয়েছে এবং চারটি চূড়ার মাথায় একটা করে পতাকা বসানো হয়েছে। পঞ্চম অর্থাৎ যে চূড়াটি রথের একেবারে মাথার ওপর– সেখানে আবার পাঁচটি পতাকা বসানো হয়েছে। এক্ষেত্রে শিল্পীর ধৈর্যশীলতার পরিচয় লক্ষ করা যায়। এঁরা ছাড়া এ-পাড়ার অন্যান্য রথকাররা হলেন শংকর দাস, বাচ্চু সূত্রধর এবং কালোসোনা সূত্রধর।
কবি কৃত্তিবাস ওঝার জন্মভিটে হচ্ছে নদিয়ার ফুলিয়া। এই পরিচয় ছাড়াও শান্তিপুরের প্রতিবেশী এই জনপদ গোটা দেশে তার তাঁতশিল্পের জন্য বিখ্যাত। এখানকার দুই বিশিষ্ট শিল্পী প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে শিশুদের বিনোদনের জন্য ছোট রথ তৈরি করে চলেছে। ফুলিয়ার তালতলার বাসিন্দা রবীন্দ্র সূত্রধর বংশপরম্পরা মেনে রথযাত্রা উপলক্ষে প্রতি বছরের মতো এ বছরও রথ নির্মাণ করেছেন। বছরের অন্য সময় তিনি কাঠের তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাব ও খেলনাগাড়ি তৈরি করে থাকেন। তার কথায়, রথের গায়ে আগে আরও বেশি কারুকার্য করা হত। এখন তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। দশটা রথ তৈরি করতে তিনদিন সময় লাগে। একতলা থেকে পাঁচতলা পর্যন্ত যায় তার তৈরি রথের উচ্চতা। তার তৈরি রথের সর্বনিম্ন উচ্চতা এক ফুট এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা পাঁচ ফুট। যদিও পাঁচ ফুট উচ্চতার রথ বরাত পেলে তৈরি করে থাকেন তিনি। রথ তৈরি করার পাশাপাশি কাঠের তৈরি জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলভদ্রের ছোট বিগ্রহ তিনি তৈরি করেন। রথের সঙ্গে এই বিগ্রহগুলিকে যুক্ত করে দেওয়া হয়। তাঁর তৈরি রথের খিলান নির্মাণ বিশেষ আকর্ষণীয়। বিষ্ণুপুরের রথের মতো সেটি অর্ধগোলাকার নয়। গড়নে ত্রিকোণাকৃতি। খিলানের গায়ে লোকজ শৈলীর আলপনার ছোঁয়া। রথের মেঝেতে লাল রঙ দিয়ে ফুল আঁকা। রথের একদম উপরে একটি চূড়া– সেটির গায়ে তিলক ও জগন্নাথ দেবের দু’টি চক্ষু আঁকা। এই চূড়ার ওপরে বসানো পতাকা দণ্ড। রথের ছাদেও আলপনার হালকা শৈলী মনকে মুগ্ধ করে দিয়ে যায়। রথের চাকা এবং ঘোড়া কাঠের তৈরি। লাল রঙের ঘোড়ার গায়ে সাদা হালকা আলপনা। রবীন্দ্র সূত্রধরের তৈরি রথে ঋজুতা রয়েছে।
অন্যদিকে ফুলিয়ার হসপিটাল পাড়ার বর্ষীয়ান শিল্পী মায়া সূত্রধরের তৈরি রথে বাংলার ঐতিহ্যবাহী আলপনা শৈলীর অবিস্মরণীয় রূপের দেখা মেলে। শিল্পী দক্ষ তুলির টান দিয়ে, ধৈর্য-সহকারে রথের গায়ে, বিশেষ করে মেঝেতে আলপনা এঁকেছেন। সেই আলপনার থেকে চোখ সরানো দায়। রথের খিলান এবং ছাদেও নান্দনিক আলপনা শৈলীর রূপ। রথের স্তম্ভের মধ্যে কাঠের ঘোড়া বসানো। মায়া সূত্রধরের তৈরি রথে দু’টি ঘোড়া থাকে। একেকটি স্তম্ভে একটি করে ঘোড়া। ঘোড়ার গা অলংকৃত। রথের গায়ের রঙ লাল এবং হলুদ। রথের ছাদের চার কোনায় একটি করে চূড়া বসানো। আবার বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে রথের প্রতিটি তলের চার কোনায় এমন চূড়া বসিয়ে থাকেন তিনি। এতে রথের নান্দনিকতা আরো বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। মায়া এবং রবীন্দ্র সূত্রধর দু’জনেই রথের দিন শান্তিপুরের বড়বাজারের রথের মেলাতে নিজেদের তৈরি শিল্পসম্ভার নিয়ে বসেন। দুই শিল্পীই রথ নির্মাণের ক্ষেত্রে শিরীষ, কদম, আম ও কাঁঠাল কাঠ ব্যবহার করেন।
বৌদ্ধ, শৈব এবং বৈষ্ণবধর্মের স্মৃতিবিজড়িত নবদ্বীপে রথযাত্রা এবং তাকে ঘিরে মেলা, লোক উৎসবের চেহারা নেয়। এখানকার রানীচড়া অঞ্চলের মিস্ত্রিপাড়ার প্রায় ১২ জন শিল্পীর তৈরি রথ নান্দনিকতার নিরিখে স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছে। রথের গায়ে বিভিন্ন রঙের খেলা দেখে চোখ জুড়িয়ে যায়। যেহেতু এখানে শিল্পীর সংখ্যা বেশি তাই শৈলীর বৈচিত্রও বেশি। রথের গায়ের প্রাথমিক বর্ণপ্রয়োগের ক্ষেত্রেও বৈচিত্রের দেখা মেলে। খিলান, স্তম্ভ ও ছাদ নির্মাণের ক্ষেত্রেও এই বৈচিত্রের ধারা অব্যাহত। এমনকি রথের গায়ে আলপনা-সহ অন্যান্য অলংকরণের ক্ষেত্রেও এই ধারা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু এই রথে আলাদা করে কাঠের ঘোড়ার দেখা মেলে না।
এখানকার, স্থানীয় শিল্পী গণেশ রায় জানিয়েছেন, প্রায় ৪৭ বছর ধরে রথ তৈরি করে আসছি। কাঠের পাশাপাশি একটা সময় এখানে টিনের তৈরি রথ তৈরি হত। বর্তমানে আসবাব তৈরি করার পর অবশিষ্ট যে কাঠ বেঁচে যায় তা দিয়েই রথ তৈরি করা হয়। রথযাত্রার দু’মাস আগে থেকেই কাজ শুরু হয়ে যায়। আগের তুলনায় চাহিদা বেড়ে গিয়েছে।
পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটালের আড়াগোড়া গ্রামে প্রায় ৪০ বছর ধরে রথ তৈরি করে চলেছেন প্রভাকর প্রামাণিক। পিতা শংকর প্রসাদ প্রামাণিকের থেকে এই রথ তৈরির শৈলী তিনি শিখেছিলেন। এ-বছর বন্যা পরিস্থিতির মধ্যেও প্রায় ১০০-টির মতো রথ তিনি তৈরি করেছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে যদিও বিক্রি গত বছরের তুলনায় ভালো নয় বলে জানিয়েছেন। রথ তৈরি করার ক্ষেত্রে হালকা নরম কাঠ শিল্পীর বেশি পছন্দ। তাঁর তৈরি রথের সর্বোচ্চ উচ্চতা তিন ফুট এবং সর্বনিম্ন উচ্চতা এক ফুট। রথ নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিবারের সকলে এগিয়ে এসেছে তাঁর পাশে। তাঁর রথের প্রাথমিক রঙ হলুদ ও গোলাপি। রথের গায়ে লোকজ শৈলীতে লতা, পাতা, ফুল অংকন করা। সেই অলংকরণে বাংলার আদি অকৃত্রিম গ্রাম্য শৈলীর ভাবনা প্রস্ফুটিত। তাঁর রথের স্তম্ভগুলি দেখলে দক্ষিণ ভারতের প্রাচীন মন্দিরের কথা মনে পড়ে যায়। তাঁর রথ শৈলীতে স্তম্ভের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি মোটা স্তম্ভের সঙ্গে একটি সরু অথচ নান্দনিক স্তম্ভ নির্মাণ করেন তিনি। রথের একেবারে ওপরে মূল চূড়ার সঙ্গে চারটি কোণের যোগসূত্র কাঠ দিয়ে করা হয়। এই শৈলীটি একটা সময় বাংলার অনেক জায়গায় দেখা যেত। রথের চাকা কাঠের হলেও আলাদা করে কোনও কাঠের ঘোড়া ও পতাকা স্তম্ভ নেই। বর্তমানে জলমগ্ন পরিস্থিতির মধ্যেও এই শিল্পী তাঁর সাধনা এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।
নদিয়ার শান্তিপুরের মহাপ্রভু পাড়ায় দুই বরিষ্ঠ শিল্পী সুভাষ এবং প্রভাস পাল মাটি দিয়ে রথ তৈরি করে থাকেন। তাঁদের তৈরি এই ছোট রথে কোনও চাকা থাকে না। তাঁদের তৈরি রথ পুরীর মন্দিরের রথের কথা মনে করিয়ে দেয়। কিছু ক্ষেত্রে তাদের তৈরি রথে বাংলা চারচালা শৈলীর ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। যদিও একটা সময় ছিল যখন বাংলার বিভিন্ন জায়গায় পটুয়ারা মাটির রথ তৈরি করত। এমনকী হুগলি জেলার শ্রীরামপুরে চাকা লাগানো মাটির রথ নির্মাণের ঐতিহ্য ছিল।
বাংলার এই ‘অন্য ধারার রথকাররা’ প্রচারের বৃত্ত থেকে অনেক দূরে থেকে গেলেন। শিল্পের কৌলিন্যের মর্যাদা তাঁরা কোনওদিনই পাননি। অথচ একাগ্র চিত্তে বাংলার এই লুপ্ত হতে বসা শিল্পকে নিজেদের হাতে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তীব্র প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও নিজেদের নান্দনিক সত্তাটিকে প্রবলভাবে উজ্জীবিত রেখেছেন। শিশু-কিশোরদের ঐক্যবদ্ধ আনন্দই আজও এই শিল্পের প্রাণভোমরা।
বাস্তবকে তো শুধুমাত্র আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। পরমাণু এবং তার সংশ্লিষ্ট কণাদের গতিবিধি অনুমান করা বড় সহজ কাজ নয়। লীলা মজুমদার আর প্রফেসর নারলিকারের কল্পনার সমান্তরাল পৃথিবীরা বুঝি-বা এক বাঁকে এসে মেশে, যেখানে কল্পনা এসে বিজ্ঞানের হাত ধরে। জন্ম নেয় কল্পবিজ্ঞান।