ছুটির দিন হোক কিংবা অফিসে কাজের দুপুর, ভাতঘুম চিরকাল বঙ্গজীবনে অঙ্গশোভা। তুলাইপাঞ্জিতেও তার যা ফলাফল, বাসমতী, গোবিন্দভোগেও তাই– ‘খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কোনও তফাত নাই রে ভাই।’ পুজোর ছুটির চারটে দিনে গেরস্তকুলে তার আলাদা আদর। বছরের খামতি মিটিয়ে সে তখন চুইংগামের মতো লম্বা হয়। আশ্বিনের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো স্বপ্নগুলোকে তখন স্পষ্ট দেখায়, নাকের নিচে রয়্যাল এনফিল্ডের গর্জন ঘনায়। তবে জাতে ভাতঘুম ঠিক যেন ইউসুফ পাঠান। রাতঘুমের মতো দ্রাবিড়ীয় ধৈর্য তার নেই। একটু মনঃসংযোগে ব্যাঘাত মানেই ক্লিন বোল্ড! চটকার দফারফা– ‘চিড়িয়া ভাগলবা’!
সে এক কেলেঙ্কারি কাণ্ড!
ইংরেজিতে আমি বরাবরই কাঁচা। মানে, বড্ড কাঁচা! এতটাই যে, এই পাকা বয়সেও সেই কাঁচার কলঙ্ক ঘোচেনি। দু’মুঠো ডাল-ভাত, একটু আলুভাজা– ভবিষ্যতে এটুকুর সংস্থান করতে গেলে ইংরেজি জানাটা জরুরি, এমনটা বিশ্বাস করতাম না। তবে আমার বাবা করতেন। কায়োমনোবাক্যে। আর তাই ভর্তি করে দিয়েছিলেন স্যরের কাছে।
‘স্যর’ মানে, সুবীর স্যর– আমার বাবার বন্ধু। ইংরেজির টিচার। রাশভারী। জাঁদরেল। জহুরি জহর চেনে, স্যর চিনলেন আমাকে। মানে আমার ইংরেজিকে। বুঝলেন, ভরা ক্লাসে লোকশিক্ষে দিয়ে আমার বোধিলাভ হবে না। অতএব, বাগাও ব্যাগপত্তর, এসো দুপুরবেলা।
ভরদুপুর। একতলায় স্যরের কোচিং ক্লাস। সিলিং থেকে ঝুলছে ঝুলখেকো পাখা। ঘটঘটে তার গোঙানি। সেই গোঙানির তলায় একটা আস্ত টেবিল। যার একদিকে স্যর, অন্যদিকে একা আমি। মাঝে ক্লাসওয়ার্কের খাতা। বসা ইস্তক স্যরের ঢেকুর বলে দিচ্ছিল, আজ গুরুকুলে গুরুপাক হয়েছে।
এমনিতেই টেনস নিয়ে টেনশনে থাকি। ভূত-ভবিষ্যৎ ছাড়াও পারফেক্ট-কন্টিনিউয়াস মিলিয়ে একান্নবর্তী পরিবার, সকলের মন ও মান রাখতে গিয়ে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত! ফলে ইংরেজি খাতায় রাইট পাওয়া আমার কাছে সোনার পাথরবাটি। তাছাড়া তখন টিম ইন্ডিয়ার যুগ। রাইট বলতে আমি স্রেফ জন রাইটকেই চিনতাম, কটা চোখের সুদর্শন ভদ্রলোক। আমার স্যর আবার টেরা। তাঁর হাতের উত্তম-মধ্যম গতিপ্রকৃতি আরও টেরাব্যাকা। ফলে ‘প্রমাদে ঢালিয়া দিনু মন’– ইষ্টনাম জপ ছাড়া আমার আর উপায় কী!
এদিকে স্যরের বাগিয়ে ধরা পেন তখনও খাতায় রক্তগঙ্গা বইয়ে দেয়নি। স্টার্টিং পয়েন্টে খাড়া দাঁড়িয়ে। হঠাৎ দেখি, পেন কাটাকুটি না খেলে এক্কেরে উপর থেকে নিচে ধাবমান! সাক্ষাৎ যেন নীল নদ। পথ ভুলে আচমকা আমার খাতায়। ‘নদী তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ’ ভেবে বাষ্প-গদগদ হয়ে যেই না মহাদেবের জটার সন্ধানে সামনে তাকিয়েছি, দেখি, স্যরের কাঁধ ঝুঁকে পড়েছে। মাথা হেঁট! না, আমার ইংরেজির ক্যারিশমায় নয়, ভাতঘুমে!
…………………………………………….
পুজোর ছুটি কাটলে অফিস-ফেরত বাঙালির তাই মনকেমন করে। সেটা হালকা হয়ে আসা ওয়ালেট দেখে যতটা, ঠিক ততটাই ভরদুপুরের হারিয়ে ফেলা ভাতঘুমের জন্যও। তবে বাঙালি আজকাল হেলথ কনশাস। সে আর ভাতঘুম দেয় না, ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নেয়। এ তো ভাতঘুমেরই ছদ্মনাম, সে আর কাকে বোঝাই! আর হেলথের খেয়ালে যদি সে চিয়া সিডস, অলিভ অয়েলে করা স্যালাড চিবোয় দুপুরে, তবে কি ভাতঘুম স্যালাড-ঘুমে পরিণত হবে?
…………………………………………….
এমন দৃশ্য চোখের সামনে দেখে যা করণীয় তাই করেছিলাম। অর্থাৎ, পাখার ঘটঘটে গোঙানি ছাড়িয়ে মাত্রাছাড়া হয়ে গিয়েছিল আমার খ্যাকখেকে হাসি। বাকিটা ইতিহাস! স্যর চটকা ভেঙে হাতের গতিবেগ পরীক্ষা করেছিলেন বোল্টের স্পিডে। সেদিন বুঝেছিলাম, ঘুম জিনিসটা বড্ড কাতুরে। কাউকে কাতর করে, কাউকে কাতরায়।
তবে স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ঘুম আসলে রবি ঠাকুরের গানের মতো– ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’। সেই পাওয়ার আবার ভাগ আছে। রাতঘুম আর ভাতঘুম। রাতঘুম রাতের, ভাতঘুম দুপুরের। ওদের জাতভাই– কালঘুম। কথিত আছে, চোখে নয়, দাম্পত্য কলহে গঞ্জনার ইটবৃষ্টিতে তার দেখা মেলে বেশি। লোকে ‘দিবাস্বপ্ন’ কথাটাকে নঞর্থকভাবে ব্যবহার করে। কিন্তু বাঙালি জানে, দিবাস্বপ্ন সফল করতে ভাতঘুম জরুরি!
দার্জিলিংয়ের তোফা হোটেল হোক কি তেলচিটে বিছানা– বাঙালি চিরকাল ঘুমভক্ত। বিশেষ করে ভাতঘুমের। দুপুরে ‘একটু গড়িয়ে নেওয়া’ কিংবা ‘চোখ লেগে যাওয়া’র মতো আদুরে ডাকেই বোঝা যায়, এত ভঙ্গ বঙ্গদেশ, তবু নিদ্রারসে ভরা। বঙ্গদেশ ছাড়াও দেশের অন্য প্রদেশে ভাতের কদর আছে, তবে ‘ভাতঘুম’-এর পেটেন্ট একান্তই বাঙালির। ঠিক রসগোল্লা যেমন।
………………………………………………
আরও পড়ুন সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়-এর লেখা: দোষে নয়, আলুর গুণে থাকুন
………………………………………………
ভাত আর ঘুমের মধ্যে সম্পর্কটাও পরস্পরের সমানুপাতিক। অর্থাৎ, একটা হাতায় বাড়লে অপরটা মাত্রায় বাড়ে। তখন কোলবালিশকে মনে হয় পুষ্পকরথ। মাথারটিকে নবরত্ন তেল।
ছুটির দিন হোক কিংবা অফিসে কাজের দুপুর, ভাতঘুম চিরকাল বঙ্গজীবনে অঙ্গশোভা। তুলাইপাঞ্জিতেও তার যা ফলাফল, বাসমতী, গোবিন্দভোগেও তাই– ‘খ্রিস্টে আর কৃষ্টে কোনও তফাত নাই রে ভাই।’ পুজোর ছুটির চারটে দিনে গেরস্তকুলে তার আলাদা আদর। বছরের খামতি মিটিয়ে সে তখন চুইংগামের মতো লম্বা হয়। আশ্বিনের ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের মতো স্বপ্নগুলোকে তখন স্পষ্ট দেখায়, নাকের নিচে রয়্যাল এনফিল্ডের গর্জন ঘনায়। তবে জাতে ভাতঘুম ঠিক যেন ইউসুফ পাঠান। রাতঘুমের মতো দ্রাবিড়ীয় ধৈর্য তার নেই। একটু মনঃসংযোগে ব্যাঘাত মানেই ক্লিন বোল্ড! চটকার দফারফা– ‘চিড়িয়া ভাগলবা’!
পুজোর ছুটি কাটলে অফিস-ফেরত বাঙালির তাই মনকেমন করে। সেটা হালকা হয়ে আসা ওয়ালেট দেখে যতটা, ঠিক ততটাই ভরদুপুরের হারিয়ে ফেলা ভাতঘুমের জন্যও। তবে বাঙালি আজকাল হেলথ কনশাস। সে আর ভাতঘুম দেয় না, ‘পাওয়ার ন্যাপ’ নেয়। এ তো ভাতঘুমেরই ছদ্মনাম, সে আর কাকে বোঝাই! আর হেলথের খেয়ালে যদি সে চিয়া সিডস, অলিভ অয়েলে করা স্যালাড চিবোয় দুপুরে, তবে কি ভাতঘুম স্যালাড-ঘুমে পরিণত হবে?
তবে, ভাত খেয়েও অনেক সময় ঘুম না-ও আসতে পারে দুপুরবেলায়। এমনকী, রাতেও। যদি ভাবা হয়, যাদের দু’মুঠো ভাত জোটে না রোজ, তাদের কি ভাতঘুম আসে?
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..