
শিশুদের প্রকৃতি-পাঠে উৎসাহী করে তোলা এবং নিজের পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা, এই দুই লক্ষ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন ‘ওয়াচিং বার্ডস’ বইটি। ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’ এই বইটি শুধু প্রকাশই করেনি, বহু ভাষায় অনুবাদ করেছে। বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে ‘ওয়াচিং বার্ডস’। শুধুমাত্র পাখিদের বিবরণসম্বলিত বই নয় এটি। পাখিদের বাসা, তাদের মনোজগৎ, পরিযান সবকিছু নিয়েই অজস্র তথ্য রয়েছে বইটিতে। সেসব তথ্য ভারহীন। বইটির প্রতিটি শব্দ, বাক্য পাখিদের সঙ্গে জামাল আরার আন্তরিকতা প্রকাশ করে।
সদ্য বিয়ে ভেঙেছে মেয়েটার। বনিবনা হচ্ছিল না স্বামীর সঙ্গে। রক্ষণশীল পরিবারে বড় হওয়া মেয়েটার চোখে অনেকদিন ধরেই স্বামীর আচার-আচরণ উচ্ছৃঙ্খল ঠেকত। তবু ছেড়ে আসতে পারছিল না। কিন্তু ভাঙন আটকানো যায়নি। ভেঙে যায় সম্পর্ক। দিশেহারা হয়ে পড়েছিল মেয়েটি। কারণ, সঙ্গে রয়েছে সন্তান! এমন সময় এক আত্মীয় সাহায্য করতে এগিয়ে আসেন। সেই আত্মীয় বিহার ক্যাডারের আইএএস। স্বামী-পরিত্যক্তা মেয়েটি এবং তাঁর সন্তানকে আশ্রয় দেন। কর্মসূত্রে সেই আইএএস অফিসার ঝাড়খণ্ডে থাকতেন। ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জঙ্গলে তাঁকে ঘুরতে হত। সঙ্গে যেতেন সেই মা-মেয়ে।
আপনজনের থেকে আঘাত পাওয়া সেই মায়ের মন তখন বেদনাতুর। তার ভারাক্রান্ত হৃদয়কে সে সময় আশ্রয় দিয়েছিল ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে মেয়েটির বন্ধুত্ব হয় পাখিদের সঙ্গে। শুধু বন্ধুত্বই হল না, পাখিদের প্রতি আগ্রহও তৈরি হল মেয়েটির। সন্তানের দায়িত্ব সামলে বাকি সময়টুকু মেয়েটা কাটাতে শুরু করল পাখিদের সঙ্গে। অন্তরের ক্ষতে প্রলেপ পড়া শুরু হল ধীরে ধীরে। মেয়েটি স্থির করল, পাখিদের নিয়ে লেখালেখি করবে। মাত্র দশম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা ছিল তার। স্বাভাবিকভাবেই ইংরেজিতে কম জ্ঞান। কিন্তু সে থামল না। সন্তান সামলানো, পরিবারের কাজ– সবকিছুর পাশাপাশি চলতে লাগল পড়াশোনা। তার সঙ্গে চলত পাখিদের সঙ্গে আলাপ। পাখিদের নিয়ে পর্যবেক্ষণ, তাদের সঙ্গে এই আলাপের বিবরণ ইংরেজিতে ছোট ছোট নোটের আকারে লিখে রাখত মেয়েটি।
ভারতের প্রথম মহিলা পক্ষীবিদ জামাল আরার, পাখিদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল এভাবেই। পক্ষী বিশেষজ্ঞ সেলিম আলি, জামাল আরাকে নাম দিয়েছিলেন ‘বার্ড ওম্যান’।

১৯২৩ সালে বিহারের বাড় অঞ্চলে জন্ম জামাল আরার। রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েটি পরিবারের চাপে বিয়ে করতে একপ্রকার বাধ্য হন। তবুও শুরুতে সংসারে মন দিয়েছিলেন। স্বামীর সঙ্গে প্রথমবার কলকাতায় আসেন। সঙ্গে কন্যাসন্তান– মধুকা। কিন্তু ক্রমেই দাম্পত্যে অবনতি ঘটে। জামালের স্বামী তাঁকে ছেড়ে চলে যান। সেই দুঃসময়ে আত্মীয় শামি আহমেদ জামালকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। তখনও বিহার আর ঝাড়খণ্ড আলাদা হয়নি। ফলে বিহার ক্যাডারের অফিসার শামি আহমেদকে কাজের সূত্রে ঘুরে বেড়াতে হত ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলে, সঙ্গে জামাল আরা ও মধুকাও।
ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল, গাছগাছালি, পাখি ক্রমেই বন্ধু হয়ে ওঠে জামালের। অনিচ্ছার বিয়ে, সম্পর্কের আঘাতের ক্ষত সেরে যেতে থাকে ধীরে ধীরে। ঝাড়খণ্ডের বিভিন্ন জঙ্গলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন জামাল। প্রথমদিকে শুধু গাছপালা দেখতেন। ধীরে ধীরে বন্যপ্রাণীদের প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়। বিশেষ করে পাখিদের প্রতি। পাখিদের ইচ্ছেমতো উড়ে বেড়ানো, খাওয়া-দাওয়া, তাদের ডাক পর্যবেক্ষণ করতেন মন দিয়ে। পাখিদের ঘিরে এক অন্য জগৎ তৈরি হয় জামালের মনে। সে-সব খুঁটিনাঁটি লিখে রাখতেন জামাল। কিন্তু লিখবেন কীভাবে? পড়াশোনার সঙ্গে সম্পর্ক যে ছিন্ন হয়েছে বহুদিন। তবু দমে যাননি জামাল। পাখিদের নিয়ে লিখতে হলে ইংরেজিতে লেখাই ভালো। কিন্তু ইংরেজিতে তেমন দখল ছিল না তাঁর। সেই প্রতিকূলতা সত্ত্বেও পাখিদের পর্যবেক্ষণ করে সব তথ্য নোট করতে শুরু করেন। ছোট ছোট ইংরেজি বাক্যে তা লেখার চেষ্টা করতেন। জামাল আরার এই আগ্রহ, পাখিদের সঙ্গে বন্ধুত্বের কথা তখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে ঝাড়খণ্ডের জঙ্গলের আশপাশে।
জামালের আত্মীয় শামি আহমেদের ঊর্ধ্বতন এক কর্তৃপক্ষের স্ত্রী-র কানে পৌঁছয় সেই খবর। তিনি ইংরেজি জানতেন। তাঁর সান্নিধ্যে ইংরেজি শিখতে শুরু করেন জামাল। পি. ডাবলু. অজিয়ের দম্পতির সঙ্গে এভাবেই বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জামালের। তাঁদের আগ্রহে জামালের লেখা প্রবন্ধের আকারে প্রকাশ পেতে শুরু করে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৮৮ সাল। দীর্ঘ ৩৯ বছর ধরে জামাল লিখেছেন। পাখিদের নিয়ে তাঁর ভাবনা, অভিজ্ঞতা প্রকাশ পেয়েছে ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’ এবং ‘বেঙ্গল ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র মুখপত্রে। ‘দ্য নিউজ লেটার্স ফর বার্ড ওয়াচার্স’ এই সমীক্ষাপত্রেও তাঁর লেখা নিয়মিত প্রকাশ হতে শুরু হয়। শিক্ষানবিশ হিসেবে লেখা শুরু করেছিলেন, পরবর্তীতে অভিজ্ঞ পক্ষীবিদ হিসেবেও লিখেছেন।

১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ‘জার্নাল অফ দ্য বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’-তে জামাল আরার প্রথম সমীক্ষাপত্র প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল ‘ওয়াইল্ড লাইফ রিজার্ভস ইন ইন্ডিয়া: বিহার প্রভিন্স’। তাঁর রচনার ভাষা ছিল সহজ, সাবলীল। পাখিদের নিয়ে এই আগ্রহ, আকর্ষণ তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সকলের মধ্যে। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে। প্রকৃতির সঙ্গে শিশুদের সম্পর্ক তৈরি হলে তা প্রভাবিত করবে তাদের মনোজগতকেও, একথা বিশ্বাস করতেন তিনি। শিশুদের প্রকৃতি-পাঠে উৎসাহী করে তোলা এবং নিজের পর্যবেক্ষণ লিপিবদ্ধ করা, এই দুই লক্ষ্যেই তিনি রচনা করেছিলেন ‘ওয়াচিং বার্ডস’ বইটি। ‘ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট’ এই বইটি শুধু প্রকাশই করেনি, বহু ভাষায় অনুবাদ করেছে। বাংলাতেও অনূদিত হয়েছে ‘ওয়াচিং বার্ডস’। শুধুমাত্র পাখিদের বিবরণ-সম্বলিত বই নয় এটি। পাখিদের বাসা, তাদের মনোজগৎ, পরিযান সবকিছু নিয়েই অজস্র তথ্য রয়েছে বইটিতে। সেসব তথ্য ভারহীন। বইটির প্রতিটি শব্দ, বাক্য, পাখিদের সঙ্গে জামাল আরার আন্তরিকতা প্রকাশ করে।
পাখিরা ছিল জামালের আত্মার সঙ্গী। পাখিদের পরিযান নিয়ে জামাল আরার লেখা একটি অংশ লক্ষ্য করলে দেখা যায়, তাঁর পর্যবেক্ষণ ঠিক কতটা নিখুঁত। পাখিদের ‘রিঙ্গিং’ বা আংটি পরানো নিয়ে জামাল আরার লেখা সেই সময়ের তাবড় পক্ষীবিদদের মুগ্ধ করেছিল। ‘ওয়াচিং বার্ডস’-এ তিনি লিখেছেন, “আজকাল বাচ্চা আর বড় পাখিদের পায়ে আংটি পরিয়ে এদের দেশান্তরে যাওয়ার ব্যাপারে অনেক কিছু জানা গিয়েছে। পাখিকে ধরে তার পায়ে হালকা ধাতুর কিংবা প্লাস্টিকের আংটি পরিয়ে দেওয়ার ইংরেজি নাম ‘রিঙ্গিং’। আংটির পাতে নম্বর, তারিখ পাখির পরিচয়নামা আর পাখিটি দেশান্তরে ধরা পড়লে আংটিটি খুলে কার ঠিকানায় ফেরত পাঠাতে হবে তার পুরো বিবরণ দেওয়া থাকে। আংটি পরিয়েই পাখিটিকে উড়িয়ে দেওয়া হয়। পাখিটিকে জ্যান্ত ধরা বা মেরে ফেলার মতো ঘটনাও দেখা গিয়েছে। পাখিকে যেখানে জ্যান্ত ধরা বা মেরে ফেলা হয় অথবা পাখিটিকে যেখানে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় সেখান থেকেই পাখিটির গতিপথের হদিশ মেলে এই আংটির মাধ্যমে।” পাখিদের নিয়ে তাঁর বিবরণ ছিল এতটাই নিখুঁত এবং জরুরি।

পক্ষী-সুমারি অর্থাৎ, পাখি গোনার কাজ নিয়ে লিখেছেন তিনি। ১৯৬০ সালে ‘নিউজ লেটার ফর বার্ড ওয়াচার্স’ পত্রিকাটির প্রকাশ শুরু হয়। জামাল আরা সেখানে নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। সেলিম আলি, বিশ্বময় বিশ্বাসের মতো বিখ্যাত পক্ষীবিদরা ছিলেন সম্পাদকমণ্ডলীতে। জামাল আরার লেখা মুগ্ধ করেছিল সকলকে। পাখিদের নিয়ে শান্ত, সমাহিত জীবন কাটাচ্ছিলেন। এই সময় তাঁর জীবনে নেমে আসে সংকট। জামাল ও তাঁর কন্যাসন্তান মধুকাকে যিনি আশ্রয় দিয়েছিলেন, সেই আত্মীয় শামি আহমেদের কর্মক্ষেত্রে ঘটে অপ্রীতিকর ঘটনা। সাসপেন্ড করা হয় তাঁকে। পরে তাকে পুনর্বহাল করা হলেও আগের স্থান তিনি ফিরে পাননি। ১৯৬৬ সালে মারা যান শামি আহমেদ। তাঁর মৃত্যুতে দিশেহারা হয়ে পড়েন জামাল ও তাঁর মেয়ে।

এই দুঃসময়ে জামাল পাশে পেয়েছিলেন এক সহৃদয় খেলোয়াড়কে। তিনি ভারতের হকি দলের প্রাক্তন অধিনায়ক জয়পাল সিং মুন্ডা। ধীরে ধীরে সংকট কাটে। সৃষ্টিশীলতার অন্য ক্ষেত্রগুলিতেও নিজেকে মেলে ধরেন জামাল। এই সময় তিনি ছোটগল্প লেখা শুরু করেন। অরণ্য, প্রান্তিক মানুষদের কথাই থাকত তাঁর ছোটগল্পে। বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর গল্প প্রকাশিত হতে শুরু করে। অনুবাদের কাজও শুরু করেন।

রাঁচি আকাশবাণীতে অতিথি হিসেবে অনেক অনুষ্ঠান করেছেন জামাল আরা। পাখিদের নিয়ে তাঁর ‘মন’-এর কথা বলেছেন রেডিও-তে। পাখিরা শুধুমাত্র একপ্রকার প্রাণ নয়, বাস্তুতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। প্রকৃতি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে তাদের গুরুত্ব অপরিসীম। তাই পাখিদের সংরক্ষণ জরুরি। জামাল আরার লেখায় বারবার জোরালো হয়েছে এ-কথা। প্রথাগত ডিগ্রি ছিল না তাঁর। শুধুমাত্র পর্যবেক্ষণ শক্তির মাধ্যমেই তিনি অর্জন করেছিলেন প্রগাঢ় জ্ঞান। রাঁচি আকাশবাণীতে অনুষ্ঠান করতে যাওয়ার সময় তাঁর আলাপ হয়েছিল কেন্দ্রীয় অধিকর্তা কর্তার সিং দুগ্গলের সঙ্গে। নিজের আত্মজীবনীতে কর্তার সিং শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেছেন পক্ষীবিদ জামালকে। তাঁর গভীর, নিখুঁত পর্যবেক্ষণ-শক্তি শুধু পাখিদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়েও তিনি লিখেছেন। পরিবেশের প্রতি মমতা এবং সহানুভূতিশীল মনোভাব সঞ্চারিত করেছেন উত্তরপ্রজন্মের মধ্যেও।

আপনজনের থেকে আঘাত পাওয়া ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে প্রকৃতিকে আঁকড়ে ধরেছিলেন জামাল। অরণ্য, পাখি, মাটি সবকিছু নিয়েই নিজের ডানা খুঁজে পেয়েছিলেন। সেই ডানা তাঁকে পক্ষীবিদ হিসেবে পরিচিতি দিয়েছিল। ১৯৮৮ সালে নানা পারিবারিক কারণে লেখালেখি ও কাজ থেকে হঠাৎ করেই সরে আসেন। নানা মানসিক সমস্যা ঘিরে ধরে তাঁকে। পাখিদের জগৎ থেকে উধাও হয়ে যান। ১৯৯৫ সালে মৃত্যু হয় জামাল আরার। কোথাও কোনও শোকবার্তা প্রকাশিত হয়নি! ‘নিউজ লেটার ফর বার্ড ওয়াচার্স’ পত্রিকাটি দুঃখ প্রকাশ করেছিল শুধুমাত্র। একটিমাত্র অনুচ্ছেদ বরাদ্দ ছিল কেবল।
ইতিহাসের বুকে সেভাবে জায়গা হয়নি জামাল আরার। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে গিয়েছেন। অস্পষ্ট, কুয়াশাঘেরা প্রশ্নচিহ্ন হিসেবে ইতিহাসে রয়ে গিয়েছেন ভারতের প্রথম মহিলা পক্ষীবিদ– জামাল আরা।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved