Robbar

‘টবি জগ’– চিরস্থায়ী হাসির জীবন্ত ইতিহাস

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 22, 2025 8:14 pm
  • Updated:December 22, 2025 8:14 pm  

ঐতিহ্যবাহী টবি জগগুলোতে দেখা যায় একজন স্থূলকায়, হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি একটি কাঠের চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছেন। তাঁর পরিধানে থাকে সেই আমলের জনপ্রিয় ‘ট্রিকর্ন হ্যাট’ (Tricorn Hat) বা তিনকোনা টুপি। এক হাতে ধরা তামাকের পাইপ এবং অন্য হাতে কানায় কানায় পূর্ণ একটি মগ। এই নকশাটি আঠেরো শতকের ইংল্যান্ডে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, ব্রিটিশ লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

সলিল হোর

শিল্পকলা যখন উপযোগিতার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়, তখন সৃষ্টি হয় এমন কিছু অমর নিদর্শন– যা শতাব্দীকাল ধরে মানুষের ড্রয়িংরুম আর ব্যক্তিগত সংগ্রহশালায় আভিজাত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতীক হয়ে থাকে। এমনই এক অনন্য এবং বৈচিত্র্যময় নিদর্শনের নাম ‘টবি জগ’ (Toby Jug)। আপাতদৃষ্টিতে কেবল সিরামিক বা মাটির পাত্র মনে হলেও, এর প্রতিটি খাঁজে ও ভাঁজে লুকিয়ে আছে আঠেরো শতকের ইংল্যান্ডের সামাজিক চিত্রপট, লোকগাথা এবং মৃৎশিল্পের এক দীর্ঘ বিবর্তন।

টবি জগ আসলে মানুষের অবয়বে তৈরি এক বিশেষ ধরনের সিরামিক পাত্র, যা মূলত পানীয় পরিবেশনের জন্য ব্যবহৃত হয়। কেবল ‘মগ’ বললে এ শিল্পবস্তুটির শৈল্পিক অমর্যাদা হয়; বরং বলা ভালো টবি জগ একটি জলজ্যান্ত ভাস্কর্য। সাধারণ সিরামিক পাত্রে যেখানে বিমূর্ত বা জ্যামিতিক নকশা থাকে, সেখানে টবি জগে ফুটে ওঠে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের প্রতিচ্ছবি।

ঐতিহ্যবাহী টবি জগগুলোতে দেখা যায় একজন স্থূলকায়, হাস্যোজ্জ্বল ব্যক্তি একটি কাঠের চেয়ারে আয়েশ করে বসে আছেন। তাঁর পরিধানে থাকে সেই আমলের জনপ্রিয় ‘ট্রিকর্ন হ্যাট’ (Tricorn Hat) বা তিনকোনা টুপি। এক হাতে ধরা তামাকের পাইপ এবং অন্য হাতে কানায় কানায় পূর্ণ একটি মগ। এই নকশাটি আঠেরো শতকের ইংল্যান্ডে এতটাই জনপ্রিয়তা পেয়েছিল যে, ব্রিটিশ লোকসংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়।

টবি জগের গৌরবময় পথচলা শুরু ১৭৬০-এর দশকে, ইংল্যান্ডের বিখ্যাত মৃৎশিল্পের কেন্দ্রস্থল স্ট্যাফোর্ডশায়ার (Staffordshire) অঞ্চলে। জন অ্যাস্টবারি, থমাস হুইলডন এবং রালফ উডের মতো কিংবদন্তি মৃৎশিল্পীরা এই শিল্পের কারিগর ছিলেন। তাঁদের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় প্রাণহীন মাটি হয়ে উঠেছিল ব্রিটিশ ঐতিহ্যের ধারক।

এই বিচিত্র পাত্রগুলোর নামকরণ নিয়ে ইতিহাসবিদ ও সংগ্রাহকদের মধ্যে আজও নানা রোমাঞ্চকর বিতর্ক বিদ্যমান। তার মধ্যে প্রধান তিনটি তত্ত্ব হল:

১. ১৭৬১ সালে ‘দ্য ব্রাউন জগ’ নামক এক জনপ্রিয় ইংরেজি গানে টবি ফিলপট (Toby Fillpot) নামক এক ব্যক্তির উল্লেখ পাওয়া যায়। তিনি ছিলেন এক অতিমাত্রার মদ্যপ ব্যক্তি, লোকগাথা অনুযায়ী যিনি ২০০০ গ্যালন মদ্যপান করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। ধারণা করা হয়, তাঁর এই আমুদে ও স্থূলকায় অবয়ব থেকেই এই জগের নকশা অনুপ্রাণিত।

২. উইলিয়াম শেক্সপিয়রের অমর নাটক ‘টুয়েলফথ নাইট’-এর অন্যতম চরিত্র স্যর টবি বেলচ (Sir Toby Belch)। তাঁর চরিত্রেও এক ধরনের বিলাসিতা এবং মদ্যপানের প্রতি গভীর অনুরাগ ছিল– যা এই পাত্রগুলোর মেজাজের সাথে হুবহু মিলে যায়।

৩. ভাষাতাত্ত্বিকদের মতে, ফরাসি শব্দ ‘Toper’ (যার অর্থ অত্যধিক পান করা) বা ‘টোপি’ (Topie) থেকে এই নামের উৎপত্তি হয়ে থাকতে পারে।

প্রকৃত টবি জগ চেনার জন্য তার নির্মাণশৈলী বোঝা অত্যন্ত জরুরি। তাই শনাক্ত করার ক্ষেত্রে নিচের বিষয়গুলি খেয়াল রাখতে হয়–

১. টবি জগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল মূর্তির মাথায় থাকা তিনকোনা টুপি। এই টুপির তিনটি কোণ কেবল সৌন্দর্য বাড়ায় না, বরং পানীয় ঢালার সুবিধার্থে এগুলোকে ‘স্পাউট’ বা নালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

২. প্রাচীন জগগুলো ‘আন্ডারগ্লেজ’ পদ্ধতিতে হাতে রং করা হত। তামাটে বাদামি, নীল, শ্যাওলা সবুজ এবং হালকা হলুদ রঙের ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো। এই হাতে রং করার বিষয়টি প্রকৃত টবি জগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।

৩. জগটি ভেতর থেকে সম্পূর্ণ ফাঁপা থাকে, যাতে প্রচুর পরিমাণে তরল ধারণ করতে পারে। পেছনের দিকে থাকে একটি মজবুত হ্যান্ডেল, যা ব্যবহারের সময় সঠিক ভারসাম্য রক্ষা করে।

সংগ্রাহক বা শিল্পপ্রেমীদের কাছে টবি জগ এবং তার সমগোত্রীয় পাত্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য বোঝা অত্যন্ত জরুরি। যদিও সাধারণ চোখে এগুলোকে একইরকম মনে হতে পারে, কিন্তু এদের গঠন এবং ব্যবহারের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজন রেখা রয়েছে।

প্রথমেই আসে ঐতিহ্যের মূল ধারক টবি জগ। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য– এতে একজন মানুষের পূর্ণাঙ্গ অবয়ব ফুটিয়ে তোলা হয়। অর্থাৎ, মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরো শরীরটিই এখানে দৃশ্যমান থাকে, যেখানে চরিত্রটি সাধারণত একটি চেয়ারে উপবিষ্ট অবস্থায় থাকে। যেহেতু এটি মূলত পানীয় পরিবেশন, অর্থাৎ এক পাত্র থেকে অন্য পাত্রে তরল বস্তু ঢালার জন্য তৈরি, তাই এর মাথার টুপিতে অবশ্যই একটি ‘স্পাউট’ বা ঢালার নালি থাকে। আঠেরো শতকের সেই আদিম আমেজ এই জগগুলোতেই সবচেয়ে বেশি খুঁজে পাওয়া যায়।

অন্যদিকে, ‘টবি মগ’ তৈরি করা হয়েছে সরাসরি চুমুক দিয়ে পান করার উদ্দেশ্যে। জগের সঙ্গে এর মূল পার্থক্য এর গঠনশৈলীতে। মগে সাধারণত মানুষের পুরো শরীর না দেখিয়ে কেবল মাথা বা শরীরের উপরিভাগ দেখানো হয়। যেহেতু এটি ঢালার জন্য নয়, তাই এর ওপরের অংশটি সম্পূর্ণ গোলাকার এবং খোলা থাকে; এতে কোনও বাড়তি নালি বা ঠোঁট (Spout) থাকে না। উচ্চতার দিক থেকেও এগুলো জগের তুলনায় কিছুটা ছোট এবং কমপ্যাক্ট।

সবশেষে রয়েছে ‘ক্যারেক্টার জগ’, যা টবি জগের একটি আধুনিক ও বিবর্তিত রূপ। ১৯৩৪ সালে বিখ্যাত ‘রয়্যাল ডলটন’ কোম্পানি এই ধারাটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় করে তোলে। এখানে পুরো শরীর দেখানোর পরিবর্তে কেবল নির্দিষ্ট কোনও চরিত্রের মাথা এবং কাঁধ পর্যন্ত ফুটিয়ে তোলা হয়। মজার ব্যাপার হল, ক্যারেক্টার জগে পানীয় ঢালার জন্য নালি বা স্পাউট থাকলেও, তা দেখতে অনেকটা আধুনিক ছাঁচে তৈরি মগের মতো। বর্তমানে বাজার এবং সমকালীন সংগ্রহশালাগুলোতে এই ক্যারেক্টার জগগুলোর চাহিদাই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে টবি জগের চরিত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে। আঠেরো শতকের সেই সাধারণ ‘টবি ফিলপট’ থেকে শুরু করে আজ এটি আধুনিক পপ কালচারের অংশ। বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে উইনস্টন চার্চিলের আদলে তৈরি টবি জগগুলো ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এছাড়া আব্রাহাম লিংকন, জন এফ কেনেডি এবং ব্রিটিশ রাজপরিবারের সদস্যদের মূর্তিতে তৈরি জগগুলো এখন ইতিহাসের সাক্ষী।

চার্লস ডিকেন্সের উপন্যাসের চরিত্র থেকে শুরু করে শার্লক হোমস, এমনকী আধুনিক যুগের হ্যারি পটার বা ‘লর্ড অফ দ্য রিংস’-এর চরিত্রগুলোও এখন সিরামিকের গায়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে। আধুনিক কিছু সংগ্রহে জগের নিচে একটি চাবি থাকে। জগটি টেবিল থেকে তুললেই তাতে পুরনো দিনের ক্লাসিক সুর বেজে ওঠে, যা তাকে আরও রহস্যময় ও আকর্ষণীয় করে তোলে।

বিশ্ব জুড়ে কয়েক হাজার সংগ্রাহক আছেন, যাঁরা কোটি টাকা খরচ করে দুর্লভ টবি জগ সংগ্রহ করেন। তার বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, ১৭৭০ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে তৈরি ‘ভিক্টোরিয়ান’ আমলের জগগুলো সংখ্যায় অত্যন্ত নগণ্য। বিশেষ করে যদি তাতে মৃৎশিল্পী রালফ উডের সিলমোহর থাকে, তবে তার মূল্য আকাশচুম্বী হতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি প্রাচীন জগ ছিল স্বতন্ত্র। হাতে রং করার কারণে একটির সঙ্গে অন্যটির সূক্ষ্ম পার্থক্য থাকত, যা প্রতিটি পিসকে ‘ইউনিক’ করে তোলে। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়–  পুরোনো টবি জগের দাম সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে। আন্তর্জাতিক নিলামে ভালো মানের প্রাচীন ‘টবি জগ’ কয়েক লক্ষ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত বিক্রি হওয়ার নজির রয়েছে।

আমেরিকান টবি জগ মিউজিয়ামে (ইলিনয়, ইউএসএ) ৮,০০০-এরও বেশি টবি এবং ক্যারেক্টার জগ রয়েছে। এটি বিশ্বের বৃহত্তম সংগ্রহশালা। আবার গ্ল্যাডস্টোন পটারি মিউজিয়াম গড়ে উঠেছে (যুক্তরাজ্য) একটি সংরক্ষিত ভিক্টোরিয়ান কারখানা হিসেবে, যেখানে এই শিল্প তৈরির প্রাচীন পদ্ধতি দেখতে পাওয়া যায়। ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে (লন্ডন) সংরক্ষিত আছে আঠারো শতকের অত্যন্ত বিরল এবং উচ্চমানের হস্তশিল্পের বেশ কিছু টবি জগ।

কেবল কাদা-মাটির তৈরি জড় বস্তু নয়; টবি জগ মানুষের সৃজনশীলতা, হাস্যরস এবং ব্রিটিশ আভিজাত্যের এক দীর্ঘস্থায়ী প্রতিফলন। টবি জগ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, জীবনের কাঠখোট্টা রুটিনের মাঝেও একটু আমোদ আর শিল্পের ছোঁয়া থাকা প্রয়োজন। বসার ঘরের কোণে হাসিখুশি একখানা টবি জগ কেবল ঘরই সাজায় না, বরং ২৫০ বছরের এক গৌরবময় ইতিহাসকে প্রতিদিন জীবন্ত করে তোলে। ইতিহাস। শিল্পের সমঝদারদের জন্য চিরস্থায়ী হাসির জীবন্ত ইতিহাস।