শুনেছি এক বিস্তীর্ণ ছাদ প্রাসাদে থাকতেন মিলান কুন্দেরা আর তাঁর স্ত্রী ভেরা। সেই ছাদেই দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে প্রায় ৯৬ বছর বয়সে মারা গেলেন মিলান কুন্দেরা। এখনও সেই ছাদে একা জীবন কাটাচ্ছেন ৯৪ বছরের ভেরা। কিন্তু প্যারিসে কোথায় সেই ছাদ? কে দেবে সেই অন্তহীন ছাদের দিশা?
৩.
জীবনে কখনও কখনও প্যারাশুটে অলীক সম্ভাবনার আকাশ থেকে নেমে আসে ঘটনা। আমাদের উপড়ে ফেলে চারধারের বাস্তব এবং পারম্পর্য থেকে। আমাদের ছুড়ে ফেলে অপ্রত্যাশিত ঘটনা স্রোতে। লেখায় ঢুকে পড়ে নতুন তাড়না, উত্তেজনা, একেবারে আনকোরা বিষয়। ২৯ আগস্ট সকালবেলা ঘটল এমনই এক ঘটনা, আমার জীবনে, এই প্যারিসে। ২৮ আগস্ট ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’ গ্রন্থ-বিপণিতে আমার আলাপ হয়েছে ইংরেজি-জানা ফরাসি তরুণী আমালিয়ার সঙ্গে। তারই সৌজন্যে খোঁজ পেয়েছি ‘সিলভিয়া বিচ অ্যান্ড দ্য লস্ট জেনারেশন’ বইটির। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, সে আজ ২৯ আগস্ট ফোনে জানাল সদ্য প্রয়াত, প্যারিসবাসী, ভুবনখ্যাত উপন্যাসিক ও আধুনিক চিন্তক, স্বনির্বাসিত সেলিব্রিটি মিলান কুন্দেরার ছাদের ঠিকানা!
ছাদের ঠিকানা! ঠিক তাই। মিলান কুন্দেরা আজীবন ছিলেন মিলনমেলা-বিমুখ, নিরালানিবাসী, একাকিত্বের-প্রেমিক এক অবিকল্প দার্শনিক, লেখক, সেলিব্রিটি! একটুকু জানতাম, তিনি চেকোশ্লোভাকিয়ার প্রাগ থেকে পালিয়ে এসে সুন্দরী স্ত্রী ভেরাকে জিজ্ঞেস করলেন, এই ভিড়ের শহরে থাকব কোথায়?
–ছাদে, বললেন অসামান্য সুদর্শনা ভেরা।
–কিন্তু তেমন ছাদ পাব কোথায়, যে ছাদ আকাশের মতো বড়? বললেন মিলান কুন্দেরা।
–তুমি ছাদ ছাড়া বাঁচবে না মিলান, যে-ছাদের ওপর বিছিয়ে আছে অনন্ত মুক্তি। তেমন ছাদ আমি তোমাকে খুঁজে দেব। এবং সেই ছাদ তোমার-আমার জন্য গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্বও আমার।
শুনেছি সেই ছাদেই দীর্ঘ জীবন কাটিয়ে প্রায় ৯৬ বছর বয়সে মারা গেলেন মিলান কুন্দেরা। এখনও সেই ছাদে একা জীবন কাটাচ্ছেন ৯৪ বছরের ভেরা। কিন্তু প্যারিসে কোথায় সেই ছাদ? কে দেবে তার ঠিকানা? কে দেবে সেই অন্তহীন ছাদের দিশা?
২৯ আগস্ট সকালে মিলান কুন্দেরা আর ভেরার সেই স্বপ্নছাদের ঠিকানা জানাল ‘শেক্সপিয়র অ্যান্ড কম্পানি’ থেকে টেলিফোনে আমালিয়া– ১০ নম্বর রু লিতর্ (Rue Littre), ৭৫০০৬!
মুহূর্ত দেরি করিনি আমি। যদি কেউ ওই ছাদ চুরি করে পালায়! বলা কী যায়? ট্যাক্সি চালককে বুঝিয়ে বলি, ১০ নম্বর রু লিতর্-এ নিয়ে যেতে পারবেন? ট্যাক্সি চালক কিছুক্ষণ দার্শনিক ভাবনায় ডুবসাঁতারু হন। সেল ফোনে গুগল-সন্ধানী হন। ডুবসাঁতার থেকে উঠে এসে বলেন, চলুন।
আরও পড়ুন: একশো বছর আগের এক দুপুর
এবং শেষ পর্যন্ত অনেক অলিগলি পেরিয়ে পৌঁছে যাই মাঝারি সাইজের একটি নির্জন লেনে, যে-রাস্তার নাম লিতর্। যার ইংরেজি নাম হতেই পারত লিটার। আমরা এক লিটার পেট্রলের কথা জানি। কিন্তু রাস্তার মাপক ‘লিটার’! তবে, বেশ লাগল আমার। রু লিতর্-এর প্রায় সবটুকু জুড়ে এই দশ নম্বর বাড়িটা। বিশাল এক দরজা। দরজা দেখেই মনে হয়, এ-দরজা খুলবে কে? আমি যে কলকাতা থেকে প্যারিসে এসেছি, খুঁজে পেয়েছি মিলান কুন্দেরা আর ভেরার নির্জন নির্বাসনের ঠিকানা, সেইটুকু বার্তাও পাঠাতে পারার কোনও উপায় নেই। এমন নিবিড়, সাড়হীনভাবে বন্ধ দরজা জীবনে এই প্রথম দেখলাম। ৬/৭ তলা বাড়ি। বিস্তীর্ণ ছাদ। ওই ছাদেই তাঁর সবটুকু প্যারিস-জীবন কাটিয়েছেন কুন্দেরা। কুন্দেরা নেই। ভেরা আছেন ওই ছাদবাড়ির কোথাও– তাঁরই নিজের হাতে তৈরি, ছাদনিলয়ে। দাঁড়ালাম ভেরা-র বন্ধ দরজার সামনে। ট্যাক্সি ড্রাইভার বিস্মিত হয়ে আমার ছবি তুলে দিলেন– মিলান কুন্দেরা আর ভেরার দরজায় পৌঁছনোর ছবি! সেই সঙ্গে ছাদের ছবিও। রু লিতর্ এবং ১০ নম্বর বাড়ির ছাদ বিস্তারে সমান-সমান। এই বিস্তীর্ণ ছাদ প্রাসাদে থাকতেন মিলান আর ভেরা। এখন ভেরা বড্ড একা। মনে হল আমার। কোন আলোকিত নির্বাসনের জন্য বেছে নিয়েছেন এই নিরুত্তাপ, নির্জন, নির্বেদী নির্বাসন?
আমার মনে পড়ে যায় নিউ ইয়র্কারে প্রকাশিত জেন ক্রামারের একটি দীর্ঘ লেখার প্রথম ক’টি লাইন। লেখার বিষয়: ‘হোয়েন দেয়ার ইজ নো ওয়র্ড ফর হোম’। জেন লিখছেন, হুবহু: দ্য চেক নভেলিস্ট মিলান কুন্দেরা অ্যান্ড হিজ ওয়াইফ ভেরা লিভ ইন প্যারিস অন আ স্মল স্ট্রিট অন দ্য লেফ্ট ব্যাঙ্ক! দেয়ার অ্যাপার্টমেন্ট ইজ ওয়ান অফ দোজ টপ-ফ্লোর প্যারিস ফ্ল্যাটস পুট টুগেদার!
আরও পড়ুন: প্যারিস যেন চলন্ত চড়ুইভাতি
জেনের লেখা শেষ হচ্ছে মিলান কুন্দেরার এই উক্তিতে। ‘প্যারিসে বা পৃথিবীর অন্য কোথাও আমার কোনও বাড়ি নেই। আমার ঠিকানা কিন্তু আছে। আমার সত্যিকারের ঠিকানা, দ্য রিচ ইন্টেলেকচুয়াল লাইফ অফ প্যারিস, উইথ হোয়াট আই অ্যাম অ্যাট হোম!’
(ক্রমশ)