‘গীতাঞ্জলি’ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন প্রকাশক, নোবেল-সংবাদে তড়িঘড়ি সিদ্ধান্ত বদল
Published by: Robbar Digital
Posted on: October 5, 2023 7:45 pm
Updated: October 14, 2023 5:03 pm
‘গীতাঞ্জলী’-র কপালে পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়া থেকে, প্রকাশনা সংস্থার বাতিল করে দেওয়া, সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব না দেওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টরেট’ অনুমোদন না দেওয়া ইত্যাদি কম শিরোপা জোটেনি। নোবেল হারানো সম্ভবত শেষতম শিরোপা!
অতনু কুমার বসু
বাংলার নদীমাতৃক উপন্যাস-বিশ্বে অদ্বৈত মল্লবর্মণের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চিরস্থায়ী। মালোদের জীবন, জীবনচর্চা অথবা জোয়ার-ভাটায় জলস্তরের ওঠা-নামার মতোই তাদের দৈনন্দিন জীবনসংগ্রামের টানাপোড়েন এই নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় নয়। বরং এই নিবন্ধের আগ্রহ উপন্যাসটিকে কেন্দ্র করে একটি ছোট্ট অথচ বিশেষ ঘটনা। ঘটনাটি ছোট হলেও ‘মর্মান্তিক’। মাসিক ‘মোহাম্মদী’ পত্রিকায় প্রকাশের সময়েই এই উপন্যাসের পান্ডুলিপিটা রাস্তায় হারিয়ে যায়। একজন লেখকের কাছে এ ঘটনা পারিবারিক বিয়োগ যন্ত্রণার সমতুল্য।
রবীন্দ্রনাথের সেটা তৃতীয়বার ইংল্যান্ড সফর। বোম্বাই থেকে ‘সিটি অফ্ গ্লাসগো’ জাহাজে কবির সঙ্গী পুত্র, পুত্রবধূ এবং ত্রিপুরার রাজপুত্র সোমেন চন্দ্র বর্মা। প্রতিমা দেবীর সেটাই প্রথম বিদেশ সফর। রথীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও লন্ডন প্রায় প্রথমই বলা যায়। তাই একটু থতমত অবস্থা। কবিরা লন্ডনে পৌঁছলেন ১৬ জুন, রবিবার সন্ধ্যায়। সেখান থেকে গন্তব্যস্থল ব্লুমস বেরি হোটেল। চেয়ারিং ক্রশ স্টেশন থেকে সুড়ঙ্গ রেলপথে যাত্রা। কবি ও তাঁর সফর সঙ্গীদের সেটাই প্রথম সুড়ঙ্গ রেলপথে যাত্রার অভিজ্ঞতা। রথীন্দ্রনাথের দায়িত্বে ছিল সেই গুরুত্বপূর্ণ অ্যাটাচি কেস, যার মধ্যে ছিল ‘গীতাঞ্জলী’-র অনুবাদ-সহ আরও কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। অ্যাটাচি কেসটা যথারীতি রেলের কামরাতে ফেলে রেখেই সবাই গন্তব্যস্থলে নেমে পড়লেন। এমনকী, সেদিন কারও সেই অ্যাটাচি কেসের কথা মনেই পড়ল না! এমনকী, কবিরও। পরের দিন কবির রোটেনস্টাইনের বাড়িতে যাওয়ার সময় অ্যাটাচির খোঁজ পড়ল এবং তখনই বোঝা গেল সুড়ঙ্গ রেলের কামরাতেই সেটা ফেলে আসা হয়েছে।
‘আমার অবস্থা অনুমেয়; শুকনো মুখে আমি চলে গেলাম টিউব রেলের লস্ট প্রপার্টি অফিসে। সেখানে যেতে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হারানো ধন ফেরত পাওয়ার পর আমার প্রাণে যে কী গভীর স্বস্তি হয়েছিল– সে আমি কখনো ভুলব না। মাঝে মাঝে একটা দুঃস্বপ্নের মতো ভাবি, যদি ইংরেজি গীতাঞ্জলী আমার অমনোযোগ ও গাফিলতির দরুন, সত্যিই হারিয়ে যেত, তা হলে…।’
রথীন্দ্রনাথ ‘তা হলে …’-র পর আর কিছু লেখার সাহস করে উঠতে পারেননি। এত বছর পরেও আমাদের গলাটা শুকিয়ে আসে, হাতটা কাঁপতে থাকে। যদি সত্যি হত, তাহলে কী হত ? তাহলে ইয়েটস কী করে বলতেন, ‘I have carried the manuscript of these translations about with me for days, reading it in railway trains, or on the top of Omnibuses and in restaurants, and I have often had to close it lest some stranger could see how much it moved me.’ রোটেনস্টাইনের বাড়িতে সেই সন্ধ্যায় উপস্থিত ছিলেন আর্নেস্ট রিস, এজরা পাউন্ড, মে সিনক্লেয়ার, হেনরি নেভিনসন, সি. এফ. অ্যান্ড্রুজ, চার্লস ট্রেভেলিয়ান, অ্যালিস মেনেল-সহ সাহিত্য জগতের আরও দিকপাল। ভাবগম্ভীর কণ্ঠে ইয়েটস কবিতাগুলো শোনাতে লাগলেন। ইয়েটস বলেছিলেন, ‘I know of no man in my time who has done anything in the English language to equal these lyrics. Even as I read them in this literal prose translation, they are as exquisite in style as in thought.’ তবে ‘গীতাঞ্জলী’ নিয়ে বিড়ম্বনার এখানেই ইতি নয়।
এরপরের ঘটনাটিও আরেকটি ইউরোপীয় দেশে। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রকাশক সংস্থা ম্যাকমিলান নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগেই ‘গীতাঞ্জলী’ অনুবাদ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এরপর জার্মানির স্বনামধন্য কুর্ট উওল্ভ (Kurt Wolff) প্রকাশনা ‘গীতাঞ্জলী’-র বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ম্যাকমিলানের কাছ থেকে বইটা আনিয়ে নেয়। কিন্তু এরপরও ‘গীতাঞ্জলী’-র কপালে শিকে ছিঁড়ল না। কুর্ট উওলভের সহকারী ‘গীতাঞ্জলী’ পড়ে বাতিলের সিদ্ধান্ত নেন এবং পত্রপাঠ বইটা লন্ডনে ফেরত পাঠানোর জন্য পোস্ট অফিসে দিয়ে আসেন। ঘটনাচক্রে সেদিনই নোবেল পুরস্কার ঘোষণা হয়। কুর্ট উইল্ভ সংবাদটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পড়িমড়ি করে লাইপজিগের বড় পোস্ট অফিসে গিয়ে অজস্র ডাক-সামগ্রীর ভিতর থেকে কোনওরকমে ‘গীতাঞ্জলী’ উদ্ধার করে নিয়ে এসে মুখ রক্ষা করেন। এরপর জার্মানি-সহ ইউরোপ জুড়ে ‘গীতাঞ্জলী’-র জয়জয়কারের ইতিহাস। পরবর্তী কালে এই কুর্ট উওলভই বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেন যে, নোবেল জয়ীর বই তাঁরাই প্রকাশ করে এবং সেটাই তাঁদের প্রথম সফলতম প্রকাশ। বইটা যে প্রাথমিক পর্বে তাঁরা বাতিল করেছিলেন, পরবর্তী কালে কুর্ট উওলভ তা কখনওই স্বীকার করেননি। ইতিহাসের বিবর্ণ পাতার আড়ালে কত সত্যিই যে মুখ বুজে চুপ করে পরে থাকে।
তবে যেটা আশ্চর্যের, তা হল কলকাতায় নোবেল প্রাপ্তির সংবাদে প্রথমে সেভাবে কোনও হইচই হয়নি। নোবেল পুরস্কার কমিটির ম্যাকমিলান কোম্পানি থেকে কবির ঠিকানা জোগাড় করে টেলিগ্রাম পাঠাতেই হয়ে যায় ১৪ নভেম্বর, যা জোড়াসাঁকো হয়ে শান্তিনিকেতনে পৌঁছয় ১৬ নভেম্বর। তার আগেই ১৪ নভেম্বরে সান্ধ্য দৈনিক ‘দ্য এম্পায়ার’ সংবাদটি প্রকাশ করে। তবে সংবাদপত্র দপ্তরে সেভাবে কোনও আলোড়নের খবর পাওয়া যায় না। এটা যে ব্রিটিশ জাতির উন্নাসিকতা না সংশয়, সেটা বলা দুষ্কর! সান্ধ্য দৈনিকের এই সংবাদটি হঠাৎ নজরে আসে কবির তিন অনুরাগীর– সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় এবং চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের। ‘The noble prize for literature has been conferred on the Indian poet Rabindranath Tagore.’ তড়িঘড়ি করে তাঁরা টেলিগ্রাম করেন শান্তিনিকেতনে। কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম করা হয় বিকেল ৪টে ১০ মিনিটে, যা বোলপুরে ডাকঘরে পৌঁছয় ৪টে ৪৩ মিনিটে। কবি প্রথমে টেলিগ্রামটা পকেটেই রেখেছিলেন। পরে অন্যদের আগ্রহে পড়ার পর একান্তই নিরাসক্তভাবে টেলিগ্রামটা আশ্রম-সচিব অধ্যাপক নেপালচন্দ্র রায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলেন ‘নিন নেপালবাবু, আপনার ড্রেন তৈরি করবার টাকা।’ এটাই ছিল কবির প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া।
আর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়? তাকেই বা এই বিতর্কের বাইরে রাখা যাবে কীভাবে? কবির নোবেল প্রাপ্তির সংবাদ পাওয়ার পরদিনই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের অধিবেশনে কবির তড়িঘড়ি ‘ডক্টরেট’ উপাধি দানের বিষয়টিকে অনুমোদন করা হয়।‘গীতাঞ্জলী’-র বিশ্বজয়ের আগে সিন্ডিকেটের সভায় স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ‘গীতাঞ্জলী’-র ভূয়সী প্রশংসা করলেও সেভাবে সমর্থন পাননি। সিনেটের অধিবেশনে প্রস্তাবনায় স্যর আশুতোষের বক্তব্যের মধ্যেও তার আঁচ ছিল ‘no one will now venture to contradict.’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ভূমিকাকে তীব্র ভাষায় কটাক্ষ করেছিলেন নীরদ সি. চৌধুরী। ‘‘ইহার পর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কপটতার কথা বলি। তখনই ইহার কর্তারা তাঁহাকে ‘‘ডক্টরেট’ দিলেন বটে, কিন্তু উহাকে বাধ্য হইয়া দেওয়া ভিন্ন আর কিছু বলা চলে না। রবীন্দ্রনাথের নিন্দুকদের মধ্যে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা অল্পসংখ্যক ছিলেন না। যে-ব্যক্তি ডিগ্রিধারী নয়, এমন কি এন্ট্রান্স পরীক্ষাও পাশ করে নাই, তাঁহারা সেই ব্যক্তির বাংলা ভাষার জ্ঞান পর্যন্ত আছে তাহাও স্বীকার করিতে প্রস্তুত ছিলেন না।’’
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই টালবাহানা নিয়ে কবিও একেবারে অবহিত ছিলেন না, এমন নয়। সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকে এক চিঠিতে কবি বলেছিলেন, ‘কোনোদিন উপাধির অপদেবতা আমার স্কন্ধে ভর করিবে এমন আশঙ্কা স্বপ্নেও আমার মনে আসে নাই। অবশেষে বনগমনের বয়স সেটাও ঘটিল। …আমার কাব্যলক্ষীর মাথায় এতদিন যে ঘোমটা ছিল সে ভালই ছিল, বিশ্ববিদ্যালয় সেটাকে সভাস্থলে উন্মোচন করিয়া যখন তাহার মাথায় পাগড়ি পরাইয়া দিবে তখন সেটা কিছুতেই মানাইবে না।’
তাহলে বিশ্বজয়ী ‘গীতাঞ্জলী’-র কপালে পাণ্ডুলিপি হারিয়ে যাওয়া থেকে, প্রকাশনা সংস্থার বাতিল করে দেওয়া, সংবাদমাধ্যমের গুরুত্ব না দেওয়া বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডক্টরেট’ অনুমোদন না দেওয়া ইত্যাদি কম শিরোপা জোটেনি। কী বলুন ?
তথ্যঋণ
১) পিতৃস্মৃতি: রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর
২) ভারতে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা এবং রবীন্দ্রনাথ ( প্রথম খণ্ড: নেপাল মজুমদার)
৩) অনুভবে অনুধ্যানে রবীন্দ্রনাথ: মার্টিন কেম্পশেন
৪) রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ: পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়
৫) আত্মঘাতী রবীন্দ্রনাথ ( দ্বিতীয় খণ্ড ): নীরদচন্দ্র চৌধুরী
৬) রবীন্দ্র-সংবর্ধনার ইতিবৃত্ত দেশে ও বিদেশে ( প্রথম খণ্ড ): বারিদবরণ ঘোষ
স্পেশাল ইভেন্টগুলো খুব উপভোগ করতাম, যেমন, নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে সেকেন্ড চ্যানেলের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, দিনটি ছিল ১৯ নভেম্বর, ইন্দিরা গান্ধীর জন্মদিন। সেবারের অনুষ্ঠানে কলকাতার বহু নামী শিল্পী যেমন ছিলেন, তেমন ছিলেন বম্বের অনেক নামজাদা সঙ্গীতশিল্পী।
রুগন পৃথিবীর বুকে হয়তো একদিন কয়েক হাজার কৃত্রিম পতঙ্গ প্রজনন কেন্দ্র তৈরি হবে। ঢাউস ইগলুর মতো কাচের ঘরে চোখ ধাঁধানো আলোর মধ্যে হয়তো একদিন শ্যামাপোকার চাষ হবে।