রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ লেখার কালে এই প্রিয়নাথ সেনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছেন। বলছেন যখন তিনি ‘ভগ্নহৃদয়’ লেখেন তখন প্রিয়নাথবাবুর থেকে এতটা প্রশংসা পাননি। বস্তুত প্রিয়নাথ সেনের কাব্যিক বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণে রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট বিশ্বাস সমীহ থাকত। সেজন্য সমস্ত লেখা প্রথমেই প্রিয়নাথ সেনের হাতে তুলে দিতেন এবং তার সুচিন্তিত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন।
রবীন্দ্রনাথের যুগে ‘সোশ্যাল মিডিয়া’ নামক বস্তুটি ছিল না। কিন্তু তাই বলে ‘লাইক কমেন্ট শেয়ার’ নামক এই ত্রয়ীর অস্তিত্ব ছিল না, তা কিন্তু নয়। বরং বেশ জাঁকিয়েই ছিল এবং রবীন্দ্রনাথ নিজেও এই ত্রয়ী দারুণভাবে ফলো করতেন। রবীন্দ্রনাথের অনেক অনেক ফলোয়ার ছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ নিজে কাদের ফলো করতেন, কার কমেন্টে প্রাণিত হতেন এবং নিজের লেখা কাদের সঙ্গে শেয়ার করতে চাইতেন আর অবশ্যই লাইক চাইতেন– সেখানে অনেকের নামই এসে যায়। ‘লাইক বাটন প্রেস করবেন’ হয়তো বলতে হত না কিন্তু লাইক আসার অপেক্ষায় থাকতেন বইকি! নিজের লেখা নিয়ে বাড়ির বড়দের থেকে কাছ থেকে বা নতুন বউঠানের কাছ থেকে তো লাইক আশা করতেনই কিন্তু তাঁর ফ্রেন্ডলিস্টে আরও এমন কয়েকজন আছেন অন্তত একজন তো আছেনই, যাঁর কাছে থেকে লাইক কমেন্ট শেয়ারের আশায় থাকতেন কবি। তিনি প্রিয়নাথ সেন– কবির সুহৃদ।
‘আয় তবে সহচরি হাতে হাতে ধরি ধরি’– সহচরী না হোক কবির সহচর বেশ কয়েকজন ছিলেন এবং তাঁদের হাত ধরে ধরে কবির কবিতা, গান, গল্প, নাটক, উপন্যাস, চিত্রশিল্প প্রভৃতি সৃষ্টির প্রদীপখানি ঘুরে ঘুরে বেড়াত– সেসবের অনেক পরিচয়ই পাওয়া যায় বিভিন্ন লেখায় এবং অবশ্যই ‘জীবনস্মৃতি’তে। শুধু কাব্যজগৎ নয়, কবির সাংসারিক পারিবারিক জীবন, জমিদারি জীবন, ঠাকুর কোম্পানির মালিক হিসেবে ব্যবসা-ইচ্ছুক জীবন, শিলাইদহ পতিসর সাজাদপুরে থাকাকালীন চাষবাসে তীব্র মনোযোগী এক কবির জীবন– সব ক্ষেত্রেই বন্ধুদের সখ্য, সাহচর্য কবিকেও সমৃদ্ধ করেছে। সাহিত্যিক-কবি রবীন্দ্রনাথের ‘রবীন্দ্রনাথ’ হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁদের অবদান নেহাত কম নয়। নিখাদ বন্ধুত্ব এক বিরল জিনিস এই পৃথিবীতে । তিনি অনেক শত্রুতাও যেমন পেয়েছেন, তেমন হীরকখণ্ডের মতো উজ্জ্বল কিছু বন্ধুত্বও তাঁর জীবনে আছে।
বন্ধু প্রিয়নাথ সেন– যাঁর জন্য রবীন্দ্রনাথ জীবনস্মৃতিতে একটি পুরো অধ্যায় রেখেছেন বন্ধুত্বের মর্যাদা স্বরূপ। জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, প্রিয়নাথ সেন একজন পণ্ডিতপ্রবর, বহু ভাষাবিদ এবং সাহিত্যের সাত সমুদ্রের একজন নাবিক। জার্মান, ফরাসি, সংস্কৃত, ইংরেজি ও বাংলা ভাষাসাহিত্যে ছিল তার অবাধ বিচরণ এবং প্রগাঢ় ব্যুৎপত্তি। সাহিত্যের রাজপথ থেকে গলিপথ পর্যন্ত সর্বত্রই ছিল তাঁর স্বচ্ছন্দ যাতায়াত এবং তাঁর সম্পূর্ণ সাহচর্য রবীন্দ্রনাথ নিজে উপলব্ধি ও উপভোগ করেছেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ লেখার কালে এই প্রিয়নাথ সেনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছেন। বলছেন যখন তিনি ‘ভগ্নহৃদয়’ লেখেন তখন প্রিয়নাথবাবুর থেকে এতটা প্রশংসা পাননি। বস্তুত প্রিয়নাথ সেনের কাব্যিক বিশ্লেষণ পর্যবেক্ষণে রবীন্দ্রনাথের যথেষ্ট বিশ্বাস সমীহ থাকত। সেজন্য সমস্ত লেখা প্রথমেই প্রিয়নাথ সেনের হাতে তুলে দিতেন এবং তার সুচিন্তিত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণের জন্য অপেক্ষা করে থাকতেন। শুধু তাই নয়, প্রিয়নাথ সেন বন্ধু রবীন্দ্রনাথের এইসব লেখা নিজে পড়তেন এবং অন্য মানুষদেরও পড়িয়ে তাঁদের মতামত নিয়ে রবীন্দ্রনাথকে জানাতেন। এখানে বলতেই পারি, আজকের যুগে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও কিছু পোস্ট করেই যখন আমরা লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের আশায় থাকি রবীন্দ্রনাথও কিন্তু সেই একই লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের আশায় থাকতেন তাঁর নিজের লেখাটি প্রিয়নাথ সেনের হাতে তুলে দেওয়ার পরে। একজন শুভানুধ্যায়ী হিসাবে প্রিয়নাথবাবু রবীন্দ্রনাথের এইসব লেখার কাটাছেঁড়া করতেন, ত্রুটি গুণাগুণ বিচার করতেন এবং বলা বাহুল্য– রবীন্দ্রনাথ এতে যথেষ্ট সমৃদ্ধ হতেন। রবীন্দ্রনাথ বলছেন, সেই সময়ে প্রিয়নাথ সেনের সাহচর্য না পেলে তাঁর কাব্য জমির আবাদে কতটা ফলন হত বা কাব্যের বর্ষা কতটা ঝরঝরিয়ে নামত, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
শুধু কাব্যের বলয়ের বন্ধুত্বই নয় প্রিয়নাথবাবু ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাংসারিক পারিবারিক জীবনের একটা ঢাল। নানা ঝড়ঝাপটায় রবীন্দ্রনাথ যখন অস্থির হতেন এই প্রিয়নাথবাবু তাঁকে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করতেন কবিকে সুরক্ষা দেওয়ার কাণ্ডারি হয়ে উঠতেন। স্ত্রীর মৃত্যু, সন্তানদের মৃত্যু, সন্তানদের রোগজ্বালা, মেয়েদের বিয়ে, বিয়ের আগের সমস্যা বিয়ের পরের সমস্যা, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি পারিবারিক সমস্ত ঝড়ঝঞ্ঝায় তিনি রবীন্দ্রনাথকে আগলে রাখতেন। ছাতার মতো সুরক্ষা দিতেন।
শিলাইদহ পতিসর সাজাদপুরে জমিদার রবীন্দ্রনাথ নানাবিধ উদ্ভাবনশীল কাজে নিজেকে নিযুক্ত করতেন। এইসব কাজের গুণাগুণ বিচার করে সঠিক-বেঠিক বিচার করে প্রিয়নাথ সেন মতামত দিতেন এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ সেই মতামতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে পদক্ষেপ করতেন। জ্যোতিদাদার মতো রবীন্দ্রনাথেরও ইচ্ছা হল ব্যবসা করার। খোলা হল ‘ঠাকুর কোম্পানি’। এই কোম্পানি পাট চাষের উদ্যোগ নিল। কিন্তু কবি রবীন্দ্রনাথ ব্যর্থ হলেন। লোকসান করলেন এই কোম্পানি চালাতে গিয়ে। দেনার দায়ে জর্জরিত হলেন। উদ্ধারকারী হিসেবে এগিয়ে এলেন প্রিয়নাথ সেন। নিজে দায়িত্ব নিয়ে একেবারে ব্যবসায়িক বুদ্ধি দিয়ে এর কাছ থেকে টাকা নিয়ে ওর সুদ মেটান, তার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তার আসলের ধার মেটান– এইভাবে রবীন্দ্রনাথের সমস্ত দেনা তিনি মিটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। রবীন্দ্রনাথের গায়ে এইসব বিড়ম্বনার আঁচটিও লাগতে দেননি। এইসব দিনে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতেন এই পণ্ডিতপ্রবর বন্ধু প্রিয়নাথ সেন।
অনেক বিষয়ে ব্যুৎপত্তির মতো ফলিত জ্যোতিষচর্চায় প্রিয়নাথ সেনের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর সঙ্গে তাঁর একবার তর্ক হয়েছিল ‘ফলিত জ্যোতিষ’-এর সারবত্তা আছে কি না, তাই নিয়ে। প্রিয়নাথবাবু ফলিত জ্যোতিষচর্চা করতেন অর্থাৎ হাত-দেখা, কোষ্ঠী বিচার– এগুলিতে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। রবীন্দ্রনাথও এই হাত-দেখা, কোষ্ঠী বিচারে বিশ্বাস করতেন। প্রিয়নাথবাবু রবীন্দ্রনাথের কোষ্ঠী বিচার করে যা যা লিখে দিয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি হয়েছিল। মীন রাশি মীন লগ্নের– ‘লগন চাঁদা’ ছেলে রবির কোষ্ঠী বিচারের যে হদিশ পাওয়া যায়– সেখানে অবশ্য শুধু সাফল্য নয় অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা মৃত্যুশোকের কথাও বলা ছিল। প্রিয়নাথ সেনের কোষ্ঠী বিচার ছিল অভ্রান্ত, নির্ভুল। একটা চিঠিতে পাওয়া যায় রবীন্দ্রনাথ প্রিয়বাবুকে লিখছেন আপনার কাছে আমার ছেলেমেয়ের যে কোষ্ঠীগুলি আছে তা তাড়াতাড়ি বিচার করে যদি পাঠিয়ে দেন তো ভালো হয়– রথীর মা অস্থির হচ্ছে। অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, ছেলেমেয়েদের কোষ্ঠী বিচারের জন্যও রবীন্দ্রনাথ এই বন্ধুকেই ভরসা করতেন।
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে প্রিয়নাথ সেনের একটি ছবি রবীন্দ্রানুরাগী মাত্রই মনে রাখেন– রবীন্দ্রনাথ পড়ছেন আর মুগ্ধতার আবেশ নিয়ে প্রিয়নাথ সেন তা শুনছেন। প্রিয়নাথ সেন সেই ঝরনাতলা যেখানে রবীন্দ্রনাথ পৃথিবীর সাহিত্যস্নান সেরে নিতেন। নির্জনে। আর নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের একটা অপূর্ব ছবি দেখতে পেতেন।
প্রিয়নাথবাবু রবীন্দ্রনাথের থেকে সাত বছরের বড় ছিলেন কিন্তু তাতে তাঁদের সখ্যে কোনও বাধা তৈরি হয়নি কারণ দু’জনেরই মনের কলসটি ভর্তি থাকত কাব্যরসে। রবীন্দ্রনাথকে জানতে গেলে, গোটা মানুষটাকে জানতে গেলে প্রিয়নাথ সেনের বন্ধুত্বের কথা, সেই দিনগুলোর গড়িয়ে যাওয়ার কথা ও জানতে হয় যার জন্য জীবনস্মৃতিতে একটি পুরো অধ্যায় তিনি রচনা করেছেন। বস্তুত আজকের ভাষায় রবীন্দ্রনাথের অনেক ফলোয়ার ছিলেন কিন্তু রবীন্দ্রনাথ প্রিয়নাথ সেনকে ফলো করতেন– নিজের সৃষ্ট কবিতা গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদিতে লাইক কমেন্ট শেয়ারের জন্য।
সাহিত্য যেন এক পা হলেও সমাজের, সভ্যতার, কিংবা সময়ের আগে-আগে হাঁটে। মানুষ নিবিষ্ট চিত্তের সাহিত্যপাঠ থেকে জীবনের অনেক চিরস্থায়ী অন্ধকার অংশে আচমকা আলোর হদিশ পেয়ে যেতে পারে। সাহিত্যের থেকে এরকমই পর্বতপ্রমাণ প্রত্যাশা রাখতেন মারিও ভার্গাস লোসা।