প্রায় নিখুঁত বরবেশে, বা জামাই সেজে বইমেলায় ঢুকছেন সন্ধের দিকে সমরেশ বসু। এবং রব উঠছে চতুর্দিকে সমরেশ, সমরেশ– এবং ময়দান উপচে ঢুকছেন সমরেশ বসু, ‘বিবর’ ও ‘প্রজাপতি’-র লেখক– সেই স্মৃতি কি কোনওদিন মুছে যাবে মন থেকে?
শীত যাব যাব করছে। কিন্তু যায়নি তখনও। হঠাৎ এল এক পশলা শেষ শীতের বৃষ্টি। প্রতি বছরের মতো সে-বছরেও। আর ওমনি মন বলল, কলকাতার ময়দানে সেই বইমেলার কথা, মনে এলেই মনকেমন করে ওই বিদগ্ধ বৃষ্টির জন্যও। ময়দানের বইমেলায় ওই প্রতীক্ষিত একপশলার অবদান ছিল একটা স্বপ্নসুন্দর সোঁদা গন্ধ! বইমেলা ময়দান ছাড়ার পর হারিয়ে ফেলেছে সেই প্রান্তিক শীতের বর্ষণভেজা ঘাসমাটির গন্ধ। আমার বইমেলার স্মৃতিতে সেই গন্ধটা আজও আটকে আছে। আর আটকে আছে সেই গন্ধের ওপর বিছিয়ে থাকা বিকেলবেলার বইমেলায় রবীন্দ্রনাথের গান: ‘হৃদয় আমার আকুল হল, নয়ন আমার মুদে এল রে।’
মনে আছে, ভোলা সম্ভব নয় বলেই মনে আছে, কলকাতার সেই ময়দান বইমেলায়, এক পশলা বৃষ্টির সোঁদা সুবাস যখন মিশছে বিকেলের মিঠে রোদে, আর মাইকে বাজছে, ‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে–’, তিনি আর আমি একেবারে মুখোমুখি! সমস্ত অবয়বটাই প্রায় কালো চশমায় ঢাকা। তবুও তিনি অব্যর্থ, অমোঘ সুচিত্রা সেন! কোনও কোনও মুহূর্ত মনের মধ্যে অনন্তের ফ্রেমে স্টিল হয়ে যায়। এই সেই মুহূর্ত, ফ্রোজেন ইন বিউটি! শুধু কলকাতার বইমেলায় কেন, পৃথিবীর যে-কোনও কালের যে-কোনও বইমেলার সেরা সুন্দরীকে আমার দেখা হল, এখনও ভাবি একই কথা। শুধু অন্য এক তরুণীর স্মৃতি এই প্রসঙ্গে পাশে সরিয়ে রাখছি, পরে বলব বলে।
সুচিত্রা সেনকে আগে দেখিনি, তা তো নয়। তাঁকে দেখেছি তাঁর বাড়িতে, টালিগঞ্জের স্টুডিওতে। ‘গৃহদাহ’-র শুটিংয়ে, ডিরেক্টর কাট বলার পর, বিশ্রাম পর্বে তিনি উত্তমকুমারের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ছেন কিছুটা অপ্রস্তুত পাহাড়ি সান্যালের সামনে, সেই দৃশ্যও ভুলিনি। কিন্তু কলকাতার সেই ময়দান-মহিমান্বিত সদ্য বৃষ্টিভেজা বিকেলের বইমেলায় সুচিত্রা-ঝলক যে কী পরম প্রাপ্তি! কলকাতার আর কোনও বইমেলায় কখনও ঘটবে না সেই মায়াবাস্তব!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পবিত্র সরকারের বইমেলাধুলো: বইমেলার গেটে কবি অরুণ মিত্রকে স্যালিউট করেছিল পুলিশ
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
দুপুর দুটো-আড়াইটে তখন। বইমেলা তখনও বেশ ফাঁকা। ময়দান জুড়ে ছড়িয়ে আছে মাটির গন্ধ, ঘাসের গন্ধ, শেষ শীতের আরাম, মাইকে সুচিত্রা মিত্রের রবীন্দ্রসংগীত, কিংবা একেবারে বিপ্রতীপ টান ও মাধুর্যের দেবব্রত বিশ্বাস। হঠাৎ ঢুকলেন তিনি। ছ’-ফিট দুই! না তিন! তিনি ততদিনে আমার বেশ কাছের মানুষ। বিশপ লেফ্রয় রোডে তাঁর বাড়িতে প্রায়ই যাই। কিন্তু তবুও সত্যজিৎ রায়, অন্তত আমার কাছে, কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের বিপজ্জনক ব্ল্যাকহোল, খুব কাছে গেলে অনন্তে তলিয়ে যেতে হবে, বেরনোর পথ নেই। ভিড় এড়ানোর জন্যই, শান্তিতে বই দেখা ও কেনার জন্যই সত্যজিৎ রায় বইমেলায় আসেন দুপুরবেলা। কিন্তু তিনি তো হিমালয়ের মতো। এত উঁচু যে নজর পড়বেই, বইমেলায় ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে। তখনও শুরু হয়নি মোবাইলের যুগ। কিন্তু শুরু হয়ে যায় সত্যজিতের বইমেলা দর্শনের প্রতিটি মুহূর্ত ধরে রাখার হিড়িক। দূর থেকে দেখি পাঞ্জাবি আর পাজামা পরা বিপুল ব্যক্তিত্বময়, প্রবল প্রতিভাধর বাঙালিটির নির্বাক, মিতভাষ, ভিড়বিপন্ন একাকিত্ব। মনে পড়ে, গীতবিতান-এর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের অনন্য উক্তি: ‘বহু জনতার মাঝে অপূর্ব একা।’ কলকাতার বইমেলায় কতবার দেখেছি সত্যজিৎ রায়কে। মেলার মধ্যে এমন দলছুট নিঃসঙ্গ বিপন্ন বাঙালি, তবু মহিমায় উজ্জ্বল, আমি আর একটিও দেখিনি!
কী হে কেমন চলছে সব? কী বই কিনলে? মার্কেজ-এর লেটেস্টটা পড়েছ না কি? এইভাবে মৃণালদার (মৃণাল সেন) হাত কাঁধে পড়তই পড়ত ওই ময়দানের বইমেলাতেই। মৃণালদা যেন বইমেলায় সব্বার বন্ধু। যে স্টলে ঢুকছেন, সেখানেই গড়ে উঠছে আড্ডা, বেশ মজা পাই ময়দানের বইমেলায় মৃণালদার এই চলমান আড্ডা-আসরে। যখনই ইচ্ছে ঢুকে পড়া যায়। আবার যখন খুশি কেটে পড়াও যায়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কেয়াই একদিন আমাকে কিনে দিচ্ছে বইমেলা থেকে সিমন দ্য বভোয়া-র ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটা। এবং কানে লেগে আছে তার সেই সোনালি কণ্ঠস্বর– তুই এই বইটা শেষ করার আগে মরে গেলে আমার আরও বেশি দুঃখ হবে এ-কথা ভেবে যে, কত অশিক্ষিত অবস্থায় মরে গেলি। তখন বুঝিনি, এ বই কোনও দিন শেষ করা যায় না। চোখে জল আসে কেয়ার ওই উপহারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাঙ্ময় উক্তিটি মনে পড়লে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ময়দানের সেই বইমেলায় আরও এক বড় আকর্ষণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুটিংয়ে ব্যস্ত না থাকলে বিকেল না হতেই চলে আসতেন তিনি। পাঞ্জাবি, পাজামা, শাল– এক সুমিত, সুভদ্র, বিদগ্ধ বাঙালি যুবক। সেই সময়ে আমি কোনও না কোনও সংবাদপত্রে বইমেলা নিয়ে লিখছি আর আমার সেইসব বইমেলা নিয়ে লেখা আলো করে আছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বসন্ত চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব গুহ, সমরেশ বসু এবং অবশ্যই সাহিত্যের ম্যাটনি আইডল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। আরও একজনের কথা ভুলতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সে কেয়া। ‘নান্দীকার’-এর কেয়া চক্রবর্তী। সেই সময়ে মঞ্চাভিনয়ে এক হই হই নাম। এবং আমার কলেজ-বন্ধুনী। হাতে হাত দিয়ে বইমেলা ঘুরছি। এবং মনে হচ্ছে এক-ময়দান বইমেলার সবটুকুই আমার। এই যে সারাজীবন বই পড়ে এমন ঘনঘোর আনন্দ পাচ্ছি। ভাল লাগছে বেঁচে থাকতে এত বেদনা, দুঃখ কষ্টের মধ্যেও– যারা আমাকে বইপড়ার নেশা ধরাল, তাদের একজন তো কেয়া। বইমেলা নিয়ে লিখব আর কেয়া বাদ পড়বে তা কি হয়! কেয়াই একদিন আমাকে কিনে দিচ্ছে বইমেলা থেকে সিমন দ্য বভোয়া-র ‘দ্য সেকেন্ড সেক্স’ বইটা। এবং কানে লেগে আছে তার সেই সোনালি কণ্ঠস্বর– তুই এই বইটা শেষ করার আগে মরে গেলে আমার আরও বেশি দুঃখ হবে এ-কথা ভেবে যে, কত অশিক্ষিত অবস্থায় মরে গেলি। তখন বুঝিনি, এ বই কোনও দিন শেষ করা যায় না। চোখে জল আসে কেয়ার ওই উপহারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বাঙ্ময় উক্তিটি মনে পড়লে।
ময়দানের বইমেলায় এক একদিন ছিল এক একরকম মজা। সেই মানুষগুলো নেই। সেই মজাও নেই। গভীর বেদনার সঙ্গে মজাও যে পাচ্ছি না, তা নয়, যখন শিশুর সারল্যে মাতলামি করছেন বইমেলায় ঢুকে ঋত্বিক ঘটক। কে বলবে তিনি অত বড় মাপের ফিল্ম ডিরেক্টর। যখন ঋত্বিক ঢুকছেন বইমেলায় ওলোটপালোট মাতলামি নিয়ে, সেই মাতলামি বইমেলায় মাঝেমধ্যে ছড়াচ্ছে দুশ্চিন্তা, কখন কী করে বসেন ঋত্বিক, মনে আছে স্পষ্ট। কিন্তু শক্তিদা বইমেলায় জাতে মাতাল, তালে ঠিক। ঋত্বিকের বেহুদা অবস্থার সঙ্গে শক্তিদার বিচলিত ভাবের আকাশপাতাল তফাত। তবে মাতাল না হয়ে শক্তিদা বইমেলায় আসার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারতেন না, একান্ত সত্যি! প্রায় নিখুঁত বরবেশে, বা জামাই সেজে বইমেলায় ঢুকছেন সন্ধের দিকে সমরেশ বসু। এবং রব উঠছে চতুর্দিকে সমরেশ, সমরেশ– এবং ময়দান উপচে ঢুকছেন সমরেশ বসু, ‘বিবর’ ও ‘প্রজাপতি’-র লেখক– সেই স্মৃতি কি কোনওদিন মুছে যাবে মন থেকে? আরও একটু রাত করে, ক্যালকাটা ক্লাবে সুরাস্নান সেরে, রাজার মেজাজে ময়দান-বইমেলায় প্রবেশ করছেন বুদ্ধদেব গুহ আর এসেই জিজ্ঞেস করছেন সুনীল কোনদিকে– সব মনে আছে, সমস্ত ঈর্ষাকণা, বিদ্বেষ-ছটা, মান-অভিমান সমেত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কালীকৃষ্ণ গুহর বইমেলাধুলো: বইমেলায় বাজানো হত উচ্চাঙ্গ সংগীতের ক্যাসেট
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কিন্তু পিছন ফিরে যতদূর দেখি আমার বইমেলা স্মৃতিতে রাজসিংহাসনে বসে আছেন সুনীলদা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ধারে-কাছে কেউ নেই। মনে আছে, যেখানে সুনীলদা, সেখানে নারীপ্রবাহ। সুনীলদার ব্যবহারে একই সঙ্গে মাধুর্য এবং ডাক ফুটে উঠতে দেখেছি, যেমন আর কারও ব্যবহারে দেখিনি। সুনীলদার মধ্যে অহংকার, ইগো, হোমরাচোমরা ভাব, এসব কিচ্ছু নেই। শুধু সারল্য, সৌকুমার্য, সহজতা, আমন্ত্রণ। এবং এক আশ্চর্য বিদগ্ধ কুহক, তাও কিন্তু লক্ষ করেছি। সুনীলদা এলেই সারা বইমেলা সুনীলদার হয়ে যায়– দেখেছি কতবার! সেই মানুষই গ্রাস করে নেয় পুরো এক-ময়দান সামান্য বৃষ্টি কিংবা জ্যোৎস্না-ভেজা কলকাতা বইমেলা, যে কী সহজে লিখতে পেরেছে, ‘নবীন কিশোর, তোমায় দিলাম ভুবনডাঙার মেঘলা আকাশ তোমাকে দিলাম বোতামবিহীন ছেঁড়া শার্ট, আর ফুসফুসে ভরা হাসি দুপুর রৌদ্রে পায়ে পায়ে ঘোরা’… মনে আছে আমার, সুনীলদার পায়ে পায়ে ঘুরছি কলকাতার বইমেলায় আর মন বলছে আমার, ‘আমার যৌবনে তুমি স্পর্ধা এনেছিলে’। এই ঋণ, সুনীলদা কোনও দিন শোধ হবে না।
আরও এক ঋণ বইমেলার কাছে। গুয়াহাটির বইমেলায় চলেছি আমি আর ‘পত্রভারতী’ প্রকাশনার কর্ণধার, আমার বহু বইয়ের প্রকাশক, বন্ধু ত্রিদিব চট্টোপাধ্যায়। ফ্লাইটে উঠেছি। প্লেন ছাড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে। তখনও খোলা আছে মোবাইল ফোন। হঠাৎ বাজল। এবং এল একটি সংক্ষিপ্ত বার্তা। আমার প্রথম স্ত্রী মারা গেছেন। এবং সেই দিনই গুয়াহাটি বইমেলার উদ্বোধনে আমার কিছু বলার কথা। সারা ফ্লাইট আমি বেশি কথা বলিনি। ত্রিদিবও চুপচাপ। মাঝেমধ্যে আমার হাতটা চেপে ধরছে।
শেষ পর্যন্ত পৌঁছলাম সেই হোটেলে, যেখানে আমার আর ত্রিদিবের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এবং আমাদের যে-ঘরে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে, সেটি সদ্য বিবাহিত মধুচন্দ্রিমা-দম্পতির জন্য! ত্রিদিব কী বলবে বুঝতে পারছে না। তারপর ভাগ্যের এই তির্যক বিদ্রুপের মুখের ওপর ত্রিদিব খুলল স্কচের বোতল। ঢেলে দিল আমার গ্লাসে। বইমেলার এই সন্ধেটির কাছেও আমি ঋণী। মনে আছে, এক পশলা শীতের বৃষ্টি হয়ে গেল। তারপর এক মাঠ বই। একমাঠ ঘাস। একমাঠ ভিজে মাটি। সব মিলেই তো জীবনের গন্ধ। বই-ভর্তি জীবনের কাছে মানুষের ঋণ কি ফুরোবে কোনও দিন?