Robbar

প্রধান বিচারপতিকে জুতো ছোড়া সংবিধানকেই পদদলিত করার চেষ্টা

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 12, 2025 8:37 pm
  • Updated:October 12, 2025 8:37 pm  

যে ব্যক্তি গত ৬ অক্টোবর ভারতের প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়েছেন, তিনি নিজে বলেছেন তিনিও একজন দলিত, যদিও সেই সংক্রান্ত কোনও শংসাপত্র তিনি পেশ করেননি বা তাঁর থেকে তা দেখতেও চায়নি কোনও গণমাধ্যম। ওই ঘটনার পরে পুলিশ তাঁর কাছ থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করে, যাতে একটা স্লোগান লেখা ছিল, ‘সনাতন ধর্ম কা অপমান, নেহি সহেগা হিন্দুস্তান’ অর্থাৎ যারা সনাতন ধর্মের অপমান করবে, তাদের ক্ষমা করবে না দেশ। বোঝাই যাচ্ছে অভিযুক্ত আইনজীবী একটা বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাস করেন বলেই এই কাজটা করতে পেরেছেন। যদিও বিচারপতি গাভাই চাননি, বিষয়টি নিয়ে ওই আইনজীবীর ওপর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক, এবং তিনি তাঁর শুনানি চালিয়ে যান ওই ঘটনার পরেও।

সুমন সেনগুপ্ত

১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এক বছরও হয়নি। ভরা সভায় সকালবেলা জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করেন নাথুরাম গডসে নামে এক হিন্দুত্ববাদী নেতা। ২০২৫ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দেশের দ্বিতীয় দলিত প্রধান বিচারপতি বি.আর.গাভাইকে ভরা এজলাসে জুতো ছুড়ে মারেন এক আইনজীবী রাকেশ কিশোর। এই দু’টি ঘটনার মধ্যে সময়ের ফারাক থাকলেও, গুরুত্বের নিরিখে দুটো ঘটনাই প্রায় সমান। যে শক্তি সেদিন মেনে নিতে পারেনি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতা, ভারতের সংবিধান, তারাই আজ ক্ষমতায় আসীন। সেদিন তাদের প্রবল আপত্তি ছিল ভারতের সংবিধানকে, ভারতের জাতীয় পতাকাকে মেনে নিতে। তাই গত ১১ বছর ধরে তারা ক্ষমতার মসনদে বসে আজ ভিতর থেকে ধ্বংস করতে চাইছে ভারতের সংবিধান, ভারতের সার্বভৌমত্ব এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে।

ঘটনাচক্রে যে ব্যক্তি গত ৬ অক্টোবর ভারতের প্রধান বিচারপতিকে লক্ষ্য করে জুতো ছুড়েছেন, তিনি নিজে বলেছেন তিনিও একজন দলিত, যদিও সেই সংক্রান্ত কোনও শংসাপত্র তিনি পেশ করেননি বা তাঁর থেকে তা দেখতেও চায়নি কোনও গণমাধ্যম। ওই ঘটনার পরে পুলিশ তাঁর কাছ থেকে একটি চিরকুট উদ্ধার করে, যাতে একটা স্লোগান লেখা ছিল, ‘সনাতন ধর্ম কা অপমান, নেহি সহেগা হিন্দুস্তান’ অর্থাৎ যারা সনাতন ধর্মের অপমান করবে, তাদের ক্ষমা করবে না দেশ। বোঝাই যাচ্ছে অভিযুক্ত আইনজীবী একটা বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাস করেন বলেই এই কাজটা করতে পেরেছেন। যদিও বিচারপতি গাভাই চাননি, বিষয়টি নিয়ে ওই আইনজীবীর ওপর আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হোক, এবং তিনি তাঁর শুনানি চালিয়ে যান ওই ঘটনার পরেও। পরে তিনি বলেন, তাঁর বিশ্বাস এতটাও ঠুনকো নয়, তাঁর সংবিধান এবং তাঁর প্রণেতা আম্বেদকরের ওপর আস্থা আছে এবং তিনি হচ্ছেন শেষতম মানুষ, যাঁর অহং এই তুচ্ছ আক্রমণে আহত হয়।

আইনজীবী রাকেশ কিশোর

ঘটনার সূত্রপাত কোথা থেকে তা জানা জরুরি। ৭১ বছর বয়সি রাকেশ কিশোর একজন বিশিষ্ট আইনজীবী, যাঁর প্রধান বিচারপতির আদালতে প্রবেশাধিকার ছিল, তিনি স্পষ্টতই প্রধান বিচারপতি গাভাইয়ের সাম্প্রতিক মন্তব্যে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, যেখানে তিনি একটি জনস্বার্থ মামলা (পিআইএল)-কে ‘প্রচার স্বার্থ মামলা’ হিসাবে খারিজ করে দিয়েছিলেন। ওই জনস্বার্থ মামলায় মধ্যপ্রদেশের খাজুরাহোতে ইউনেস্কোর ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলির মধ্যে একটিতে ভগবান বিষ্ণুর একটি জীর্ণ মূর্তি পুনরুদ্ধারের দাবি করা হয়েছিল। এটিকে একটি রাজনৈতিক প্রচারের কৌশল বলে উড়িয়ে দিয়ে বিচারপতি গাভাই মন্তব্য করেছিলেন, ‘যাও এবং দেবতাকে নিজেই কিছু করতে বলো। যদি তুমি মনে করো যে তুমি ভগবান বিষ্ণুর একজন দৃঢ় ভক্ত, তাহলে তুমি প্রার্থনা করো এবং কিছু ধ্যান করো।’ এই খারিজ করে দেওয়াতে আইনজীবী কিশোর অত্যন্ত আহত হয়েছিলেন বলে পরে জানা যায়। যিনি ঘটনাচক্রে তাঁর কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে, প্রধান বিচারপতির দিকে জুতা ছোড়ার মতো জঘন্য কাজ করতেও তিনি দ্বিতীয়বার ভাবেননি। যে সনাতন ধর্ম তাঁকে দিয়ে এই কাজটা করাল, সেই সনাতন ধর্ম তাঁকে একবারও আটকাল না এই খারাপ কাজ করা থেকে– এই প্রশ্নও অনেকে করছেন। অনেকে বলছেন প্রধান বিচারপতির মন্তব্য ওই আইনজীবী রাকেশ কিশোরের এত আপত্তিকর কেন মনে হয়েছিল? এটা এমনকী তাঁকে উদ্দেশ্য করেও বলা হয়নি। সর্বোপরি, বিচারপতি গাভাই কেবল একজন কথিত বিশ্বাসীকে তাঁর বিশ্বাস সম্পর্কে আরও গভীর প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে বলেছিলেন।

এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তরে পৌঁছতে গেলে আরও গভীরে যেতে হবে। যে সময়টাতে আমরা এখন আছি, সেই সময়টাকে ভালো করে পর্যালোচনা করতে হবে। হিন্দুত্ববাদী শক্তিরা যতই দেখানোর চেষ্টা করুক, যে দলিত আদিবাসীরাও হিন্দু, আসলে ভেতর থেকে তারা বিষয়টা বিশ্বাস করে না। তাদের কাছে হিন্দু এবং ব্রাহ্মণ সমার্থক। অন্যান্য হিন্দুদের তারা মনে করে না ‘সঠিক হিন্দু’ বলে, যার ফলে এই সময়ে দেশের নানা প্রান্তে তারা দলিতদের সমানাধিকার দিতে অনাগ্রহী। দেশের রাষ্ট্রপতি কিংবা প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁরা যতই আদিবাসী কিংবা দলিত হিসেবে দেখাক, তাঁদের মননে একটাই সমসত্ব চিন্তাধারা কাজ করে। একমাত্র হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তানের যারা সমর্থক, তারাই আসল হিন্দু। আজও গুজরাত থেকে শুরু করে নানা জায়গায় রোজ কোনও না কোনও ঘটনার কথা আমরা শুনতে পাই, যেখানে উচ্চবর্ণের দ্বারা নিপীড়নের শিকার হন দলিতেরা। বিয়ে করতে যাওয়ার সময়ে যদি কোনও দলিত ঘোড়ায় চড়েন, বা কোনও উচ্চপদে যদি শিক্ষা ও মেধার জোরে কোনও দলিত, আদিবাসী বা নীচুজাতির কেউ বসেন, আজকেও তাঁকে মৌখিক বা শারীরিক আক্রমণের শিকার হতে হয়। প্রস্রাব করে দেওয়া হয় দলিত মানুষদের মুখে, নানা অজুহাতে কেড়ে নেওয়া হয় তাঁদের সাংবিধানিক অধিকার, ধর্ষিতা হতে হয় হাথরাসে দলিত কিশোরীকে।

বিচারপতি বি.আর.গাভাই

রাকেশ কিশোর এবং অন্যরা এখন হয়তো তর্ক করতে পারেন এবং হয়তো প্রচুর সমর্থক পাবেন যে, ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ পরিবারের সদস্য বিচারপতি গাভাইয়ের সনাতন ধর্ম সম্পর্কে মন্তব্য করার অধিকার নেই। যেমন অধিকার নেই প্রধান বিচারপতি গাভাইয়ের মায়ের, আরএসএসের শতবর্ষের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখান করার। হিন্দু ধর্মের স্বঘোষিত রক্ষকরা অপ্রত্যাশিত মাত্রায় দায়মুক্তি উপভোগ করছেন, যা কেবল এই ধারণাকেই বৈধতা দেয় না বরং স্বাভাবিক করে তোলে যে তারা যা দাবি করে যে, তাদের ভাবনাচিন্তা ছাড়া কোনও কিছুই পবিত্র নয় এবং তাদের ধ্যানধারণাই একমাত্র একটি সাংস্কৃতিক লড়াই, যা তারা দীর্ঘদিন ধরে লড়ে আজ জেতার দোরগোড়ায় এসে পৌঁছেছে। তারা রাস্তায় একজন মুসলিম মানুষকে গালিগালাজ করতে পারে, একজন দলিত শ্রমিককে জনসমক্ষে চাবুক মারতে পারে, তারা মহিলাদের ধর্ষণের হুমকি দিতে পারে, একটি দরিদ্র শিশুকে তাদের বিশ্বাসের ভিত্তিতে খাবার দিতে অস্বীকার করতে পারে, একজন বিরোধী নেতার মাকে গালিগালাজ করে উপহাস করতে পারে এবং তারা প্রধান বিচারপতির দিকে জুতো ছুড়ে মারতে পারে। কেউই তাদের কিছু বলবে না, সেটা তারা বুঝে গেছে।

দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়তো নম নম করে এই ঘটনার নিন্দে করেছেন, দেশের প্রায় সমস্ত বিরোধী দলের পক্ষ থেকে এই ঘটনা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করা হয়েছে, কিন্তু পিছন থেকে বহু মানুষ অভিযুক্ত রাকেশ কিশোরের ওই আচরণকে সমর্থন করছে, যার ফলেই তিনি এখনও বহাল তবিয়তে ঘুরছেন। কয়েক বছর আগে যখন এই সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছিল, বাবরি মসজিদের জায়গায় রামমন্দির করা হবে, তখন কি তাতে কোনও একজন সংখ্যালঘু মানুষের সায় ছিল? তা সত্ত্বেও একজন সংখ্যালঘু মানুষ কি তৎকালীন প্রধান বিচারপতিদের উদ্দেশ্যে একটাও কটু কথা বলেছিল? কিংবা একজন সংখ্যালঘু মানুষকে কি পাওয়া গিয়েছিল, যে উত্তেজিত হয়ে বিচারব্যবস্থার উদ্দেশ্যে জুতো ছুড়েছে?

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর

না, তা তারা করেনি, কারণ তারা জানে যে বিচারব্যবস্থা বা প্রধান বিচারপতির দিকে জুতো ছোড়া আসলে সংবিধানের দিকে জুতো ছোড়া। যে সংবিধান এখনও আছে অন্তত খাতায় কলমে, সেই সংবিধানকে সম্মান করাটাই কাজ, সেই সংবিধানই একদিন তাদের হৃত সম্মান, সমানাধিকার ফিরিয়ে দেবে। তাই আজকের রাকেশ কিশোর কিংবা সেদিনের নাথুরাম গডসে হয়তো কিছু লোকের কাছে, কিছুদিনের জন্য পূজিত হবেন, কিন্তু মহাত্মা গান্ধী বা আম্বেদকরদের সম্মান করা হবে সর্বত্র, সারা বিশ্বে। যারা গডসের পূজারি বা গোলওয়ালকরের সমর্থক তাদেরকেও গান্ধীর জন্মদিনে বা আম্বেদকরের জন্মদিনে মাথা নোয়াতেই হবে, লোক দেখাতে হলেও হবে।