Robbar

উত্তরবঙ্গ যতটা ‘বেওসা’ কেন্দ্র হয়েছে, ততটা প্রাণের হয়নি

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 6, 2025 7:05 pm
  • Updated:October 6, 2025 7:05 pm  

শহরের দূষণ ও কোলাহল থেকে দু’দিনের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নির্জনতা উপভোগ করে যে যাঁর মতো বাড়ি ফিরে গেলেন। যত আপনার আসা-যাওয়া বাড়ল, আপনার কথা শুনে বন্ধুদের আসা-যাওয়া বাড়ল, তার কথা শুনে তার বন্ধুদের আসা-যাওয়া বাড়ল, নির্জন জায়গাটি আর ‘নির্জন’ থাকল না। আমরা চিরকাল জেনেছি, পাহাড়ে পানীয় জলের অভাব। সরু ধারায় জল আসত, আর সারাদিন ধরে পাহাড়ের মানুষ বালতি ভরে ভরে টেনে নিয়ে চলে যেত ঘরে। এখন সেখানে ঘরে ঘরে হোমস্টে। পথে পথে হোটেল।

সেবন্তী ঘোষ

কিছু লেখার সময় কলম সরে না। যাঁরা জড়িয়ে-মড়িয়ে দ্রুত কথা বলেন, তাঁদের ভাবনাগুলো না কি এমন পরপর এসে যেতে থাকে যে, এ-ওর গায়ে উঠে পড়ে। এখন ঠিক এমন অবস্থা আমার। কোন কথাটা একটু নরম পাকের, আর কোনটি ফুল বয়েল হবে, সেটির দিশা পাচ্ছি না। তাই যেমন তেমন একটা ধরতাই শুরু হল।

ভারতে ‘পশ্চিমবঙ্গ’ বলে একটি রাজ্য আছে, যার আবার একটি অঙ্গরাজ্য আছে, যার নাম ‘উত্তরবঙ্গ’। দেশভাগের সময়ে পূর্ববঙ্গের পশ্চিম দিক বলে আমরা হয়েছিলাম পশ্চিমবঙ্গ। ওই পশ্চিম এখন আসলে দক্ষিণবঙ্গ। তার ‘উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ’ বলে বাস এবং ‘উত্তরবঙ্গ’ নামে ট্রেন সার্ভিস আছে। এমন অবাক কাণ্ড, উত্তর বা মধ্য অন্ধপ্রদেশ বা উত্তর দক্ষিণ উত্তরপ্রদেশ কল্পনাও করা যায় না! এই উত্তরবঙ্গে ক’টি জেলা আছে কলকাতা বা তার আশপাশের লোকজন ঠিকভাবে বলতেও পারেন না। কারণটা স্বাভাবিক, যা মানুষের প্রয়োজনে লাগে না তা নিয়ে সংখ্যাগুরু (ধর্ম নয়, সংখ্যায়) জনগণ ভাবিত নন। যেমন আমাকে কেউ বলল তাকে সামব্রুম যেতে হবে। আমি ধরে নিলাম তা বরবুদুরের আশপাশে বা ইন্দোনেশিয়ার কোনও একটা জায়গা। তা যে অরুণাচলের একটি সীমান্ত এলাকা, তাই জানতাম না। ভারত এমন একটি বড়সড়, জটিল দেশ যে, সব কিছু মনে রাখা সম্ভব নয়। দক্ষিণবঙ্গের হাতিবাগান বা হালিশহরের মতো প্রাচীন এলাকার লোক যখন প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম গন্তব্য খুঁজছেন, তখন বিরিকদাড়া, সানুখোলা, চুমুকডাঙির মতো ভার্জিন এলাকার হোমস্টে পেয়ে শুদ্ধশ্বাসে আরামের শ্বাস নিচ্ছেন। কিন্তু ছুটি কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন, ওই তেলেনাপোতা আবিষ্কারের মতোই মুহূর্তের আবিষ্কার বিস্মৃতির তলায় তলিয়ে যাচ্ছে। যাচ্ছে। ওইসব এলাকাগুলো তাদের কাছে ছুটি কাটানোর, শরীর-মন পরিশুদ্ধ করার আরোগ্য নিকেতন বা কখনও কখনও ফুর্তির বিনোদন।

শহরের দূষণ ও কোলাহল থেকে দু’দিনের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস টেনে নির্জনতা উপভোগ করে যে যাঁর মতো বাড়ি ফিরে গেলেন। যত আপনার আসা-যাওয়া বাড়ল, আপনার কথা শুনে বন্ধুদের আসা-যাওয়া বাড়ল, তার কথা শুনে তার বন্ধুদের আসা-যাওয়া বাড়ল, নির্জন জায়গাটি আর ‘নির্জন’ থাকল না। আমরা চিরকাল জেনেছি, পাহাড়ে পানীয় জলের অভাব। সরু ধারায় জল আসত, আর সারাদিন ধরে পাহাড়ের মানুষ বালতি ভরে ভরে টেনে নিয়ে চলে যেত ঘরে। এখন সেখানে ঘরে ঘরে হোমস্টে। পথে পথে হোটেল। ইন্ডিয়ান স্টাইলের বদলে ওয়েস্টার্ন স্টাইলের ফ্ল্যাশের গ্যালন গ্যালন জল এই দু’দিনের অতিথিরা ব্যবহার করে ফেলছেন। ঝোরার মুখ বন্ধ করে সস্তা মোমোর দোকানে পর্যটকরা সোনামুখ করে খায় আর এখানে কত সস্তায় থাকা খাওয়া যায় এমন রিল বানায়। দেখি আর শিউরে উঠি!

বেশিরভাগ দক্ষিণের মানুষগুলো ভুলে যান তাঁরা একই রাজ্যের বাসিন্দা। বাঁকুড়া-পুরুলিয়া যেমন জলের অভাব– পুরো পাহাড় এলাকা জুড়েই তাই। এবারে প্রশ্ন হল, পাহাড়ের মানুষরা কি বোঝেন না যে, এইভাবে যে কোনও জায়গায় বাসস্থান তৈরি করলে ধ্বস নেমে যেতে পারে? অবশ্যই জানেন, যখন কড়া প্রশাসন বলে কিছু থাকে। মানুষ ভোট দিয়ে প্রশাসককে আনে, যাতে এই ধরনের বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়। স্থানীয় প্রশাসককে কী-ই বা বলবেন? দেশের মাথায় যাঁরা বসে আছেন, তাঁরা পরিবেশবিদদের কোনও কথা আমল না দিয়ে নির্বিচারে পাহাড়ি রাস্তা চওড়া করে চলেছেন, ডুয়ার্স জুড়ে গাছ কেটে এমন সব চওড়া রাস্তা হচ্ছে একমাত্র যুদ্ধে যাওয়ার ট্যাঙ্ক ছাড়া সাধারণ মানুষের কোনও প্রয়োজনে লাগবে না। আর সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ জাহাজগুলি যাবে তো দেশবাসীকে বাঁচাতে, তাঁরাই যদি প্রাকৃতিক দুর্যোগে মরে বা মরণাপন্ন হয়ে যায়, তাহলে দেশটা রইল কোথায়? পরিবেশ দফতর যেন দুধ-ভাতের বিষয়, পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বা সচেতকরা যেন অবৈজ্ঞানিক কথা বলছেন, এমনটাই ভাবেন তাঁরা। অগ্রাধিকার দেশরক্ষা এবং দেশরক্ষা, কিন্তু দেশটায় যদি না থাকে তো রক্ষাটা করবেন কী?

আমরা শৈশবে জানতাম, ঘোর বর্ষায় পাহাড়ে কাজ ছাড়া এমনি যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পাহাড়ে ছোটখাটো ধ্বস নামা অতি স্বাভাবিক বিষয়। সেখানে বড় কিছু ক্ষতি হত না, প্রাণহানি হয় না, কারণ যেখানে সেখানে বাড়িঘর করে মানুষ থাকতই না। নদীর দু’পাশে চর বলে একটা বস্তু আছে, যে কোনও সময় নদী সেদিকে চলে যেতে পারে। দু’চার বছর নদী সেদিকে গেল না বলেই সেখানে কংক্রিটের কাঠামো তৈরির অনুমতি কী করে চলে এল, সেটাও তো ভাবতে হয়। আর কিছুদিন আগে শুনেছি, ওই দক্ষিণবঙ্গের প্রচুর পরিমাণে মানুষ, বিশেষ করে কলকাতার মানুষরাই পাহাড়ের বিভিন্ন হোমস্টের বকলমে মালিক। যেমনটা শান্তিনিকেতনে সোনাঝুরি হাটে ঘটেছে। তাহলে দাঁড়াল এই, উত্তরবঙ্গের অপরূপ প্রকৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে এক ‘বেওসা’ কেন্দ্র। তা সেখানে যাঁরা ব্যবসা করছেন, এলাকা বিষয়ে তাদের সম্যক ধারণা আছে কি?

এবার আপনি উল্টে ভাবুন, টুরিস্ট স্পট বলে যেটা আপনি মনে করছেন সেটা আসলে স্থানীয় কিছু মানুষের বাসস্থান। তার রোজকার বেঁচে থাকার জায়গা। আপনি সেখানকার জল খরচ করে চলে এলেন, যে জল আদৌ পর্যাপ্ত নয়। আপনি সেখানকার সাংস্কৃতিক, পারিবারিক ঐতিহ্য বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারণা রাখেন না। দুর্গম পাহাড়ি গ্রামের গৃহস্থের বাড়িতে কোনও সম্ভ্রম না দেখিয়ে, সন্ধে হলেই চিলি চিকেন আর বিরিয়ানির অর্ডার দেবেন আর না পেলে ভ্রমণ কোম্পানিকে ‘প্রতারক’ বলে গালি! অথচ এই দেশ নাকি আপনার দেশ, এই রাজ্য নাকি আপনার রাজ্য। এই কেকের ভাগ কাউকে এক টুকরো দেবেন না আপনি। কিন্তু মনে রাখা দরকার, অধিকার ফলাতে এলে দায়িত্বও থেকে যায়।

প্রশ্ন উঠবে, কীভাবে দায়িত্ব পালন করবেন আপনি? বিপর্যয়ে অর্থসাহায্য তো আছেই, তার সঙ্গে দরকার প্রতিবেশীকে জানা এবং চেনা। এবারে মোক্ষম প্রশ্নটি আমার দিকে ছুড়ে দিতে পারেন, কেন, সরকারকে আমরা কর দিই, তারই তো দায়িত্ব সবার আগে। আমরা সাধারণ জনগণই সরকারকে নির্বাচন করেছি। তারা তাদের কাজ করবে কি করবে না, তা নিয়ে আমরা চাপটুকু বাড়াতে পারি মাত্র বা প্রয়োজনে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারি, কিন্তু নিজেদের দায় অস্বীকার করতে পারি না। আমাদের মধ্যে থেকেও তো কেউ কেউ সরকারে থাকে। আমাদের সার্বিক মানসিকতা বদল না হলে উত্তর-দক্ষিণের মাঝখানে গঙ্গা তার খেয়ালি জলধারা নিয়ে ভাঙন ধরাবে, বিচ্ছেদ আরও প্রবল ও অনিবার্য হবে। কলকাতার জলে তড়িদাহত হয়ে মৃত্যুতে আমরা উত্তরে বসে যতটা দুঃখ পেয়েছি, পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধ্বসে মৃতদের জন্য ঠিক ততটাই দুঃখ সহানুভূতি আশা করব। অভয়ারণ্য থেকে জলে ভেসে আসা মৃত গণ্ডার, হরিণের জন্য আমাদের বুক ফেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের আচরণ শোধরানো দরকার। দুর্ভাগ্য এই, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য ৯০ ভাগ আমরা মানুষরা দায়ী, কিন্তু এই জীবজন্তুরা নিরপরাধ হয়ে সেই দুর্ভাগ্যের বলি হচ্ছে।

এই প্রসঙ্গে নিজের একটি বহু পুরনো লেখা দেওয়ার লোভ সামলাতে পারলাম না।

পর্যটক

পাহাড় বিষয়ে আমাদের কমবেশি মোহ আছে। অর্কিডের মৃদুগন্ধ পেরিয়ে ঝুলন্ত সাঁকো আর পিচ্ছিল সিঁড়ি নেমে আমরা শিহরিত হই, আটত্রিশ রকম রডোডেনড্রন আর ছত্রিশ জাতের বুনো পোকার খবর দেয় গাইড, ক্যামেরার লেন্স ধাওয়া করে গালফাটা শিশুর দিকে, মামুলি পাথরে চমৎকৃত, পাজামা থেকে টেনে ফেলি ঘাস কুচি, স্থানীয় মদ খুঁজি, অশিক্ষার বহর দেখে চমকে যাই, নদীর দিকে ছুড়ে দিই থুতু। ফেরার সময় বলে যাই, এ আর কী, গতবার নর্থের যা দেখেছিলাম!

চালসার দিকে পথ গেছে, তুমি গাড়ির জানলায় শীকর বিন্দু দেখছ, দেখছ উন্মত্ত ফার্ন, থেঁতলানো বন পথ, অগভীর বনানী, কাঠের আগুনে ভাত ফুটছে, খাঁচায় ছটফট করছে বিরক্ত চিতা, টেমির আলোয় টুরিস্ট দিদিমণির জন্য মুরগি রাঁধছে পদম বাহাদুর, বন বাংলোয় আমরা ম্যাপের দিকে ঝুঁকে আছি, দেখছি আর উত্তেজনায় কাঁপছি, আমাদের চোখের সামনে সমান্তরালে ছড়িয়ে পড়েছে, আরো, আরো, ভার্জিন ফরেস্ট।