বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা-র গুরুত্ব বদলে যায়। যেমন প্রথম প্রেম এলে পরের পুজোটা হয়ে যায় প্রথম পুজো। দু’দিন আগেও যে টিনএজার মধ্যরাতের আড্ডায় বন্ধুদের টেনে বের করত নাছোড়বান্দা জিদ নিয়ে, সে ফাঁকা খোঁজে বেপাড়ার পার্কের বেঞ্চে। অথবা, শাটার টানা দোকানের আর লঞ্চ ঘাটের সিঁড়ি কিংবা কলেজ ফেস্টের মঞ্চ পেরিয়ে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া একলা ক্লাসরুমে। এইভাবে ফাঁকা শব্দটি অথবা ঘটনাটি একাধারে দুঃখ দিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে আমায় আবার একইসঙ্গে প্রেমের তাগিদে বা নিজেকে চেনার তাড়নায় হয়ে উঠেছে একটি মহার্ঘ্য বস্তু।
সেই বছর আমাদের কলেজে বাইরের কোনও কলেজের প্র্যাক্টিকাল পরীক্ষার সিট পড়েছিল, তা এখন আর মনে নেই। তবে দরজার ফাঁক দিয়ে বহিরাগত ছাত্রদের নাকানি-চোবানির দৃশ্য এখনও স্মৃতিতে উজ্জ্বল। এইরকম সব সিচুয়েশনে নিজেদের খুব পাওয়ারফুল মনে হয়। তার ওপর আমাদের শিক্ষক অজয়বাবুর মতো অদ্ভুত প্রশ্ন যদি কেউ করেন, তাহলে তো কথাই নেই। অজয়বাবু হাতে একটি ডায়োড ভাল্ভ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর ভেতর কী আছে?’ ছেলেটি এমনিতেই ঘাবড়ে আছে, আমতা আমতা করে উত্তর দিতে থাকে– ক্যাথোড, অ্যানোড ইত্যাদি। আর কী আছে? যা আছে বললে সেগুলো আর কাচের মাঝখানে কী আছে? ছেলেটি নার্ভাস হয়ে যায়– ‘ওখানে তো কিছু নেই স্যর, একদম ফাঁকা।’ স্যর ভুরু কুঁচকে ঘাড় নাড়েন। আমরাও কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়ি, কারণ আগামীতে আমাদেরও এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। কিছুক্ষণ পরেই ছেলেটি হাল ছেড়ে দিয়ে প্রায় কেঁদে ফেলে। অজয়বাবু বিরক্ত হন– ‘ভ্যাকুয়াম আছে বলতে পারলে না?’ ছেলেটি শূন্য দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলে, ‘সরি’।
এই ঘটনার তিন দশক পরেও আমার স্পষ্ট মনে পড়ে, সেদিন রাতে ফাঁকা আর ভ্যাকুয়াম– এই দুই শব্দ নিয়ে ধন্দে ছিলাম। তখন মনে পড়েছিল আরও এক দশক আগের কথা, যেবার দুর্গাপুজোয় কোন অজ্ঞাত কারণে আমি, আমার এক সদ্য অবসরপ্রাপ্ত আত্মীয় এবং তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে মধুপুর বেড়াতে যাওয়ার বায়না করি। ষাটোর্ধ্ব জনা পনেরো পুরুষ আর এক নাবালক। এর ফলে পুজোর দিনগুলো যেভাবে কেটে যাওয়ার ছিল, সেভাবেই কাটে। বড়রা তাস খেলেন, চা খান, চুরুট ফোঁকেন আর আমি ইতিউতি ঘুরে বেড়াই। তখন না ছিল মোবাইল, না ছিল টিভি। বাড়িতে ট্রাঙ্ক কল করে পৌঁছন সংবাদ দেওয়া হয়েছে। এইরকম ট্রিপে একবার নিজেকে কমিট করে ফেললে আর ফেরার উপায় নেই। তাই দাঁতে দাঁত চেপে কাটিয়ে দিই কয়েকটা দিন। ঝটকা লাগে হাওড়া থেকে কলকাতায় ঢুকেই। একের পর এক ফাঁকা প্যান্ডেল আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে, অবিশ্বাসের দৃষ্টি। কোথাও রং একটু চটে গেছে, কোথাও বা হেলে রয়েছে বাঁশ, বিজ্ঞাপনের হোর্ডিংগুলোরও আর ঝুলে থাকার ইচ্ছে নেই বলেই মনে হয়। কোথাও বা প্যান্ডেল খুলে ছোট করা হচ্ছে, কোনওরকমে লক্ষ্মীপুজোটা উতরে দেওয়ার জন্য। পাড়ায় এসে বন্ধুদের দেখে আর তাদের গল্প শুনে একদলা কষ্ট গলায় আটকে যায়। আমার মন তখন একেবারে ফাঁকা, ওই ডায়োড ভাল্ভের মধ্যে বসত করা ভ্যাকুয়ামের মতো, যেখানে অক্সিজেন নেই।
…………………………………………..
অঞ্জলির সময় যদি বৃষ্টি নেমে আসে প্যান্ডেল ফুঁড়ে তাহলে কি মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ করবেন পুরোহিত? ফুল হাতে পালিয়ে যাবেন মানুষ? মেঠো ইঁদুরে ঠুকরে খাবে নৈবেদ্য? আর ফাঁকা মণ্ডপে একা হয়ে যাবেন ঠাকুর ও তাঁর পরিবার? যেদিন সত্যিই খোলা হল ম্যারাপ, উঠে গেল ধর্না, জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম সেই ভবঘুরেকে। আবার ফুটপাথ থেকে রাস্তা, হাত পাতা গাড়ির জানলায়। এর পর রং হল অফিস বাড়ির দেওয়াল, আলকাতরা মেখে নিল রাস্তা, ঠিক যেভাবে সম্বৎসর পুজোর পর ঘোর ভাঙে আমার পাড়ার।
…………………………………………..
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ফাঁকা-র গুরুত্ব বদলে যায়। যেমন প্রথম প্রেম এলে পরের পুজোটা হয়ে যায় প্রথম পুজো। দু’দিন আগেও যে টিনএজার মধ্যরাতের আড্ডায় বন্ধুদের টেনে বের করত নাছোড়বান্দা জিদ নিয়ে, সে ফাঁকা খোঁজে বেপাড়ার পার্কের বেঞ্চে। অথবা, শাটার টানা দোকানের আর লঞ্চ ঘাটের সিঁড়ি কিংবা কলেজ ফেস্টের মঞ্চ পেরিয়ে হঠাৎ খুঁজে পাওয়া একলা ক্লাসরুমে। এইভাবে ফাঁকা শব্দটি অথবা ঘটনাটি একাধারে দুঃখ দিয়েছে, ভয় দেখিয়েছে আমায় আবার একইসঙ্গে প্রেমের তাগিদে বা নিজেকে চেনার তাড়নায় হয়ে উঠেছে একটি মহার্ঘ্য বস্তু।
ভবিষ্যতে যখন মার্কিন দেশে যাব, মাইলের পর মাইল উজিয়ে পৌঁছব ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কে, তখন পাহাড়ের মাথায় ভিউ পয়েন্টে ফাঁকা বেঞ্চ দেখেও বসতে ইচ্ছে করবে না। বোধহয় ভয়ে। ওই বেঞ্চে বসে সামনে তাকালেই দিগন্ত বিস্তৃত উপত্যকা, অদ্ভুতদর্শন পাহাড়ের মাথা, একটার পর আর একটা। অন্যদিকে প্রাচীন সমুদ্র, নুনের অবয়ব। অর্থাৎ মৃত। সেইখানে দাঁড়িয়েও মনে পড়বে পুজোর ভাসানের রাতে ফাঁকা মণ্ডপের কথা। মনে পড়বে সেই নিকট আত্মীয়ের কথা যাঁর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আমার ছোটবেলার একটি পুজো হাতছাড়া হয়। সেই আত্মীয় যখন মারা যান, আমি কলকাতার বাইরে। কয়েকদিন বাদে যখন আসি, তাঁর ঘরে ঢুকতে পারি না সাহস করে, অদ্ভুত আড়ষ্টতায়। ফাঁকা ঘর, মাঝখানে একটি চৌকি পড়ে আছে।
…………………….
পড়ুন জয়ন্ত সেনগুপ্তর লেখা: ট্রামে হারানো ছাতা, ট্রামই ফিরিয়ে দিয়েছিল
…………………….
এক জীবন থেকে অন্য জীবন, এক চাকরির মঞ্চ থেকে আর এক, এক দেশ থেকে অন্য দেশে চৌকি পেতে শোয়া। এই ট্যাঁরাবাঁকা রাস্তায় ফাঁকা আওয়াজ তুলেছি অনেক, শুনেছিও। মিছিলে হেঁটেছি কলেজ জীবনে, যে স্লোগান তুলেছি সেটা এখন বিলকুল ফাঁকা মনে হয়। ফাঁকা চেম্বার দেখেছি মাস্তানদের হাতে। ডাক্তার বা উকিলের চেম্বার ফাঁকা হতে দেখিনি কখনও। সেখানে ধৈর্যের পরীক্ষা দিতে হয়েছে। যে ধৈর্য নিয়ে আপামর পাবলিক অপেক্ষা করে শরৎকালের জন্য। একটি বাঁশ মাটিতে গেঁথে দেওয়ার অপেক্ষা, ব্যস! যে প্যান্ডেল, যে মঞ্চ বাঁধা হচ্ছে আজ, সে তো ফাঁকাই থাকবে যতক্ষণ না ঠাকুর আসছেন। কিন্তু সেই শূন্যতায় ভালো লাগা মিশে থাকে, অপেক্ষার ভালো লাগা। তারপর উৎসব। আলো। হ্যালো মাইক টেস্টিং, হ্যালো, হ্যালো। তারপর আবার ফাঁকা। ছোটবেলার আমি প্রশ্ন করি, ঠাকুর কি অসুর মারতে আসেন? বড়দের উত্তর আসে, হ্যাঁ। তাহলে প্রতি বছর আসেন কেন? একবারে সবক’টাকে মেরে চলে গেলেই হয় না? এর উত্তর কারও কাছে নেই। কেউ ম্যানেজ করার জন্য বলেন, ঠাকুর না এলে প্যান্ডেল ফাঁকা পড়ে থাকবে, তাই। এই উত্তরটি আমার পছন্দ হয়, তবুও জনান্তিকে বলি, তাহলে সারা বছর প্যান্ডেল বেঁধে রাখলেই হয়! সেই মুহূর্তে আমার অন্তরাত্মা হয়তো নিজেকে প্যান্ডেলের ভিতরে ফাঁকা মঞ্চে বসিয়ে হাতে অস্ত্র ধরিয়ে দেয়।
সল্টলেকের রাস্তায় ধর্না চলছে। একজন মহিলা তাঁর মেয়ের হাত ধরে সেইদিকে যাচ্ছেন। মেয়েটি ভিড় এবং ব্যারিকেড দেখে একটু শঙ্কিত। সে জিগ্যেস করে, ‘এখানে কি পুজো আগেই শুরু হয়ে গেছে?’ মা বলেন, ‘হ্যাঁ, একটু এগোলেই ঠাকুর দেখতে পাবি।’
ফুটপাথে, ল্যাম্পোস্টের গা ঘেঁষে, এক ভবঘুরে বসে আছে। সে এক দৃষ্টিতে ফুড কাউন্টারের দিকে তাকিয়ে। এই জন্মে এই প্রথম সে নিখরচায় এতরকমের খাবার চেখে দেখতে পেরেছে হয়তো। শুকনো মুখে কিছু পুলিশ কনস্টেবল দাঁড়িয়ে আছেন। একজন জুনিয়র অফিসার এসে তাঁদেরই একজনকে ডেকে নিলেন, ফিসফিস করে বললেন– ‘ওদের কিছু লাগলে জানিও।’
সরকারি, বেসরকারি কর্মীরা জড়ো হয়েছেন। তাঁরাও সবাই কিছু না কিছু দিতে চান। এদিকে জল, খাবারের প্যাকেট উপচে পড়ছে। একটি করে দিন বাড়ছে আর তাল মিলিয়ে লম্বা হচ্ছে ম্যারাপ। আসছে চৌকি, পেডেস্টাল ফ্যান। নতুন টেবিল এল, ফাঁকা থাকল না এক মুহূর্ত। হোম ডেলিভারির ছেলে-মেয়েরা কয়েকটি প্যাকেট রেখে দিল তার ওপর। কে পাঠাল? এ প্রশ্ন অবান্তর।
একদিন প্রবল বৃষ্টিতে ত্রিপল খুলে জল নেমে এল। এক বৃদ্ধ দম্পতি কিন্তু এক পাও নড়লেন না। মনে হল এরকমই তো হওয়ার কথা। অঞ্জলির সময় যদি বৃষ্টি নেমে আসে প্যান্ডেল ফুঁড়ে তাহলে কি মন্ত্রোচ্চারণ বন্ধ করবেন পুরোহিত? ফুল হাতে পালিয়ে যাবেন মানুষ? মেঠো ইঁদুরে ঠুকরে খাবে নৈবেদ্য? আর ফাঁকা মণ্ডপে একা হয়ে যাবেন ঠাকুর ও তাঁর পরিবার? যেদিন সত্যিই খোলা হল ম্যারাপ, উঠে গেল ধর্না, জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখলাম সেই ভবঘুরেকে। আবার ফুটপাথ থেকে রাস্তা, হাত পাতা গাড়ির জানলায়। এরপর রং হল অফিস বাড়ির দেওয়াল, আলকাতরা মেখে নিল রাস্তা, ঠিক যেভাবে সম্বৎসর পুজোর পর ঘোর ভাঙে আমার পাড়ার। রাতে সে নিশ্চিন্ত ফাঁকায় ঘুমোয়, মাঝে মাঝে নেড়ি কুকুরের ডাক ব্যাঘাত ঘটালে পাশ ফিরে শোয়। তবে, আমার ওই আশৈশব খটকার উত্তর দিতেই যেন দিনদুয়েক পর নেমে এল বৃষ্টি, রাস্তা ধুয়ে গেল নোনাজলে আর অকস্মাৎ ফুটে উঠল কিছু মন্ত্র, যা লেখা হয়েছিল কোন এক অকালবোধনের সময়। এবং তার সঙ্গে তাল দিতে সম্পূর্ণ ফাঁকা এই সংসারে, এই ভ্যাকুয়াম চেম্বারে, ধর্ম নেমে এলেন তাঁর নিজের জায়গায়। ধর্মতলায়।
…………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………………….
স্কুল গড়ার কাজে উমাদির সঙ্গে নিরঞ্জনবাবু ছিলেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। স্কুল নিয়ে দু’জনের মধ্যে তর্ক-বিতর্কও হত খুব। যাঁরা দেখেছেন তাঁরা বুঝতেন স্কুল নিয়ে কতখানি প্যাশন ছিল দু’জনের মধ্যে সেসব তর্কে। স্কুলের কাজে চিনুদা প্রত্যক্ষভাবে জড়াননি, কিন্তু তাঁর পূর্ণ সমর্থন ছিল।