ঝুলনের পুতুল গড়ে সংসার চলে না। তাই পুতুল শিল্পীরা ঝুলনের পুতুল তৈরি ছেড়ে সব ধরনের পুতুল তৈরিতে মন দিয়েছে।
পাঁচ বন্ধু মিলে আমার প্রথম ঝুলন সাজানো। ঝুলনের পুতুল কিনতাম গ্রামের রথের মেলা থেকে। পাঁপড় ভাজা, পিঁয়াজি খেতে খেতে একেকজন বন্ধু দু’-তিনটে পুতুল কিনতাম। তারপর সবার পুতুল এক জায়গায় করে হত আমাদের ঝুলন। রথের সময় থেকেই ঝুলনের প্রস্তুতি শুরু। পরবর্তীকালে যখন বাংলার পুতুল সংগ্রহ করতে শুরু করলাম, তখন দেখলাম বাংলার পুতুলের মধ্যে ঝুলনের পুতুল একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শহরের বুকে ঝুলন কী, তা হয়তো এ প্রজন্ম খুব বেশি জানে না। কিন্তু কয়েক দশক আগেও এই কলকাতার একাধিক বাড়ির ছোটরা মেতে উঠত ঝুলন নিয়ে। তবে এই লেখা শুধু ঝুলন নিয়ে নয়, ঝুলনের পুতুল এবং যাঁরা এই পুতুল তৈরি করেন, সেই শিল্পীরা।
ঝুলন বললেই মনে পড়ে হরেক রকম পুতুল– শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন লীলা, পাশে শ্রী রাধিকা। কিংবা দোলনায় রাধা-কৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণর জন্ম। থাকত অন্য অনেক দেব-দেবীও। এছাড়া থাকত বিভিন্ন সামাজিক পুতুল, যেমন আইসক্রিম গাড়ি, গ্রামের বাড়ি, গ্রামের মানুষজন, শহরের ট্রাফিক, নেতাজি, বিবেকানন্দ, গান্ধীজি– এমন কত কিছু।
এই পুতুলগুলো বানায় কে? খুব ছোটবেলায় দেখতাম কুমোরপাড়ার একাধিক বাড়ির গৃহস্থ মহিলা, বাচ্চারা দুপুরে একতাল মাটি নিয়ে খেলাচ্ছলে ছাঁচ দিয়ে কাঁচা মাটির পুতুল তৈরি করে ফেলছে। কয়েক বছর আগে থেকে যখন বাংলার পুতুলের খোঁজ চালাচ্ছি, তখন থেকেই দেখছি পুতুল শিল্পীদের একটা উত্তর একেবারে কমন– পুতুল তৈরি করে সংসার চলে না। ছোটদের খেলার জন্য একাধিক নিত্যনতুন জিনিস এসে যাওয়ায় মাটির পুতুলের বিক্রি কমেছে। শুধু ঝুলনের পুতুল নয়, এই একই কারণে বাংলার অন্যতম মাটির পুতুল তৈরির গ্রাম মজিলপুর, শিখরবালী, কাঁঠালিয়ায় বর্তমানে পুতুল শিল্পী হাতে গোনা। পুতুল শিল্পীরা অন্য পেশা বেছে নেওয়ায়, ধিকধিক করে টিকে আছে পুতুল শিল্প।
বেলঘড়িয়া স্টেশন পেড়িয়ে নিমতার কুমোরটুলিতে বর্ষীয়ান শিল্পী আরতি পালের বাড়ি। আরতি পাল ও তাঁর স্বামী মনোরঞ্জন পাল অন্যতম উল্লেখযোগ্য শিল্পী। এই সময় তাঁদের বাড়িতে গেলে দেখা যাবে হাজার হাজার পুতুল যেন গড়গড়ি খাচ্ছে মাটিতে। এই বাড়িতে বিয়ে হয়ে আসার পর থেকেই স্বামীর সঙ্গে পুতুল তৈরি করা শুরু করেছিলেন আরতি। তাও দেখতে দেখতে ৩২ বছর হয়ে গেল। নাগেরবাজারের রথের মেলায় প্রতি বছর বসেন এই শিল্পী দম্পতি। ছাঁচে তৈরি হয় পুতুলগুলো। সারা বছর পুতুল তৈরি করে সংসার প্রতিপালন হয় না। তাই ঠাকুর গড়েন এঁরা। রাধা-কৃষ্ণ থেকে মাটির রেস্তোরাঁ, স্কুল বয়, ফুচকাওয়ালা, গ্রামের ঘর, হাতির পাল, ব্যান্ডপার্টি, ঢাকি-সহ এই রকম প্রায় পঞ্চাশ রকমের পুতুল। আরতি পালের তৈরি রাবণ আর রাম-সীতা সত্যিই চোখ টানে। ইদানীং অনেকেই ঘর সাজানোর জন্য তাঁর কাছ থেকে পুতুল সংগ্রহ করে নিয়ে যান। দিল্লি থেকে সংগ্রাহকরা এসেও তাঁদের পুতুল নিয়ে গিয়েছেন। এছাড়াও হাওড়া, বারাসত, দক্ষিণ ২৪ পরগনা-সহ একাধিক জেলা থেকেও মানুষ আসেন আরতি পালের ঝুলনের পুতুল কিনতে। এদের পুতুল শোভা পায় বরানগর বক্সীবাড়ির ঝুলনেও।
এই অঞ্চলেই আরও এক শিল্পী দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে ঝুলনের পুতুল তৈরি করে আসছেন। তিনি শিশুরানী পাল। ৮০ ছুঁইছুঁই এই শিল্পীর কাজও মনে ধরে। ওঁর কাছে আবার কদম গাছের নীচে রাধা-কৃষ্ণ দেখে চোখ টানল।
ইদানীং আগের মতো শহরাঞ্চলে বাড়ি-বাড়ি আর ঝুলন হয় না। তাই ঝুলনের পুতুলের চাহিদাও বেশি নেই। তবুও টিকে থাকবে এই পুতুল। আশায় থাকেন শিল্পীরা। এখনকার শিল্পীরা ঠাকুর গড়া ছেড়ে পুতুল তৈরিতে খুব বেশি উৎসাহী নন, বাইরে থেকে আসা পুতুলই বিক্রি করেন। এবার ঝুলনের আগে আবার কুমোরটুলিতে খারাপ খবর। সবথেকে বড় যে পুতুলের দোকানটি বসত, তাঁর কর্ণধার শম্পা পাল দত্ত অকালে চলে গিয়েছেন। নিজে খুব ভাল শিল্পী ছিলেন। আশা করি, তিনি না থাকলেও সেই স্থানে এবারও পুতুলের দোকান বসবে। এছাড়াও আরও তিন-চারটে অস্থায়ী দোকান থাকে কুমোরটুলিতে। এখানে ঝুলনের পুতুলের সঙ্গে বিক্রি হয় মাটির ছোট ছোট ইট। অবিকল আসল ইটের মতো। এমন ইট সংগ্রহে রাখার মতো। আর আপনি বিধাননগর রেলস্টেশনের ঠিক পিছনে অবস্থিত দক্ষিণদাড়ির কুমোরপাড়ায় গেলে পাবেন ঝুলনের পুতুল। যদিও সেখানেও হাতে গোনা কয়েকজনই নিজে ছাঁচে পুতুল গড়েন। বাকি অধিকাংশই পুতুল আসে বাইরে থেকেই।
ফটোগ্রাফির মস্ত শখ বিপুলদার। মাঝে মাঝেই ক্যামেরা নিয়ে বেরিয়ে পড়তেন ছবি তুলতে পত্রপত্রিকার জন্য। নানা বিষয়ে আজগুবি সব ছবি দেখেছি সে ছবি খুব একটা কোথাও প্রকাশ করতেন না। অবাক হয়েছিলাম ওঁর পাবলিক টয়লেটের প্যান ভর্তি বিষ্ঠার ছবি দেখে। অনেক। গা ঘিনঘিন করেনি, বরং মনে হচ্ছিল যেন চমৎকার সব বিমূর্ত চিত্রকলা।