হিরপুরা গ্রামের পোস্ট অফিসে তিনি কর্মরত গত ৩০ বছর ধরে, ৫৫ বছরের এই মহিলার বর্তমান পারিশ্রমিক ২২ হাজার টাকা। কাশ্মীরের এই ডাকবিভাগে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ শ্রমিক বেশি, কেউ উচ্চপদস্থ ক্লার্ক, আবার কেউ তাঁরই মতো মেইলম্যান পদের। চিঠি বা খুব ভারি পার্সেল যখন বানু পৌঁছে দেন গ্রামেরই কোনও বাড়িতে, তখন তাঁর বয়স এবং লিঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করে না কেউ। এক হাতে ছাতা নিয়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ডাক পৌঁছে দেন তিনি, বরফের রাস্তায় একাই পথ হাঁটেন অথচ কাজের ধরন বা সময়সীমা নিয়ে কোনও অনুযোগও নেই তাঁর। বিশ্বায়নের যুগে যেখানে মুঠোফোনে আয়ত্ত করা গিয়েছে গোটা দুনিয়া, সেখানে হিরপুরার মতো ছোট গ্রামকে চিঠি দিয়ে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াসে তৃপ্তি অনুভব করেন উলফৎ।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
‘রানার ছুটেছে তাই ঝুম ঝুম ঘণ্টা বাজছে রাতে,
রানার চলেছে খবরের বোঝা হাতে…
ক্লান্তশ্বাস ছুঁয়েছে আকাশ, মাটি ভিজে গেছে ঘামে,
জীবনের সব রাত্রিকে ওরা কিনেছে অল্প দামে
অনেক দুঃখে, বহু বেদনায়, অভিমানে, অনুরাগে,
ঘরে তার প্রিয়া একা শয্যায় বিনিদ্র রাত জাগে…’
পুরনো হিন্দি, বাংলা বা যে কোনও আঞ্চলিক ভাষার সিনেমায় রানারের ভূমিকায় দেখতে পেতাম খাকি প্যান্ট-শার্ট পরিহিত মধ্যবয়স্ক পুরুষকে। হাসিমুখে বা অতি-পরিচিত স্বরে ডাক পৌঁছে দিচ্ছেন চেনা কোনও বাড়িতে অথবা নির্লিপ্তভাবে চিঠি ধরিয়ে দিচ্ছেন গল্পেরই প্রধান কোনও চরিত্রের হাতে। সুকান্ত ভট্টাচার্যের ‘রানার’ই বোধহয় প্রথম এই চরিত্রটিকে ‘রক্তমাংসের মানুষ’ ভাবতে শেখাল; কোনও গল্পের পার্শ্বচরিত্র নয়, রানার তার অভিমান, অনুযোগ বা বেদনা নিয়ে নিজেই হয়ে উঠলেন মূল প্রটাগনিস্ট। শ্রমিক রানার প্রতি রাতে পাড়ি দেন শহরে-গ্রামে আর তার স্ত্রী বিনিদ্র রাত কাটান নিজের বাড়িতে। ১৯৪৩-’৪৪ সাল নাগাদ রচিত রানার কবিতাটির প্রায় ২০ বছর আগে আমেরিকায় একটি সিনেমা রিলিজ করে ‘The mailman’ নামে (১৯২৩ সাল)। একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষকে কেন্দ্র করে এই মেলোড্রামার রচনা, নানা দুঃসাহসিক অভিযান বা ঝুঁকিপূর্ণ জীবনের পরও নিউ ইয়র্কের এক মেইলম্যান কীভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচেছিলেন, সেই গল্পই দেখানো হয়েছে ইন্টারওয়ার পিরিয়েডে। কিন্তু এইসব গল্পের আধার সমাজের নিম্নবিত্ত এক শ্রমিককে নিয়ে, সরকারি কর্মচারী হলেও তিনি উচ্চপদস্থ নন এবং মহিলাও নন। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের রানার গান শুনলেও আমরা একজন শ্রমিক নারীকে কখনওই কল্পনা করি না। নারীর শ্রমের ব্যাপারটা বড়ই গোলমেলে, চার দেওয়ালের ভেতর শ্রমদান করলে সেটি আদৌ কি ‘শ্রম’ বলে বিবেচিত হয়? যদি ঘরের উঠোনে ধান ভাঙেন? বাড়ির দেওয়ালে গোবর লেপেন? বা লাল লঙ্কা শুকোতে দেন উত্তর ভারতীয় কোনও বাড়ির উঠোনে? গৃহের চৌকাঠ তো পেরনো হল না, তাহলে কি তাকে শ্রম বলা যায়?
এই প্রসঙ্গে একজনের কথা বলি, কাশ্মীরের ছোট্ট গ্রাম হিরপুরাতে থাকেন। যেখানে বছরের অনেক মাস তুষারপাতের জন্য যাতায়াত, রান্নাবান্না, বাজারহাট সবই বন্ধ থাকে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি নাগাদ জলের পাইপলাইনে বরফ জমাট বাঁধলে প্রাত্যহিক খাবার বা রান্নার জল জোগান হয়ে ওঠে দুষ্কর! এমনই হিমশীতল গ্রামে থাকেন উলফৎ বানু, যিনি মেইলম্যান হিসেবে কাজ করেন ১২ মাস। তিন থেকে চার ফুট বরফের চাঁইয়ে রাস্তা যখন আটকা, আমাদের মতো সমতলের মানুষ যখন বিস্তৃত বরফ দেখার আগ্রহে তাঁরই রাজ্যের পেহেলগাঁও বা গুলমার্গে ভিড় জমাই, তখন উলফৎ বানু তাঁর লিস্ট মিলিয়ে লম্বা বুট পরে চিঠি পৌঁছে দেন গ্রামের সব বাড়িতে। হিরপুরা গ্রামের পোস্ট অফিসে তিনি কর্মরত গত ৩০ বছর ধরে, ৫৫ বছরের এই মহিলার বর্তমান পারিশ্রমিক ২২ হাজার টাকা। কাশ্মীরের এই ডাকবিভাগে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ শ্রমিক বেশি, কেউ উচ্চপদস্থ ক্লার্ক, আবার কেউ তাঁরই মতো মেইলম্যান পদের। চিঠি বা খুব ভারি পার্সেল যখন বানু পৌঁছে দেন গ্রামেরই কোনও বাড়িতে, তখন তাঁর বয়স এবং লিঙ্গ নিয়ে প্রশ্ন করে না কেউ। এক হাতে ছাতা নিয়ে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ডাক পৌঁছে দেন তিনি, বরফের রাস্তায় একাই পথ হাঁটেন অথচ কাজের ধরন বা সময়সীমা নিয়ে কোনও অনুযোগও নেই তাঁর। বিশ্বায়নের যুগে যেখানে মুঠোফোনে আয়ত্ত করা গিয়েছে গোটা দুনিয়া, সেখানে হিরপুরার মতো ছোট গ্রামকে চিঠি দিয়ে বাকি পৃথিবীর সঙ্গে যুক্ত করার প্রয়াসে তৃপ্তি অনুভব করেন উলফৎ।
…………..
কাশ্মীরের এই গ্রাম পাহাড় পরিবেষ্টিত হলেও তার পাশেই আছে জঙ্গল, যেখান থেকে লিওপার্ড বা অন্য বন্য জীবজন্তু খুব শীতে খাবারের খোঁজে ঢুকে পড়ে গ্রামে। এইসব ঝুঁকির কথা উলফৎ জানেন, তবু তার লিঙ্গপরিচয় তাঁর শ্রম নির্বাচনে কোনও ভেদাভেদ করে না। উলফাতের কথা শুনে মনে পড়ে যায় ভারতের সমস্ত দলিত, নিম্নবিত্ত এবং আদিবাসী মহিলাদের কথা। যারা প্রথাগত ভাবে বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক কাজের জন্য জল, কাঠ, পশুখাদ্য জোগানের হেতু হেঁটে যান মাইলের পর মাইল।
…………..
প্রবল তুষারপাতে যখন হিরপুরা প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় গোটা দেশের থেকে, গাড়ি চলাচল বা রোজকার বাজারহাটও খোলেনা নিয়মমাফিক, উলফতের দায়িত্ব তখনও কিছু কম হয় না। গ্রামের কমবয়সিরা চাকরির খবর বা অ্যাডমিশনের চিঠি পাওয়ার জন্য নির্ভর করে থাকেন পঞ্চাশোর্ধ এই মহিলার ওপর। কাশ্মীরের এই গ্রাম পাহাড় পরিবেষ্টিত হলেও তার পাশেই আছে জঙ্গল, যেখান থেকে লিওপার্ড বা অন্য বন্য জীবজন্তু খুব শীতে খাবারের খোঁজে ঢুকে পড়ে গ্রামে। এইসব ঝুঁকির কথা উলফৎ জানেন, তবু তার লিঙ্গপরিচয় তাঁর শ্রম নির্বাচনে কোনও ভেদাভেদ করে না।
উলফাতের কথা শুনে মনে পড়ে যায় ভারতের সমস্ত দলিত, নিম্নবিত্ত এবং আদিবাসী মহিলাদের কথা। যারা প্রথাগত ভাবে বাড়ির নিত্যনৈমিত্তিক কাজের জন্য জল, কাঠ, পশুখাদ্য জোগানের হেতু হেঁটে যান মাইলের পর মাইল। জঙ্গলে কাঠ বা কয়লা সংগ্রহ করেন রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য, কাঠ আসলেই হাঁড়িতে চড়বে ভাত, নদী থেকে জল টেনে আনতে পারলেই গৃহস্থালির প্রাত্যহিক কাজ সম্পূর্ণ হবে। আবার এরই মধ্যে সদ্য গজিয়ে ওঠা কোনও কারখানার ইন্ডাস্ট্রিয়াল বর্জ্য় যদি ঘরসংলগ্ন নদী দূষিত করে, তাহলে ছ’-সাত কিলোমিটার অতিরিক্ত হাটতে হবে দূরের নদীর খোঁজে। কিংবা কোনও কর্পোরেট কোম্পানি হঠাৎ এসে জঙ্গলের কাঠ কেটে ফেললে, প্রতিবাদ করেন তাঁরা বাঁচার তাগিদে। চিপকো, নর্মদা বাঁচাও বা বিভিন্ন ইকোফেমিনিস্ট মুভমেন্ট-এর কথা পড়লে ভালো লাগে, বুকে সাহস বাড়ে। কিন্তু এটাও মনে হয় যে, উলফতের মতো মানুষদের কথাও যাতে বারে বারে সামনে আসে। যারা নিঃশব্দে নিজের কাজ করে যায় আমাদেরই দেশের কোনও এক প্রত্যন্ত গ্রামে, যেখানে আবহাওয়া কঠিন, দাঁতাল জীবজন্তু বা মাইনাস ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পুরুষ বা মহিলা শ্রমের মধ্যে কোনও ফারাক করে না। শ্রমের কথা যদি বলতেই হয় ( দোরগোড়ায় আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস) তাহলে নারীশ্রম নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হোক, ঘরের চৌহদ্দির ভিতরে কিংবা বাইরে, উলফতের মতো মানুষদের জীবন অবলম্বন করে।
…………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
…………………………………….