Robbar

চুম্বন দৃশ্যের জন্যেই যেন ঘটে যায় হিন্দি সিনেমার প্রথম অনার কিলিং

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 21, 2024 8:50 pm
  • Updated:December 22, 2024 12:09 pm  

চুম্বনকে অশ্লীল ঠেকলেও ভারতীয় মূলধারার সিনেমা বিবিধ অশ্লীলতার বহরে তখন অন্য যে কোনও দেশকে ছাপিয়ে গেছিল। ক্যাবারে-জাতীয় নর্তন-কুর্দন, সিডাকশন ও কু-ইঙ্গিতের বিবিধতা ইত্যাদি তো ছিলই, সেই সময়ের অন্যতম একটি ‘রিচুয়াল’ যে পর্দা থেকে গিয়েছে, তা প্রায় আপদ গিয়েছে টাইপের স্বস্তি আনে। তখন বি-গ্রেড ছবিতে ক্লাইম্যাক্সে রেপ-অ্যাটেম্পট হবেই যতক্ষণ না নায়ক কাচ-ফাচ ভেঙে দুষ্ট-দমনে রত হবে। তো, এইসব ভালগারিটি দিব্যি চলত, তাহলে চুমু নিয়ে অত সমস্যা কীসের ছিল?

অনিন্দ্য সেনগুপ্ত

চুমু একটা অদ্ভুত ব্যাপার। তথাকথিত সেক্সুয়াল অ্যাক্টিভিটির অঙ্গও বটে (হয়তো বেশিরভাগ সম্মত যৌনক্রিয়াই চুমু দিয়ে শুরু হয়), আবার চুমু মানেই যে যৌনতা হতে চলেছে, তেমনও নয়। ঠোঁটকে ঠিক যৌন-অঙ্গও বলা যায় না, আবার যৌনতায় ঠোঁট, মুখ, জিহ্বা এবং কণ্ঠও অতিব্যবহৃত। বাংলা সিনেমার নাম খুব তাড়াতাড়ি চুমু বা চুম্বন হবে না, কিন্তু হামি হতে পারে, হয়েও গেছে। হামি দিয়ে মুশকিল নেই, মুশকিল হল চুম্বন নিয়ে।

১৯৯৭ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালে তাঁর টেস্ট অফ চেরি-র জন্য পুরস্কৃত হন আব্বাস কিয়ারোস্তামি। এবং পুরস্কার নেওয়ার সময়ে স্বনামধন্য অভিনেত্রী ক্যাথেরিন ডেন্যিউভের সঙ্গে যেটা ঘটে, সেটা হল চুমু বা হামি। ইরানের ছবি দেখার অভ্যেস থাকলেই দেখবেন যে ওই দেশে অনেক সময়েই পুরুষমানুষে সৌজন্যমূলক হামি দিয়ে একে অপরকে সম্ভাষণ করে। কিন্তু পাবলিক পরিসরে ভিন্ন লিঙ্গের দু’জন মানুষ, যাদের মধ্যে কোনও স্বীকৃত সম্পর্ক নেই, তাদের পাবলিক ফিজিকাল কন্ট্যাক্ট-এ বিধিনিষেধ আছে ইরানীয় সরকারের। যথারীতি হইচই, গেল গেল ভাব! ওই মুহূর্তটি ইরানের ছবির বিশ্বজোড়া উৎকর্ষের স্বীকৃতির অন্যতম মুহূর্ত হওয়া সত্ত্বেও আব্বাস কিয়ারোস্তামি বেশ কিছু দিন তেহেরানে ফিরতে পারেননি।

Abbas Kiarostami
ক্যাথেরিন ডেন্যিউভ ও আব্বাস কিয়ারোস্তামি

তাই, এই লেখার শুরুর লাইনটার পুনর্লিখন করা যাক। চুমু অতি স্বাভাবিক ব্যাপার, কিন্তু চুমু নিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষদের সংস্কৃতির ব্যাপার-স্যাপার বড় অদ্ভুত! আমি যেহেতু সিনেমা নিয়ে পড়াশোনার লোক, এই লেখায় সিনেমাই থাকবে বেশি। আটের দশকের ছোটবেলায় জানতাম যে, বিলিতি ছবির নায়ক-নায়িকা চুমু খায়, দেশি ছবির নায়ক-নায়িকা চুমু খান না। তারপরে বুঝলাম, দেশি ছবির নায়ক-নায়িকা চুমু খেলেও আসলে তখন ফুলে ফুলে স্পর্শ হয়, পাখিরা উড়ে যায়, এককথায় প্রকৃতি চুমু উদযাপন করে। এই ব্যাপারটা বেশ লাগত। এর মধ্যে দেখলাম সত্যজিৎ রায়ের ঘরে বাইরে-তে সন্দীপ আর বিমলা চুমু খেয়েছে বলে আবার আমাদের লোকাল হুলুস্থুল! ততদিনে আমি নার্সারি লেভেলের সিনেফিল হয়ে উঠছি, দেখে ফেলেছি যে সত্যজিতের দেবী-তে উনি একখানা অদ্ভুত কাজ করে ফেলেছেন। বৈধ স্বামী আর স্ত্রীর চুম্বনকে কেমন যেন নিষিদ্ধ-নিষিদ্ধ গন্ধ দিয়ে দিলেন আলো-আঁধারি আর মশারির বিন্যাসে।

সত্যজিৎ রায়ের ‘ঘরে-বাইরে’ ছবিতে সন্দীপ ও বিমলার চুম্বনদৃশ্য

নয়ের দশকে ভারতীয় মূলধারার ছবির পর্দায় চুম্বন দেখা যেতে আরম্ভ করল। ‘সিরিয়াল কিসার’ হিসেবে ইমরান হাসমির উদয় হওয়ার আগেও মনে করুন আমির খান ছিলেন অরিজিনাল হাসমি, সেই কয়ামত সে কয়ামত তক থেকে রাজা হিন্দুস্থানী অবধি, এবং তারপরও। তারপর থেকে ভারতীয় সিনেমা উত্তরোত্তর বোল্ড হতে আরম্ভ করল এমনই যে, এখন কিঞ্চিত বোরিং হয়ে গেছে। এখন পর্দায় বাঙালিরাও চুমু খায়। অর্থাৎ, ফিকশনাল চুমু নিয়ে কারও খুব একটা অসুবিধে নেই, অসুবিধে হল নন-ফিকশনাল চুমু নিয়ে, কিন্তু এই লেখা তা নিয়ে নয়।

‘রাজা হিন্দুস্তানি’ ছবিতে করিশ্মা কাপুর ও আমির খানের চুম্বনদৃশ্য

আমি যে ডিসিপ্লিনের লোক, ফিল্ম স্টাডিজ, সেখানে ভারতীয় ছবির এই এক সময়ের চুম্বনের অনুপস্থিতি নিয়ে রীতিমতো আলোচনা করা আছে। ভারতীয় ফিল্ম স্টাডিজের অন্যতম অগ্রগণ্য তাত্ত্বিক মাধব প্রসাদের ইডিওলজি অফ হিন্দি ফিল্ম-এর একটা গোটা অধ্যায়ই এই বিষয়টা নিয়ে। প্রথমত, তিনি জানান যে ১৯৬৯-এর জি. ডি. খোসলা রিপোর্ট বলছে যে, চুম্বনের এই নিষিদ্ধকরণ হল এক ধরনের অলিখিত বিধান, অর্থাৎ চলচ্চিত্র নির্মাতার গোষ্ঠীরাই যেন সর্বসম্মত হয়ে ঠিক করেছে যে, ভারতীয় পর্দায় চুমু দেখানো যাবে না। যেহেতু সেন্সরশিপের মতোই এইসব নিয়মনিদান হল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক রেগুলেশনের ধারাবাহিকতা, মনে হতে পারে যে, সেকেলে ভিক্টোরিয়ান নৈতিকতার ফলেই হল এইসব নিয়ম। কিন্তু ব্যাপারটা অতটা সহজ নয়। কারণ, চুম্বনকে অশ্লীল ঠেকলেও ভারতীয় মূলধারার সিনেমা বিবিধ অশ্লীলতার বহরে তখন অন্য যে কোনও দেশকে ছাপিয়ে গেছিল। ক্যাবারে-জাতীয় নর্তন-কুর্দন, সিডাকশন ও কু-ইঙ্গিতের বিবিধতা ইত্যাদি তো ছিলই, সেই সময়ের অন্যতম একটি রিচুয়াল যে পর্দা থেকে গিয়েছে, তা প্রায় আপদ গিয়েছে টাইপের স্বস্তি আনে। তখন বি-গ্রেড ছবিতে ক্লাইম্যাক্সে রেপ-অ্যাটেম্পট হবেই যতক্ষণ না নায়ক কাচ-ফাচ ভেঙে দুষ্ট-দমনে রত হবে। তো, এইসব ভালগারিটি দিব্যি চলত, তাহলে চুমু নিয়ে অত সমস্যা কীসের ছিল?

IDEOLOGY OF HINDI FILM (OIP) by PRASAD MADHAVA M. - 9780195652956

বলা হত, এসব চুমু-টুমু পাশ্চাত্য সংস্কৃতি। এই ব্যাপারে কিন্তু রক্ষণশীল ধার্মিক মানুষ আর বামপন্থীদের মধ্যেও বিশেষ তফাত ছিল না। আমাদের ছেলেবেলায় বামপন্থী ছাত্রনেতারা (এবং তাঁদের পিতৃসুলভ দাদারা) প্রেম বলতেন না, বলতেন ব্যক্তিগত সম্পর্ক। সেভাবেই চুমু বলতেন না, বলতেন ঝোপেঝাড়ে ছেলেমেয়েরা আপত্তিজনক ক্রিয়াকলাপ করছে। আপনারা হিন্দুত্ববাদীদের ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে প্রেমে বাধা দিতে দেখেছেন। কিন্তু সত্যি বলতে কী, নব্বইয়ের শুরুর দিকে আমি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে পড়তাম আর হোস্টেলে থাকতাম। তখন সপ্তাহে কয়েকবার সন্ধ্যাবেলায় ঝোপঝাড়ে সার্ভেলেন্স চালাতাম আমরাই, দেশের সর্ববৃহৎ ছাত্রসংগঠনের কর্মীরা। তাই ব্যাপারটা জটিল, এখনকার মতো অতটা সোজা নয়।

কিন্তু সিনেমায় ফেরা যাক। শুধুমাত্র পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কুপ্রভাব নয় ব্যাপারটা। বালাই ষাট! বিলিতিরা আমাদের চুমু খেতে শেখায়নি! আমরাও চুমু জানতাম। কিন্তু মুশকিল হল, চুম্বন ওদের পাবলিক ডিসপ্লে অফ অ্যাফেকশন, আর আমাদের ক্ষেত্রে প্রাইভেসির ব্যাপার। যেহেতু চুমু খাওয়া হয় একান্তে, এবং সিনেমার হল অন্যতম পাবলিক স্পেস, তাই সেখানে চুমু দেখানো যাবে না। আমরা পাবলিকে মহিলাদের ডাইনি সন্দেহে বস্ত্রহীন করে হাঁটাতে পারি, কিন্তু চুমু খাই দেওয়াল এবং ছাদের মধ্যে একান্তে। ব্যাপারটা হল পাবলিক আর প্রাইভেট-এর তারতম্যের। আরেকটু ঘেঁটে দেওয়া যাক। অতএব সমস্যা নতুনতর, প্রাইভেট-এর কি ইমেজ হয়? ইরানীয় স্বৈরতান্ত্রিকরা এই ব্যাপারে সোজাসাপ্টা– না। কিন্তু ভারতীয়রা তো সোজাসাপ্টা নয়। একদা সমস্যাটা ছিল আধুনিকতা নিয়ে।

An impressive group of 61 Kalighat paintings, depicting Hindu deities, various figures from Hindu mythology and domestic scenes Kalighat, Bengal, ...
কালীঘাট পট। উনিশ শতক। ঋণ: ইন্টারনেট

সেই উনিশ শতক থেকেই, আধুনিকতা আমাদের বড় গলার কাঁটা। ওল-ও খেতে হবে, ইলিশ মাছও, কিন্তু গলা হয় ধরবে না হয় কাঁটা ফুটবে। আমরা তো আধুনিকতা নিজেদের মতো তৈরি করিনি, আধুনিকতা একদম ফুল প্যাকেজে আমাদের কাছে পৌঁছে গিয়েছে। এইবার কীভাবে যে আমরা সেই আধুনিকতাও বরণ করব আবার নিজস্বতাও রাখব– সেই নিয়েই সেই কবে থেকে সমস্যা! আধুনিক আমরা হতে চাই, কিন্তু আধুনিকতা নিয়ে আমাদের সংশয়েরও অন্ত নেই। সাধ আর আশঙ্কার এই দোলায়মানতায় আমরা তো সেই কবে থেকে জেরবার। তো আধুনিকতার অন্যতম কাঠামো যদি হয় ডেমোক্রেসি; আর ডেমোক্রেসির ন্যূনতম একক যদি হয় আধুনিক ব্যক্তিমানুষ বা ইন্ডিভিজুয়াল; তাহলে ন্যূনতম আধুনিক সামাজিক ইউনিট হল আধুনিক দুই প্রাপ্তবয়স্কর যুগল, ইংরেজিতে ‘couple’, সেই ইউনিটের ন্যূনতম আধুনিক চুক্তি হল যে, তারা স্বেচ্ছায় নিজেদের প্রেমের পরিসর নির্মাণ করবে।

সেই একদার ভারতীয় মূলধারার চুম্বন নিয়ে অস্বস্তির প্রধান কারণ ছিল এটাই, চুম্বনের ইমেজ হল পর্দায় আধুনিক প্রাইভেট-এর উদযাপন। এই ইমেজ তখনকার সমাজের যে তখনও বহাল থাকা সামন্ততান্ত্রিক পরিবার-কাঠামো, তার মূলে আঘাত করে। সামন্ততান্ত্রিক জয়েন্ট ফ্যামিলির কাঠামোয় যুগলকে বৃহত্তর পরিবার স্বীকৃতি দেয়, যুগলের কোনও এক্তিয়ার নেই যে তারা নিজেরাই নিজেদের প্রাইভেসির পরিসর বানিয়ে নেবে। অতএব যুগল যদি সায়ত্ত্ব হয়ে ওঠে, সেটা ফিউডাল নৈতিকতার কাছে থ্রেটের মতোই।

………………………………..

পড়ুন স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখা: ওই ছেলেমেয়ে দু’টির উচিত পরদিন ওই মেট্রো স্টেশনে গিয়ে আবার চুমু খাওয়া

…………………………………

এইজন্যেই আমাদের সংস্কৃতিতে প্রেমের গল্পের এত গুরুত্ব ছিল (‘ছিল’ বলছি কারণ বাংলা সিনেমা অন্তত এফেক্টিভ প্রেমের গল্প বলতে জাস্ট ভুলে গিয়েছে, এখানে এফেক্টিভ শব্দটা জরুরি)। কারণ দু’জন মানুষ যুগলের পরিসর নির্মাণ করতে পারছেন কি না, সেটা ছিল আমাদের আধুনিকতা কোন পর্যায়ে আছে তার ঠিকঠাক মাপকাঠি। ভিন্ন জাতের দু’জন কি এই পরিসর নির্মাণ করতে পারে? দু’জন ভিন্ন ধর্মালম্বী মানুষ? দু’জন সমলিঙ্গের মানুষ? একজন নারী আর তার চেয়ে কমবয়সি পুরুষ? বিদ্যাসাগরের এক শতাব্দী পরেও শোলে-র চরিত্রগুলি যখন ভাবছে জয়া ভাদুড়ি অভিনীত বিধবাটির অমিতাভ বচ্চন অভিনীত জয়ের সঙ্গে বিবাহ হতে পারে, তার কিছুক্ষণ বাদেই জয়কে মরতে হয়। জয় মারা যাওয়ার যে হৃদয়বিদারক শোক, তার মধ্যে মিশে আছে আধুনিক হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা, তা পূর্ণতা না পাওয়ার শোক। 

Sholay (1975)
‘শোলে’ ছবিতে জয়া ভাদুড়ি ও অমিতাভ বচ্চন

অর্থাৎ আমাদের আধুনিকতার প্রতি আকাঙ্ক্ষাও আছে, কিন্তু মাধব প্রসাদ যাকে বলছেন ফিউডাল নৈতিক দৃষ্টি, তা সেই আকাঙ্ক্ষার ওপর আশঙ্কার কালো পর্দা চাপিয়ে দেয়। কয়ামত সে কয়ামত তক আমাদের অন্যতম প্রথম অনার কিলিং-এর ছবি, সেই গল্প আবার কাস্টের প্রেক্ষিতে ফিরে আসে সইরাট-এ। আমরা এক সময়ে প্রতিটি ছবিতেই প্রেম দেখতে চাইতাম, প্রায় অবসেসিভলি, কিন্তু যে দু’টি ছবির কথা বললাম, সেরকম পরিবার-কাঠামোর বাইরে যদি সেই যুগল-পরিসর রচিত হয়, তার অন্ত হত ট্র্যাজিক। তাই বেশিরভাগ গল্পই ম্যায়নে পেয়ার কিয়া-র মতো পিতৃতন্ত্রের সম্মতি আর স্বীকৃতিতে শেষ হত; হ্যাঁ, তারা যুগলকে সার্টিফাই করছে। এইবার সেই যুগলের যে মুক্ত পরিসর, তা পরিবারতন্ত্রের এবং পিতৃতন্ত্রের অন্তর্গত হবে। আর ডিডিএলজে-র রাহুল তো বলেই দিয়েছিল, কন্যার পিতা হাতে তুলে না দিলে সে পানিগ্রহণ করবে না– এত ভালো ছেলে! এই যে যুগলের পরিসর নিয়ে গন্ধমাদনসম চাপ, পর্দায় চুম্বন না দেখা ছিল তারই প্রতীকী জেশ্চার। আমাদের আধুনিকতা নিয়ে সংশয় আছে, সংশয় আছে যুগলের স্বকীয় পরিসর নিয়ে, চুম্বন সেই পরিসরেরই প্রতীক ছিল বলে ব্রাত্য ছিল।

…………………………………

এখনকার আপত্তিটা চুমু নিয়ে নয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা চুমু খায়, এটা সবাই জানে, এতে কোনও আপত্তি নেই কারওর। আপত্তি দুটো ব্যাপারে, এবং দুটোই বিচিত্রভাবে সম্পৃক্ত। সেটা অন্য কেউ দেখে ফেলবে কেন? এবং সেটার ছবি উঠবে কেন? অর্থাৎ পরদৃষ্টি এবং ক্যামেরা, সমস্যা এদের নিয়ে। পরদৃষ্টি সর্বত্র থাকবে; আর অধুনা ক্যামেরাও তো সর্বত্রই আছে, হয় সিসিটিভি হয়ে, নয় লোকেদের হাতে ও পকেটে। সেই দৃষ্টির না পড়ে পলক, না পারে সেই মানুষী বা যান্ত্রিক দৃষ্টিধারীরা নিজেদেরকে অন্যদিকে ঘোরাতে। সমস্যাটা ইমেজ নিয়ে, চিত্র নিয়ে, অন্য একজনের দৃষ্টি নিয়ে। অন্য কোনও দৃষ্টি থাকলেই যে পরিসর আর ‘প্রাইভেট’ থাকে না, সেখানে কেন তবে চুমু খাবে বাঙালিরা?

…………………………………

কিন্তু সে তো বহু আগের কথা, আগের শতকের কথা। এখন আর চুমু নিয়ে আমাদের সমস্যা নেই। দেখলেন না, তালমার রোমিও জুলিয়েট-এ এমনই চুমুর বহর যে চিরন্তন প্রেমের মহিমাটা কেমন যেন ঝাড় খেয়ে গেল, মনে হল খালি শরীর-শরীর, বাচ্চা দুটোর মন কি কম পড়িয়াছে? তাহলে মেট্রো স্টেশনে কেউ চুমু খেলে এত সমস্যা কীসের? আমাদের ইমেজ, আমাদের পর্দা কি আমাদের সমাজের চেয়ে এগিয়ে গেল?

…………………………………….

পড়ুন হিয়া মুখোপাধ্যায়ের লেখা: ইমরান হাশমিই শিখিয়েছেন সক্কলের এক-একটা নিখাদ চুমুতে হক আছে

……………………………………..

এক কথায়, এর উত্তর খোঁজার প্রয়োজন নেই। একটা জাতি বাতিল আর উন্মাদ হয়ে গেলে কত রকমেরই তো ভীমরতি হয়। কিন্তু আমি বাচাল মানুষ, কথা বলার সুযোগ ছাড়ি কী করে? তাই, উত্তর বানাই, বা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করি। সভ্যতায় বড়ই অন্ধকার; কমজোরি হলেও টর্চটা জ্বালাই।

এখনকার আপত্তিটা চুমু নিয়ে নয়। প্রেমিক-প্রেমিকারা চুমু খায়, এটা সবাই জানে, এতে কোনও আপত্তি নেই কারওর। আপত্তি দুটো ব্যাপারে, এবং দুটোই বিচিত্রভাবে সম্পৃক্ত। সেটা অন্য কেউ দেখে ফেলবে কেন? এবং সেটার ছবি উঠবে কেন? অর্থাৎ পরদৃষ্টি এবং ক্যামেরা, সমস্যা এদের নিয়ে। পরদৃষ্টি সর্বত্র থাকবে; আর অধুনা ক্যামেরাও তো সর্বত্রই আছে, হয় সিসিটিভি হয়ে, নয় লোকেদের হাতে ও পকেটে। সেই দৃষ্টির না পড়ে পলক, না পারে সেই মানুষী বা যান্ত্রিক দৃষ্টিধারীরা নিজেদেরকে অন্যদিকে ঘোরাতে। সমস্যাটা ইমেজ নিয়ে, চিত্র নিয়ে, অন্য একজনের দৃষ্টি নিয়ে। অন্য কোনও দৃষ্টি থাকলেই যে পরিসর আর প্রাইভেট থাকে না, সেখানে কেন তবে চুমু খাবে বাঙালিরা?

…………………………………

পড়ুন কবীর সুমনের লেখা: প্রথমবার চুমু খেয়ে মনে হয়েছিল গোটা সিস্টেমটাকেই গুঁড়িয়ে দেব শালা

…………………………………..

হ্যাঁ, আমাদের স্ক্রিনগুলি টোকেন প্রগতিশীলতার কৌটো হয়ে গিয়েছে; আর আমাদের সমাজ হয়ে গিয়েছে একটা আদ্যন্ত সেকেলে সিনেমার মতো। তালমার রোমিও জুলিয়েট-এর চুম্বনে আমাদের অসুবিধে নেই, কারণ সেই ইমেজ আমরা কনজিউম করি। সেকালে প্রেম ছিল আধুনিকতার ইনডেক্স। কীরকম আধুনিকতা? মননের, চেতনার আধুনিকতা। বিশ্বায়ন ঘটেছে, মন, চেতনা ও মননের উন্নত হওয়ার আধুনিকতা বাতিল হয়েছে, এসেছে কনজিউমারিজম দ্বারা সংজ্ঞায়িত নিও-আধুনিকতার যুগ। ক্রেডিট কার্ডের আর ই.এম.আই-এর আধুনিকতা নয়, অ্যালগোরিদমের আধুনিকতা নয়, সেই বিশ শতকের আধুনিকতা ভার্জিনিয়া উলফের ‘‘রুম অফ ওয়ান’স ওন’’-এর আধুনিকতা ছিল। আর এখন যুবক-যুবতীরা সমস্ত ব্যক্তিগত নিয়ে স্টেটাস আপডেট দেয়, মার্ক জুকারবার্গ তো বলেই দিয়েছেন যে, গত শতকের সঙ্গে প্রাইভেসি-র অবসান ঘটেছে। তাই সেই সময়ে প্রেমের ইমেজে যে আগামীর কাব্য ছিল, তা আর নেই, তার আর প্রয়োজন নেই, আমাদের আর কোনও অভীষ্ট আগামী নেই। তাই প্রেমও আমাদের কাছে তেমন অর্থময় নয় আর, তা আর যদি পৃথিবীটা স্বপ্নের দেশ হয়, এমন ইউটোপিয়ার হাতছানি দেয় না।

…………………………………

পড়ুন প্রিয়দর্শিনী চিত্রাঙ্গদার লেখা: পুরুষ-নারীর চুম্বন ‘রোমান্স’ আর দুই নারীর চুম্বন ‘প্রচণ্ড সাহসী কাজ’?

…………………………………

আমাদের আর প্রেমের ইমেজের আকাঙ্ক্ষা নেই, প্রেমের ইমেজে অধরা মাধুরীও আর নেই। আমাদের কাছে যেমন পর্দার নায়ক-নায়িকারা আর ভালোবাসার মানুষ নন, উপভোগের বস্তু, তেমনই চুম্বনরত যুগলরাও তেমন সুন্দর নন। ঠিক যেমন অধুনার উপভোগের অন্যতম পদ্ধতি হল ট্রোলিং, একইরকম ট্রোলিং চুম্বনরত যুগলদের নিয়েও হবে, তাই হচ্ছে। এই ট্রোলিং মানে কিন্তু এই নয় যে, মানুষজন প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়ে নীতিবাগীশ হচ্ছে; এই ট্রোলিং মানে মানুষজনের কাছে এই প্রেমিক-প্রেমিকারা উপভোগ-এর বস্তু, রগড়ের বস্তু; পর্দার অভিনেতাদের মতোই, এদের নিয়েও মানুষের আর মায়া নেই, মমতাও নেই। যে আধুনিকতা বিদ্রোহ আর চুমু নিয়ে দিব্যি দিত, সেই আধুনিকতার অবসান ঘটেছে। উপভোক্তার আধুনিকতা হল প্রতিযোগিতার আধুনিকতা। ঠিক যেমন পাশের বাড়ি নতুন গাড়ি কিনলে চোখ টাটায়, সেরকমই হয় অন্যের চুম্বন দেখলে। আমাদের ভোগ করার জন্য প্রিয় অভিনেতা দরকার, তাকে নিয়ে খিল্লিটাও যে করতে হবে তেমন পান থেকে চুন খসলে। এইখানে প্রিয় হওয়ার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক নেই। সেই বাল্যকালে যেদিন উত্তমকুমারকে চিনেছিলাম, নিশ্চিত ছিলাম যে ইনি পর্দায় এলেই আমার ভালো লাগবে, আশ্বস্ত লাগবে আজীবন, কারণ আমি এঁকে ভালবাসি। এখন আমরা সকালে পটি করতে করতে স্ক্রোল করি কোন সেলিব্রিটিকে আজকে ট্রোল করব আলিয়া উই লাভ ইউ বিকজ ইউ আর সো ট্রোলেবল!

Cinema Paradiso (1988) - IMDb
সিনেমা প্যারাডিসো-র একটি দৃশ্য

তাই মনে হয়, সেই সিনেমা প্যারাডিসো-র শেষ দৃশ্যের মতো, সেইসব চুম্বনের দৃশ্যর চোরা কম্পাইলেশন দেখি যেগুলো আমাদের দেখানো হত না, যখন প্রেমের ইমেজ আমাদের জীবনে বড় আদরের ছিল, বড় সাধের ছিল। আমাদের কত গোপন অর্থ তাতে নিহিত থাকত, সেই যে চুম্বনগুলি আমরা দেখতে পেতাম না তাতে। এখন ওটিটি-তে যতই চুমাচাটি দেখানো হোক না কেন, তা সেই সাধের ইমেজকে ধরতে পারবে না, কারণ এখন ইমেজগুলো বড় ফাঁকা। হয়তো আমি বাতিল মানুষ বলেই যখন সন্ধে আসছে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরই, আশ্বস্ত হই যে, ক্যাম্পাসে কোথাও না কোথাও চুমুর ফুল ফুটছে। আর এই না-দেখা দৃশ্যগুলোই তো কত মানুষের চক্ষুশূল, ঠিক যেমন বিদ্রোহও।

কেন চুমুর ইমেজ এখন ফাঁকা? আমাদের দৃষ্টি আর মনটাই তো ফাঁপা হয়ে গিয়েছে সেই কবে থেকে যেন, আমাদের ভবিষ্যতের অ্যালবামের মতো…