খেলাধুলো, সংগ্রাম, ইতিহাস– তাঁর রঙতুলির স্পর্শে জ্বলজ্বল করে ক্যানভাসে। তাঁর ছবিতে ধরা দেয় স্মৃতি, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে। তিনি, অ্যান্ডি ব্রাউন– একজন স্পোর্টস আর্টিস্ট। সেই অ্যান্ডি, ভারত-ইংল্যান্ডের পাঁচ টেস্টের সিরিজ দেখতে হাজির এ-দেশে। খেলা দেখবেন, ছবিও আঁকবেন। ক্যানভাসে বন্দি করবেন টেস্ট ক্রিকেটের আদিম লাবণ্যকে।
শীতফুরোনো রোদ গায়ে মেখে, তখনও ক্রিজে দাঁড়িয়ে আছেন অলি পোপ। একা। স্থিতধী। জো রুট, বেন স্টোকস– একে একে যখন প্যাভিলিয়নমুখী, নন-স্ট্রাইকিং এন্ডে তিনি আরও স্থিতধী। ধৈর্যশীল। যেন নির্জন কোনও ক্যানভাসে অল্প অল্প করে রং দিচ্ছেন। আর গড়ে তুলছেন ১৯৬ রানের নিখুঁত শৈল্পিক ইনিংস! হায়দরাবাদের রাজীব গান্ধী স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে বসে, টেস্ট-ক্রিকেটের এই আদিম লাবণ্যকে, এই ইন্সটাগ্রাম রিল-সর্বস্ব দুনিয়াতেও কেউ, কোনও সুন্দর, ক্যানভাসবন্দি করতে উন্মুখ। তিনি অ্যান্ডি ব্রাউন। দক্ষিণ ইংল্যান্ডের মানুষ। নেশায় একজন স্পোর্টস আর্টিস্ট।
অ্যান্ডি ছবি আঁকেন। খেলাধুলো, সংগ্রাম, ইতিহাস– জ্বলজ্বল করে ক্যানভাসে। ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের প্রথম টেস্টের পরে সটান পৌঁছে গিয়েছেন বিশাখাপত্তনম। টিম ইন্ডিয়ার অনুশীলনে। আঁকছিলেন অনুশীলনের ছবি।
হঠাৎ অনুশীলনের ছবি কেন? হঠাৎ টেস্ট ক্রিকেটের ছবি আঁকা কেন? যখন পৃথিবী স্বয়ং দারুণ গতিশীল! যখন দীর্ঘ উপন্যাস, দীর্ঘ কবিতা অথবা মৃদু-লয়ের সিনেমা ভীষণ ‘আনকুল’! এহেন প্রশ্নের উত্তর খুব সহজ। এবং গভীর।
ক্রিকেট আসলে কী? কেবলমাত্র দুটো দল, একটা ২২ গজের পিচ, একজন আম্পায়ার, অগণিত সমর্থক? অ্যান্ডি তা মনে করেন না। একজন শিল্পী বলেই হয়তো তাঁর দৃষ্টি জীবন লক্ষ করে, অনিবার্যভাবেই। তাই সে ঢুকে পড়তে চায় ভারতীয় দলের অন্দরে। সে দেখতে চায়, কতখানি শ্রমের ফসল যশস্বী জয়সওয়াল! কোন ব্যাটসম্যানের ব্যাকরণ শুধরে দিচ্ছেন রাহুল দ্রাবিড়! কীভাবে ঘরের মাঠে প্রথম ম্যাচ হেরেও ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে একটা টিম! একগাদা তরুণ! তবেই তো ছুঁয়ে দেখা যাবে ভারতীয় মন। মানুষ। সংস্কৃতি। তারপর একটা ছবি, ছবি হয়ে ওঠার যাবতীয় উপাদান খুঁজে পাবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অ্যান্ডি এঁকে রেখেছেন ঐতিহাসিক হ্যামট্র্যামক স্টেডিয়াম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে তৈরি যে বেসবল স্টেডিয়াম সাক্ষী নিগ্রো লিগের। আপনারা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছেন ‘নিগ্রো লিগ বেসবল’-এর ধারণাটি! যা আসলে, অ্যাফ্রো-আমেরিকান খেলোয়াড়দের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক বেসবল লিগ। যা আসলে, ইনহিউম্যান ‘জিম ক্রো সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে, আমেরিকার সাদা-চামড়া সমৃদ্ধ সমস্ত মেজর লিগের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধচিহ্ন।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
১০ বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় থেকেছেন অ্যান্ডি। এঁকেছেন সে-দেশের বহু বেসবল ম্যাচ ও বেসবল পার্কের ছবি। সেই শুরুয়াত। বেসবলই যেন অ্যান্ডির প্রাণশক্তি জুগিয়ে চলল তারপর। কী আশ্চর্য! অ্যান্ডি বলছেন, ‘আমেরিকা ছিল আমার কাছে অজানা দেশ। কিন্তু বেসবলই সেই প্রবেশপথ, যে পথে হাঁটতে হাঁটতে আমি চিনেছি আমেরিকার ভাষা, খাদ্য, ধর্ম, ইতিহাস।’ প্রতিটি দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সে-দেশের ক্রীড়ার যে একটি অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, অমোঘ প্রতিফলন– এ কথা আমরা ভুলেছি অনেক বছর হল।
অ্যান্ডির ক্যানভাসে ভেসে ওঠে আমেরিকার এবিটস ফিল্ড। যে বেসবল স্টেডিয়াম বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত। পুঁজির কাছে পরাজিত। অ্যান্ডি এঁকে রেখেছেন ঐতিহাসিক হ্যামট্র্যামক স্টেডিয়াম। উনিশ শতকের শেষভাগে তৈরি যে বেসবল স্টেডিয়াম সাক্ষী নিগ্রো লিগের। আপনারা নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পেরেছেন ‘নিগ্রো লিগ বেসবল’-এর ধারণাটি! যা আসলে, অ্যাফ্রো-আমেরিকান খেলোয়াড়দের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক বেসবল লিগ। যা আসলে, ইনহিউম্যান ‘জিম ক্রো সিস্টেম’-এর বিরুদ্ধে, আমেরিকার সাদা-চামড়া সমৃদ্ধ সমস্ত মেজর লিগের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধচিহ্ন। অ্যান্ডি ব্রাউন এই ইতিহাস ভুলে যেতে চান না। ২০২০ সালে, যখন জর্জ ফ্লয়েডকে খুন করেছিল আমেরিকার পুলিশ! ঠিক সে-মুহূর্তেই, তিনি এঁকেছিলেন নিগ্রো লিগের একটি স্বপ্নের দল। তিনি চেয়েছিলেন, উত্তর-প্রজন্ম যেন বেসবলের পরিসংখ্যানের পাশাপাশি মনে রাখে ইতিহাস। যেন মনে রাখে অ্যাফ্রো-আমেরিকান বেসবল তারকা জোশ গিবসনের কথা। অ্যান্ডির এ-ছবিতে জোশ গিবসন যেন হাজার হাজার কালো বর্ণের নির্যাতিত মানুষের প্রতিনিধি! জর্জ ফ্লয়েডের মরা মুখের দিকে তাকিয়ে, অ্যান্ডি বলেন, ‘দ্যাট শুড নট স্টিল বি হ্যাপেনিং টুডে!’ কী ভয়ংকর শৈল্পিক উচ্চারণ!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: তৃতীয় বিশ্ব থেকে উঠে আসছেন এক দাবাড়ু, যিনি আক্রমণাত্মক নীতির ধ্যানধারণা পাল্টে ফেলবেন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মনে রেখে দেওয়া। ওটুকুই তো সম্বল। অ্যান্ডির প্রতিটি ছবিই ঘুরে-ফিরে স্মৃতির কাছে আসে। একদেশ থেকে অন্যদেশ। কখনও স্টেডিয়াম ভাঙা হয়। কখনও একটি আস্ত ক্লাব অস্তিত্বহীন! অ্যান্ডির ক্যানভাসে স্মৃতি, ইতিহাস– বর্তমানের উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া আশ্চর্য চ্যালেঞ্জ। কখনও কোরিয়ায় বেসবল পার্কের পিছনে বৌদ্ধমন্দির। আমেরিকায় তবে গির্জা। সংস্কৃতির সৌধ ভিন্ন। মানুষের সংগ্রাম তবু, এক! একুশ শতকেও। মনে হয়, যেন একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটের শরীর থেকে সেই সংগ্রাম মুছে যায়নি। এখনও না। এখনও সে যান্ত্রিক হয়নি। শিল্প বেঁচে আছে।
ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজের পাঁচটি টেস্ট ম্যাচেই অ্যান্ডি থাকবেন গ্যালারিতে। খেলা দেখবেন, ছবিও আঁকবেন। ভারতে যখন ইতিহাস-বিকৃতির খোল-করতাল বাজতে শুরু করেছে তারস্বরে! উত্তর-প্রজন্মের পাঠ্যপুস্তকে অবাধে রামনাম! হয়তো নব্য ‘জিম ক্রো সিস্টেম’-এর পথে ভারত। আমেরিকায় বর্ণবিদ্বেষ। এই দেশে ধর্ম! সে-মুহূর্তে, অ্যান্ডি ব্রাউন আপনি এলেন আমার দেশে। ভারতে। আমি আপনার ক্যানভাসের দিকে তাকিয়ে আছি অধীর আগ্রহে। আপনি ছবি আঁকেন। আর ফিলিস্তিনের জন্য কবিতা লেখে কেউ। আর মিছিলে স্লোগান ওঠে। আর কেউ কেউ গভীর প্রত্যয়ে বলে উঠতে পারেন, ‘দ্যাট শুড নট স্টিল বি হ্যাপেনিং টুডে!’