Robbar

যাঁদের রক্ত-ঘামের ফসল নিউ ইয়র্ক, তাঁরাই জিতিয়েছে জোহরান মামদানিকে

Published by: Robbar Digital
  • Posted:November 6, 2025 5:16 pm
  • Updated:November 6, 2025 5:16 pm  

৩৩ বছরের জোহরান মামদানি অ্যান্ড্রু কুওমো-কে হারিয়ে দেন জুন মাসের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চিরাচরিত ঘাঁটি নিউ ইয়র্কে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মূল ক্যান্ডিডেট হয়ে যান, ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট ফ্র্যাকশনের জোহরান মামদানি, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা বুঝে যান আমেরিকার রাজনীতিতে, এটি একটি বড় টেকটনিক শিফট। ৫ নভেম্বর বিশাল ভোটে জিতে ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি। সব অপপ্রচার, সব ব্যক্তি আক্রমণ, মুখ থুবড়ে পড়ল এক নব্য যুবকের স্বপ্ন পূরণের সামনে।

বনজ্যোৎস্না লাহিড়ী

‘নিউ ইয়র্ক পোস্ট’– চূড়ান্ত একটি দক্ষিণপন্থী খবরের কাগজের নভেম্বরের হেডলাইন হল– ‘On your Marx, get set Zo!’ ব্যঙ্গাত্মক এই হেডলাইনটির একপাশে একটি ক্যারিকেচার– একজন সুদর্শন যুবক মাথার ওপর কাস্তে-হাতুড়ি তুলে ধরেছেন। এখন কথা হল যাঁর ছবি, অর্থাৎ জোহরান কয়ামে মামদানি, নিউ ইয়র্ক শহরের, বিপুল ভোটে জয়ী হওয়া, নব নির্বাচিত মেয়র, কিন্তু কখনওই দাবি করেননি তিনিকমিউনিস্ট’। তিনি একজন স্বঘোষিত ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট। আমেরিকার ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাইমারে (পার্টির প্রার্থী ঠিক করার অভ্যন্তরীণ নির্বাচনে) তিনি গত জুন মাসে হারান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রবীণ সদস্য, ধনকুবের এবং নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন গভর্নর অ্যান্ড্রু কুওমো-কে। 

নিউ ইয়র্ক পোস্ট। প্রথম পাতা। ৪ নভেম্বর

সবাই তখনই হতচকিত হয়েছিল। যদিও ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অভ্যন্তরে একাংশের বেড়ে চলা ক্ষোভ এখন সর্বজনবিদিত। বিদেশ নীতি হোক বা অর্থনৈতিক পলিসি, ডেমোক্র্যাটিক পার্টির যে অংশটা ক্ষমতার গদিতে গিয়ে বসে, তা সে বিল ক্লিনটন হোক, বা ব্যারাক ওবামা, জো বিডেন হোক বা কমলা হ্যারিস, তাদের যুদ্ধক্ষয়ী এবং পুঁজিবাদী নীতিতে কোনও ফারাক দেখা যায় না, শুধু ভোটের আগে নানারকম বাগাড়ম্বরের ঢক্কানিনাদ চলে। এই ক্ষোভ থেকেই এর আগেও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মধ্যেই বিদ্রোহ হয়েছিল ব্যাপক রূপে। 

বিগত কয়েক বছর ধরে বার্নি স্যান্ডার্স-এর নেতৃত্বে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের আওয়াজ ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। যাদের দাবি সরকারের তরফ থেকে সুনিশ্চিত করতে হবে: বিনামূল্যে চিকিৎসা, সকল নাগরিকের জন্য ঘরের বন্দোবস্ত বা থাকার ব্যবস্থা, শিশু সুরক্ষা, উচ্চশিক্ষার ঋণ মকুব, শিক্ষাখাতে ভরতুকি বাড়ানো, ওষুধের দাম সাধারণ মানুষের আয়ত্তে নিয়ে আসা, সর্বজনীন রেশন বা কমদামে নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের সরকারি দোকান চালু করা ইত্যাদি। আলেক্সান্ড্রিয়া ওক্যাসিওকর্টেজ, রাশিদা তালিব, করি বুশ, জামাল বাওম্যান বা ইলহান ওমরের মতো তরুণ তুর্কিদের নেতৃত্বে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্টরা। এই তালিকায় নতুন সংযোজন হল জোহরান মামদানির নাম। 

৩৪ বছর বয়সি জোহরান মামদানি বাবা মাহমুদ মামদানি উগান্ডার থেকে আসা অভিবাসী আমেরিকান, যিনি কলোম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানথ্রোপোলজি ডিপার্টমেন্টের নামী স্কলার, তাঁর মা নামকরা ভারতীয় চিত্রপরিচালক মিরা নায়ার। জোহরানের জন্ম উগান্ডায়, সাত বছর বয়সে তিনি আমেরিকাতে আসেন  ২০১৮ সালে মার্কিন নাগরিকত্ব পান। ধর্মসূত্রে তিনি মুসলমান। আমেরিকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই তরুণ, মুসলমান, অভিবাসী নাগরিকের উত্থান প্রায় ধূমকেতুর মতো 

মামদানির প্রচারে দেওয়াল বিজ্ঞপ্তি। নিউ ইয়র্ক

এক বছর আগে যখন তিনি এই মেয়র নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নেন, তখন কেউ ভাবতে পারেনি যে, এই অনভিজ্ঞ নব্য যুবক প্রথমে ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমারে, আর তার পরে নিউ ইয়র্কের মতো শহরের মেয়রের নির্বাচনে অ্যান্ড্রু কুওমোর মতো পোড়-খাওয়া রাজনৈতিক এবং ধনকুবেরকে হারিয়ে দেবেন। এক বছর আগে কোনও মিডিয়া হাউজের কল্পনাতেও ছিল না যে, জোহরান এই দৌড়ের একজনডার্ক হর্স’ নিউ ইয়র্ক চিরকালই ডেমোক্র্যাটদের শক্ত ঘাঁটি। পার্টির তরফ থেকে যে প্রধান প্রার্থী হয়, সে প্রাইমার এবং নির্বাচন– দুটোই জিতে যায়। নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন মেয়র এরিক অ্যাডামস একটি ঘুষ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে মোটামুটি এই রেস থেকে সরে দাঁড়ান এবং ডেমোক্র্যাটদের প্রধান প্রার্থী হন প্রাক্তন গভর্নর কুওমো। কিন্তু উড়ে এসে জুড়ে বসা এই তরুণ ছেলেটি যেভাবে সব হিসেব ওলটপালট করে দিলেন, তা সুদূর ভবিষ্যতেও গল্পকথা হয়ে রয়ে যাবে। 

আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল শহর নিউ ইয়র্ক। ‘ডেমোগ্রাফিক ডাইভার্সিটি’ বা জনসংখ্যার বৈচিত্রের জন্য বিখ্যাত এই শহর, অভিবাসী প্রবাসীদের শ্রমের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই শহর, ক্রমশ সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। নিত্যদিনের যাতায়াত বা বসবাসের খরচ এতটাই বেড়ে চলেছে যে, শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে টিকে থাকার দৈনন্দিন লড়াইটা ক্রমশ দুষ্কর হয়ে উঠেছে। জোহরান এই সামান্য অথচ মূল বিষয়টাকে হাতিয়ার করে, তার প্রচার শুরু করে। প্রথম থেকেই স্ট্রেট ব্যাটে খেলেন, তিনি বলেন তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য নিউ ইয়র্ক শহরের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা সাশ্রয়কর করে তোলা, যাতে শ্রমজীবী মানুষ আত্মমর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে পারে। তার জন্য তিনি কিছু সহজ উপায় দেখান তাঁর প্রচারসূচিতে। যদি নিউ ইয়র্কের ক্রমবর্ধমান বাড়িভাড়াকে সরকারিভাবে বেঁধে দেওয়া যায়, যাকেরেন্ট ফ্রিজ’ বলে, যদি শিশুদের রাখার ক্রেশ বা ডে কেয়ার সরকার বিনামূল্যে দিতে পারে, যদি বাসের মতো সরকারি পরিবহণ বিনামূল্যে পাওয়া যায়, যদি গৃহহীন মানুষের বাস্তু সুরক্ষা সরকার দিতে পারে, যদি সরকারি হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ে, যদি রোজকার সামগ্রী খাদ্যবস্তু সরকারি রেশন দোকানে সস্তায় দেওয়া হয়, তাহলেই মানুষের জীবনযাত্রা অনেক সহজ এবং নির্ভার হবে। এই ছিল তাঁর ক্যাম্পেনের সারবস্তু: ‘For an affordable New York’। 

অপূর্ব জনতার মাঝে

সত্যি কথা বলতে, এসব বিশালবৈপ্লবিক’ পদক্ষেপ নয়। ইউরোপের এবং বাকি পৃথিবীর বহু শহরে এই সকল প্রকল্প চালু আছে। কিন্তু বিশ্ব পুঁজিবাদের কেন্দ্রীয় ঘাঁটিতে এই সমস্ত কথা ভাবাও পাপ। এই ধরনের সরল সমাজতান্ত্রিক দাবিতেও আমেরিকার পুঁজিবাদী শাসকবর্গ (পার্টি নির্বিশেষে) কমিউনিজমের ভূত দেখে। গত বছর, ক্যাম্পেনের প্রথম দিকে বিলকুল পাত্তা না দিয়েও ২০২৫ সালের শুরুর দিকে অ্যান্ড্রু কুওমো বুঝে যান মামদানির দিকে একটা হাওয়া তৈরি হচ্ছে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির অভ্যন্তরে। এবং মামদানি একদম তৃণমূল স্তর থেকে তৈরি করছেন তাঁর প্রচারের কর্মীদল। মূলত কচিকাঁচা ভলান্টিয়ারের দল, যারা বাড়ি বাড়ি যাবে, মানুষের কাছে, প্রতি ঘরে কড়া নাড়বে, মানুষকে বোঝাবে তাদের অ্যাজেন্ডা। এই সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলে, এবং সঙ্গে সঙ্গে চলে ইনোভেটিভ এবং অনন্য সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেন। প্রথম থেকেই জোহরান সরাসরি আক্রমণ চালান কুওমোর ওপর। কোনওভাবেই এই ধনকুবের, যাঁর ক্যাম্পেনের বিপুল রাশির টাকা আসে অন্যান্য কোটিপতি পুঁজিবাদীর থেকে, তিনি কখনওই সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন দুঃখের শরিক হতে পারবেন না, এবং নিউ ইয়র্কের জীবনযাত্রা সস্তা সাশ্রয় পূরণ করার কোনও প্রচেষ্টাই তিনি করবেন না। 

মাইকেল ব্লুমবার্গ, বিল একম্যানের মতো বড় বড় পুঁজিপতি সরাসরি মিলিয়ন টাকা ঢালেন কুওমোর প্রচার তহবিলে। অন্যদিকে মামদানি ডাক দেন ছোট রাশির চাঁদার জন্য। বিন্দু বিন্দু জলে তৈরি হয় মামদানির সাগর। তিনি জানিয়ে দেন একটা সময়ের পরে, যে আমাদের যত টাকার প্রয়োজন আমরা তা তুলে নিয়েছি, দয়া করে আর টাকা পাঠাবেন না! এবার যদি পারেন, আমাদের সময় দিন। আমাদের ক্যাম্পেনে শামিল হন। শ্রমিক শ্রেণির সমস্ত গোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে যান মামদানি। এশিয়ার মানুষ, আফ্রিকানআমেরিকান, ল্যাটিনো, মুসলমান, ইহুদি, বা শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক শ্রেণি বা মধ্যবিত্ত। সবার মাঝেই তাঁর সহজ-সরল কথা, তাঁর দাবি, তাঁর রাজনৈতিক প্রখরতা আর তাঁর সদা হাসিমুখ মানুষকে কাছে টেনে নেয়। ‘LGBTQI’ মানুষদের মধ্যে বিশেষ প্রচার চালান মামদানি তাদের বিশেষ কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে। 

অ্যান্ড্রু কুওমো

এইভাবেই সমাজের সব স্তর থেকে সমর্থন পেয়ে, ডেমোক্র্যাট প্রাইমারিতে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়ান জোহরান মামদানি, মাত্র মাসের মধ্যে। এইবার নড়েচড়ে বসে অ্যান্ড্রু কুওমো-সহ পুরো পুঁজিবাদী বাস্তুতন্ত্র। সরাসরি আঘাত নামায় তারা জোহরানের পরিচিতিরপর। তিনি অনভিজ্ঞ, নিউ ইয়র্কের মতো শহরের হাল সামলাতে অক্ষম থেকে শুরু করে, যে আমেরিকান নয়, বহিরাগত, ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থক (কারণ তিনি মুসলমান), তার সঙ্গে চলে তিনি কমিউনিস্ট, তিনি আমেরিকার শত্রু। একজন মুসলমান অভিবাসী নাগরিকের সমাজতান্ত্রিক অ্যাজেন্ডার ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা গ্রহণযোগ্যতা বিশাল মাত্রায় চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায় পুঁজিবাদী ব্যবস্থার। নানারকম ভুয়ো খবর এবং ব্যক্তি আক্রমণ করে তারা জোহরানকে হারানোর জন্য উঠে-পড়ে লাগে। পাল্টা জোহরান জোরদার প্রচার চালান কুওমোর বিরুদ্ধে, তাঁর সব ধরনের ফান্ডিংয়ের উৎস, কোভিডের সময় গভর্নর থাকাকালীন তাঁর তুমুল প্রশাসনিক ব্যর্থতা এবং ১৩ জন মহিলা যে তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ দায়ের করে, এবং কুওমো উকিলের পিছনে কোটি টাকা ঢেলে সেই কেসগুলো বন্ধ করার চেষ্টা করেন, মামদানি সে সবকিছুই বারবার তুলে ধরেন! সঙ্গে সঙ্গে তিনি পরিষ্কারভাবে এটাও জানান যে, একদা ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ও নেতা হওয়া সত্ত্বেও কুওমো কখনওই ট্রাম্পের বিরোধিতা না করে, তাঁর সঙ্গে ক্রমাগত আপস করে চলেছেন!

এত প্রচেষ্টার পরেও ৩৩ বছরের ছেলেটা অ্যান্ড্রু কুওমো-কে হারিয়ে দেন জুন মাসের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারে। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির চিরাচরিত ঘাঁটি নিউ ইয়র্কে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মূল ক্যান্ডিডেট হয়ে যান, ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট ফ্র্যাকশনের জোহরান মামদানি, পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদরা বুঝে যান আমেরিকার রাজনীতিতে, এটি একটি বড় টেকটনিক শিফট।  

ইতিমধ্যে তুঙ্গে উঠেছে ইজরায়েল দ্বারা সংঘটিত গাজায় চলমান গণহত্যা। মামদানি প্রথম থেকেই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় এটিকেগণহত্যা’ বাজেনোসাইড’ বলে অভিহিত করে এবং জানান তিনি মেয়র হলে, ইজরায়েলের যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু যদি নিউ ইয়র্ক আসে, তাহলে তিনি তাঁকে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ জাস্টিসের বিচার অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের জন্য গ্রেফতার করবেন।  

অপরদিকে কুওমো ঘোর জায়নবাদী ইজরায়েলের সমর্থক। সে মামদানির এই উক্তিকে হাতিয়ার করে ব্যাপার প্রচার চালায় যে, মামদানি সেমিটিক বিরোধী একজন ইসলামিস্ট। কিন্তু গোটা নিউ ইয়র্কের বিশাল সংখ্যক জনতা গাজারপর এই ভয়ানক নৃশংস আক্রমণের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছে, প্রতিবাদ করেছে, যার একটা অংশ ছিল নিউ ইয়র্কের ইহুদি সম্প্রদায়ের মানুষ। অ্যান্ড্রু কুওমোর অপপ্রচারের প্রতিবাদ করে একাধিক ইহুদি ধর্মযাজক মামদানির পক্ষে বিবৃতি দেয়। তার মধ্যে অর্থডক্স টোরি গোষ্ঠী অন্যতম। কুওমোর এই প্রচারটাও ফলে বিশেষ কল্কে পেল না শেষ অবধি। 

প্রচার কৌশল

ডেমোক্র্যাটিক প্রাইমার হারার পরেও কুওমো এই লড়াই থেকে না সরে নির্দল প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ান। রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী হয় কার্টিস সিলওয়া। এবং এখানেই প্রকাশ পায় আমেরিকার পার্টি নির্বিশেষে পুঁজিবাদী রূপ। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হওয়ার পরেও মামদানিকে সমর্থন জানান শুধু ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট নেতারা, যেমন বার্নি স্যান্ডার্স, ‘AOC’ বা এলিজাবেথ ওয়ারেন, কিন্তু তাঁকে সরাসরি সমর্থন জানাতে অস্বীকার করেন ডেমোক্র্যাটদের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব, যাঁর মধ্যে পূর্ব প্রেসিডেন্ট ব্যারাক ওবামা বা কমলা হ্যারিস অন্যতম, তাঁদের নীরবতা প্রচ্ছন্ন সমর্থন দেয় কুওমোকে। অন্যদিকে রিপাবলিক পার্টির একাধিক সেনেটর এবং শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এবং ইলন মাস্কের মতো আরবপতি ধনকুবের নিজেদের পার্টির প্রার্থীকে ডিঙিয়ে সরাসরি সমর্থন জানায় কুওমোকে। কার্টিস সিলওয়া- ওপর তুমুল চাপ দেওয়া হয়, যাতে তিনি তাঁর প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করে নেয়। লড়াইটা আর কোনও পার্টির মধ্যে নির্বাচনী দ্বন্দ্ব না হয়ে, সোজাসুজি পুঁজিবাদ বনাম শ্রমিক শ্রেণির লড়াই হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে কুওমোর পিছনে জোট বাঁধে নিউ ইয়র্ক এবং আমেরিকার অন্যত্রর বড় বড় পুঁজিবাদী। তারা নিরন্তর প্রচার চালায় যে, নিউ ইয়র্কের সর্বনাশ আসন্ন! ইসলামিক কমিউনিস্টরা সর্বনাশ করে দেবে এই শহরের। সমস্ত বড় পুঁজি শহর ছেড়ে চলে যাবে, চাকরির বাজার নষ্ট হয়ে যাবে, এবং সিডনি সুইনির মতো ফিল্মস্টা হোক বা লেডি লিবার্টির স্ট্যাচু– সবাইকেই বোরখা পরে থাকতে হবে। 

এই নিরন্তর প্রচারের অপর প্রান্তে চলতে থাকে মামদানির ডোর-টু-ডোর ক্যাম্পেন। শেষ অবধি প্রায় এক লাখ মানুষ তাঁর ভলান্টিয়ার গ্রুপের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। শ্রমিক শ্রেণির সব বর্ণ, জাতি, ধর্ম সব দেশের অভিবাসী, যাদের রক্ত-ঘামের ফসল নিউ ইয়র্ক শহর, তারা ওই হাসিমুখ মুসলমান ছেলেটার পিছনে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ায়।

মামদানি নানা ভাষায় ক্যাম্পেন চালান। তাঁর ক্যাম্পেন ভিডিও হয় ইংলিশ, আরবি, স্প্যানিশ, হিন্দি আর বাংলায়। তিনি নিজে এইসব ভাষায় তাঁর অ্যাজেন্ডা এবং তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে নিউ ইয়র্কের রূপরেখা তুলে ধরেন। তিনি জানান, % ধনীদের উপার্জন অনুযায়ী করছুট না দিয়ে আরও ট্যাক্স বাড়ালেই শ্রমিক শ্রেণির জন্য সাশ্রয়ী নিউ ইয়র্ক গঠন করা সম্ভব। 

ফলশ্রুতি গতকাল, ৫ নভেম্বর বিশাল ভোটে জিতে ইতিহাস গড়লেন জোহরান মামদানি। সব অপপ্রচার, সব ব্যক্তি আক্রমণ, মুখ থুবড়ে পড়ল এক নব্য যুবকের স্বপ্ন পূরণের সামনে।

এর পরে লড়াইটা আরও কঠিন। বিপ্লব করার থেকে বিপ্লব বজায় রাখা আরও কঠিন– আমরা জানি। আমরা জানি, ট্রাম্প নখে-দাঁতে লড়বেন মামদানির বিরুদ্ধে। তিনি ইতিমধ্যেই জানিয়েছেন ফেডারেল ফান্ড বন্ধ করে দেওয়া হবে নিউ ইয়র্কের জন্য, যদি মামদানি জেতে। ইতিহাসে চোখ রাখলে আমরা এটাও জানি যে, জনপ্রিয় শ্রমিক শ্রেণি বা প্রান্তিক মানুষের নেতাদের কী পরিণতি হয়েছে আমেরিকা মাটিতে। আমরা জানি মার্টিন লুথার কিং, ম্যালকম এক্স, কার্লো ট্রেস্কা, হার্ভে মিল্ক-দের কী পরিণতি হয়েছিল– ভাড়াটে আততায়ীদের হাতে গুলি খেয়ে মরতে হয়েছিল। আমরা এ- দেখেছি বহু প্রতিভাবান স্বপ্নের ফেরিওয়ালারা কীভাবে পুঁজির সামনে বিকিয়ে গিয়েছে। তাই জোহরান কীভাবে এই বিশাল স্বপ্নের মায়াজালকে বাস্তবায়িত করবে, সেটাই দেখার। কিন্তু সমস্ত অপপ্রচারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে প্রান্তিক সমাজের একজন মানুষ যখন নিজের রাজনীতির সঙ্গে কোনওরকম আপস না করে, এত বড় একটা জয় হাসিল করে নেয়, তখন সবার মনেই একঝলক আশা জেগে ওঠে এই নৈরাশ্যের হতাশার যুগে। মনে পড়ে যায় সমাজতন্ত্রের সেই চিরন্তন স্লোগান, ‘Another world is possible’। 

ভবিষ্যতে যাই হোক, জোহরান মামদানির এই দাঁতে দাঁত চেপে করা লড়াইয়ের থেকে সারা বিশ্বের বামপন্থীদের অনেক কিছু শেখার আছে!