Robbar

উদার অভিবাসী নীতি থেকে সরে আমেরিকার ‘ইউ টার্ন’ কেন?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:March 2, 2025 5:23 pm
  • Updated:March 5, 2025 9:45 am  

আমেরিকার ইতিহাসের দিকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, অভিবাসীদের অব্যাহত স্রোতের স্বাভাবিকতার মধ্যেই ভিন্নধর্মী জনবসতিদের নিয়েই গড়ে উঠেছে বর্তমান আমেরিকার অবয়ব। কারণ এদেরই কর্মঠ কায়িক বা মেধার ফসলেই বর্তমান আমেরিকা সমগ্র বিশ্বে তার নিজস্ব অবস্থান ও পরিচয় অর্জন করেছে। অতীতের চাষের জমিদখল, আগ্রাসী স্বর্ণসন্ধান এবং রেলপথ প্রতিষ্ঠার সেই ‘ওয়েস্টওয়ার্ড  মুভমেন্ট’-এর সময় থেকেই এই দেশেরই শরীরী ভাষা ও স্পষ্ট উচ্চারণ একটাই ‘দেশীয়দর্শন’-এর কথা বলে– ‘ল্যান্ড অব ফ্রিডম অ্যান্ড অপরচুনিটি’।

গ্রাফিক্স: অর্ঘ্য চৌধুরী

শুভশ্রী নন্দী

২২ অক্টোবর ২০২৪, সংবাদপত্র জানাল যে, চার্টার্ড বিমানে করে নথিহীন ভারতীয়দের দেশে পাঠাল আমেরিকা। ‘জুন মাস থেকে ৪৯৫টি বিমানে ১৪৫টি দেশের ৬০,০০০-এরও মানুষকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়েছে আমেরিকা। গত এক বছরে মেক্সিকো ও কানাডার সীমান্তরক্ষীদের নজরে পডেছে ৯০,৪১৫ জন ভারতীয় অবৈধ অনুপ্রবেশকারী– যার মধ্যে ২০,০০০ মানুষ ভিসার মেয়াদ ফুরনোর পরও অবৈধভাবে এদেশে থেকে যেতে চেয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর নির্বাচনী প্রচারে ১১ মিলিয়ন অবৈধ অনুপ্রবেশকারীকে ফেরত পাঠাবেন ঘোষণা করেছেন। বছরে এক মিলিয়ন ফেরত পাঠাতেই সরকারের খরচ ৮৮ বিলিয়ন ডলার। তাই বিষয়টি এখানে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে আমেরিকায় এমারজেন্সি ঘোষণা করে সেনা নামানোর কথা চলছে অভিবাসী প্রত্যাবর্তনের ঘটনা নিয়ে।

Indian Illegal Immigrants Deported From US In Handcuffs And Chains? PIB Fact-Checks Viral Photo - News18

‘ইউএস ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি’-র (আই.সি.ই) রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৩-এ ২,৭১,০০০ অবৈধ অভিবাসীকে তাঁদের নিজেদের দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। এঁদের মধ্যে শতকরা ৮২-জন সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা-ও এবার রয়েছে অবৈধ অভিবাসী প্রত্যাবর্তনের তালিকায়। তাঁর ওপর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন তাঁর আমলে হতে চলেছে সর্ববৃহৎ ঐতিহাসিক প্রত্যাবর্তন। ‘আই.এন.এ. বা ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনেলিটি অ্যাক্ট’ আইনের দিকটি দেখভাল করলেও, দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরাই কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনাভিত্তিক সিদ্ধান্তে,  প্রতি বছর সরকার অনুমোদিত অভিবাসীর সংখ্যা নির্ধারিত করেন।২০২২-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৬.২ মিলিয়ন অভিবাসীর অধিবাস এখন বর্তমান আমেরিকায় যা মূল জনসংখ্যার ১৪.৩ শতাংশ। বিশ্ব-রাজনীতির প্রেক্ষাপটে যদিও-বা আমেরিকাকে ‘দাদাগিরি’-র জন্য গঞ্জনাভোগ করতে হয়, তার অভিবাসননীতি সম্বন্ধিত ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ উদারনীতি সম্বন্ধে কোনও নিন্দুকেরই কিছু বলার অবকাশ নেই। বাইডেন সরকারের আমন্ত্রণ নীতি এমনই ‘উদার-অবারিত’ ছিল এক সময় যে, প্রতিদিন সীমান্তে ৩০০০ অভিবাসীকে ঢুকতে দিয়ে তবে গেট বন্ধ করা হত।

দুই দেশে অবস্থিত আত্মীয়স্বজনের পারিবারিক মিলন ঘটানো, দেশীয় স্বার্থে প্রযুক্তিগত কারিগরি কর্মকুশলীদের আমন্ত্রণ করে আনা, অনুন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে লটারি ভিত্তিক গ্রিনকার্ডের হরির লুট ছড়ানো, উচ্চশিক্ষার অভিপ্রায়ে বিশ্বব্যাপী ছাত্র আপ্যায়ন– এরপরও রয়েছে মানবতার ক্ষেত্রে শরণার্থীর জন্য অবারিত দ্বার উন্মোচন– দীর্ঘসময় ধরে এই সমস্ত নীতি প্রণয়নের ফসল হিসেবে দেশটি আজ অর্থনৈতিক সংকটে। সেই সোনার দিনের ‘চমক’ আজ আর নেই, তবুও দেশটির প্রতি আকর্ষণের ‘চুম্বক’ এখনও সমান অটুট। সময়ে সময়ে একদিকে যেমন আমেরিকার উদার অভিবাসী আইনের ফায়দা তুলেছে সব দেশের নাগরিক, তেমনই শঠেশাঠ্যং ভাবে আজ কাগজপত্রে কোনও কোনও গ্রিনকার্ডে আবেদনকারীদের অপেক্ষারত সময়সীমা, মুদ্রিত অক্ষরে দেখাচ্ছে ১৫০ বছর।

কথায় বলে, সোজা আঙুলে না হলে বাঁকা আঙুলে ঘি তুলতে হয়। সেক্ষেত্রে গ্রিনকার্ড অপেক্ষারত ভারতীয়রা বরং তাকিয়ে রয়েছে কবে তাঁদের এদেশে জন্মানো আমেরিকান নাগরিক সন্তানরা ২১ বছরে পা দেবে, যখন তাঁরা মা-বাবার সবুজ কার্ডের জন্য সরকারি আবেদনের অধিকারী হবে। সেক্ষেত্রে সবুজ কার্ড অর্জনের জন্য অপেক্ষার মেয়াদ হবে মাত্র ১১ থেকে ২৫ মাস।

US to process more green cards this year under employment based categories - CNBC TV18

২০১৬-’১৭-তে বহু অনাবাসী ভারতীয়রা গ্রিনকার্ড হওয়ার আগেই রাষ্ট্রকর্তৃক অনুমোদিত সম্পত্তি আইনাধিকার অনুযায়ী, বাড়ি কিনে ফেলা সত্ত্বেও ভিসার মেয়াদ ফুরনোতে তাঁদের কয়েক দিনের নোটিশে দেশে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল। এঁদের অধিকাংশই ভারতীয় প্রথিতযশা কোম্পানিগুলোয় চাকুরিরত। সেই কোম্পানিগুলোর ভিসা আবেদনের মেয়াদ শেষ হলে, আবার গ্রিনকার্ড প্রসেসিং চলাকালীন যদ্দিন হাতে না আসে, ততদিন কিছুদিনের জন্য কানাডা অথবা ভারতে একই কোম্পানিতে কাজ করে এদেশে ফিরে আসেন। সরাসরি আমেরিকান কোম্পানিতে কাজসূত্রে যাঁরা আসেন, তাঁদের ক্ষেত্রে কোম্পানিটিকে একটি বিধিমতো চাকরির বিজ্ঞাপন স্থানীয় পত্রিকায় প্রকাশ করতে হয় এবং নিয়মানুযায়ী দেখাতে হয়– এই পদের জন্য কোনও উপযুক্ত যোগ্য আমেরিকান নাগরিক পদপ্রার্থী নেই, তবেই তাঁরা অন্য দেশের নাগরিককে কাজে নিয়োগ করতে ও আইনগত সবুজকার্ড স্পনসর করতে পারবেন। এঁদের ক্ষেত্রে আজ ‘চাকরি’ হারানো মানে পরদিন পত্রপাঠ ‘বিদায়’ হওয়াই নিয়তি।

এই চাকরি ছাড়াও ভারতীয় ফাস্টফুড ও স্ট্রিটফুডের জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর এমনই বাড়ছে যে, সাময়িক কর্মভিসাতে নামমাত্র মজুরিতে দেশীয় লোকজন এনে, পরে তাঁদের ভিসার মেয়াদ ফুরলে পরবর্তী তৎপরতা নিয়ে কোনও উদ্যোগ সবাই নেন কি না, বলা মুশকিল। একইভাবে রাস্তা বানানো-সারানো এবং বাড়িঘর তৈরির ক্ষেত্রে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী মেক্সিকান মানুষের ওপর নির্ভরশীল হলেও, এদের কাগজপত্র নথি নিয়ে যথেষ্ট জলঘোলা হয় মাঝেমধ্যেই। ভিড়ের মধ্যে মিশে থাকা এঁদের ধরা পড়লে আর নিস্তার নেই! যেমন ক’দিন আগে কাগজ দেখাতে না পারায় জর্জিয়ার একটি সরকারি স্কুলের একটি ক্লাস বন্ধ করে দিতে হয়েছিল। এরা কাগজপত্রবিহীন নিজেদের একটা সমাজগঠন করে পারস্পরিক সাহায্যের আদানপ্রদানের সমাজবন্ধনের মাঝে, এক কঠিন সংগ্রামের দিন কাটান। যদি ধরা পরেন, বিপদে পড়ে শুধু  লাইসেন্স ছাড়া গাড়িটি নয়, তাঁরা নিজেরাই প্রথম যাবেন হাজতে, অতঃপর নির্বাসনে। এসব জেনেও উন্নতজীবন বা স্বদেশীয় সংঘর্ষপূর্ণ অশান্তি এড়াতে, তাঁদের এই চরম ঝুঁকির যুদ্ধময় জীবন চয়ন।

………………………………………………..

২০১৬-’১৭-তে বহু অনাবাসী ভারতীয়রা গ্রিনকার্ড হওয়ার আগেই রাষ্ট্রকর্তৃক অনুমোদিত সম্পত্তি আইনাধিকার অনুযায়ী, বাড়ি কিনে ফেলা সত্ত্বেও ভিসার মেয়াদ ফুরনোতে তাঁদের কয়েক দিনের নোটিশে দেশে প্রত্যাবর্তন করতে হয়েছিল। এঁদের অধিকাংশই ভারতীয় প্রথিতযশা কোম্পানিগুলোয় চাকুরিরত। সেই কোম্পানিগুলোর ভিসা আবেদনের মেয়াদ শেষ হলে, আবার গ্রিনকার্ড প্রসেসিং চলাকালীন যদ্দিন হাতে না আসে, ততদিন কিছুদিনের জন্য কানাডা অথবা ভারতে একই কোম্পানিতে কাজ করে এদেশে ফিরে আসেন।

………………………………………………..

আমেরিকার ইতিহাসের দিকে পিছন ফিরে তাকালে দেখা যায় যে, অভিবাসীদের অব্যাহত স্রোতের স্বাভাবিকতার মধ্যেই ভিন্নধর্মী জনবসতিদের নিয়েই গড়ে উঠেছে বর্তমান আমেরিকার অবয়ব। কারণ এদেরই কর্মঠ কায়িক বা মেধার ফসলেই বর্তমান আমেরিকা সমগ্র বিশ্বে তার নিজস্ব অবস্থান ও পরিচয় অর্জন করেছে। অতীতের চাষের জমিদখল, আগ্রাসী স্বর্ণসন্ধান এবং রেলপথ প্রতিষ্ঠার সেই ‘ওয়েস্টওয়ার্ড  মুভমেন্ট’-এর সময় থেকেই এই দেশেরই শরীরী ভাষা ও স্পষ্ট উচ্চারণ একটাই ‘দেশীয়দর্শন’-এর কথা বলে– ‘ল্যান্ড অব ফ্রিডম অ্যান্ড অপরচুনিটি’।

প্রশ্ন ওঠে যে, কী এমনের চুম্বকের টান রয়েছে এই দেশে যাতে আলুর ট্রাকে বস্তার নিচে পাঁচদিন শুয়ে বা বহু মাইল সাঁতরে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও এদেশে পৌঁছতে চান মানুষ? কী এর আকর্ষণ? পৌঁছে গেলাম ১৯৫৮-তে আটলান্টায় আসা প্রথম ভারতীয় ও বাঙালি ৯০ বছরের অসিত নারায়ণ সেনগুপ্ত কাছে। প্রথমে তিনি পৌঁছেছিলেন নর্থ ক্যারোলিনা। দেশ থেকে আমেরিকায় পৌঁছতে লেগেছিল একমাস। তৎকালীন কলকাতার ট্রেভেল এজেন্ট কোম্পানি ‘হরি সিংকা’ ব্যবস্থা করে দিলেন যাত্রাপথের। প্রথমে কলকাতা থেকে বম্বে ট্রেনে, বম্বে থেকে ১৫,০০০ টনের ছোট জাহাজে ‘মার্সেই’ বলে দক্ষিণ ফ্রেন্সের ভূমধ্যসাগরের একটা বন্দরে। সেখান থেকে ট্রেনে এলেন প্যারিস। প্যারিস থেকে আরেকটি ট্রেনে ‘ক্যেলে’ (calais) বলে একটি বন্দরে। সেখান থেকে স্টিমারে করে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডের একটা ছোট বন্দর ‘ডোভার’-এ পৌঁছে, ট্রেনে করে লন্ডন এলেন। লন্ডন থেকে ট্রেনে ইংল্যান্ডের একটি বন্দর ‘সাউথেমটন’। সেখান থেকে ‘রয়্যাল রটারডাম’ জাহাজে করে ছয় দিন লেগেছে আটলান্টিক পার হতে, যা ছিল সেন্ট্রেল মাল্টিস্টোরিড লবি-সহ জাঁকজমক নিয়ে ছোটখাটো ‘টাইটেনিক’-এর মতো। সেই জাহাজ এসে পৌঁছল কানাডার মন্ট্রিওলে। প্রচণ্ড দুলুনিতে আসবাব, চেয়ারে বসা মানুষও পড়ে যাচ্ছিল! সেখান থেকে গ্রে হাউন্ড বাসে নিউ ইয়র্ক এবং আবার বাসে ১০ ঘণ্টায়  নর্থ ক্যারোলিনার ‘রলে’-তে পৌঁছলেন তিনি। জানালেন ‘সি সিকনেস’-এর চাইতেও কাবু করেছিল বেশি ‘হোম সিকনেস’। অসিতবাবু আর্কিটেকচারে বি. ই. কলেজের ফার্স্ট ক্লাস এবং আইআইটি-তে পড়াতেন। আর্জেন্টিনার এডুয়ার্ডো সেক্রিস্টি নামের একজন ভিসিটিং প্রফেসর, যিনি আইআইটি-তে তাঁর কাজ দেখেন, নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে সুপারিশ করেছিলেন তাঁর নাম। দেড় বছরের ‘এক্সচেঞ্জ ভিজিটর ভিসা’-তে তিনি এলেন কলম্বাসের স্বপ্নরাজ্য আমেরিকায়, ১৯৫৮ সালে ৫,০০০ ডলারের চাকরি নিয়ে। নর্থ ক্যারোলিনা নেমেই সেদিন তিনি ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিনের বাড়িতে। জানালেন, ‘এখনও গায়ে কাঁটা দেয় ভাবতে যে ডিন জানিয়েছিলেন, এই গেস্ট বিছানাটিতেই থেকে গেছেন এই শতকের সব চাইতে বড় আর্কিটেক্ট ফ্রেঙ্ক লয়েড রাইট।’ বি. ই. কলেজের তৎকালীন ডিপার্টমেন্ট হেড ছিলেন আমেরিকান জোসেফ এল্লেনস্টাইন, থিসিস এডভাইসার রিচার্ড সি মার্শাল, গেস্ট প্রফেসর ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব কলোরাডোর স্থাপত্য বিভাগের হেড থমাস এল হেনসেন এবং আই.আই.টি-তে গেস্ট প্রফেসর জ্যাক উডস থাকাতে আমেরিকান ইংরেজিতে অভ্যস্ততায় কোনও অসুবিধে তাঁর হয়নি।

ভিসা ফুরলে তাঁর ভিসার নিয়মানুযায়ী, ছয় বছরের জন্য বেরিয়ে যেতে হবে বলে, চলে গেলেন কানাডায়। মেয়াদ শেষে এবারে আটলান্টায় কাজ নিয়ে এলেন ‘ডুম্বস আমিসানো অ্য়ান্ড ওয়েলস’ আর্কিটেক্ট কোম্পানিতে যাকে বলা হত– ‘নুমেরো উনো’ অর্থাৎ সবচেয়ে ভালো কোম্পানি। মালিক ইতালিয়ান আমেরিকান জোয়া মিসানো স্পনসর করলেন ভিসা। ১৯৫৮-তে আমেরিকাতে পা রাখা অসিত নারায়ণ সেনগুপ্ত নাগরিকত্ব নিলেন ১৯৭৫-এ । ‘এই দেশ কী দিয়েছে?’ প্রশ্ন করা হলে, অসিতবাবু  জানালেন– ক’দিনের মধ্যেই চাকরি ছেড়ে পিচ ট্রি সেন্টারে নিজের অফিস খুললেন, ‘সেনগুপ্ত গ্রুভার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস’। ‘পিচ ট্রি সামিট’ অর্থাৎ সংবাদ সংস্থা  সি.এন. এন. হেড কোয়ার্টার যেখানে রয়েছে সেই ‘অমনি ইন্টার ন্যাশনেল’– সেটা ডিজাইন করেছেন তিনি। মার্টা অর্থাৎ আটলান্টার মেট্রোরেল পথের পুরো প্ল্যানিং ও নকশা করেছেন তিনি– কোথায় স্টেশন হবে, ওয়েস্ট লেইক স্টেশনটিও যা এখনও চলছে। ডাউনটাউন কানেক্টার ২৩তলা অফিস বিল্ডিংয়ের কোনাগুলো কাটা– তাঁর করা অনন্য নকশা।  সঙ্গে অফিসের একতলায় একটা বুটিক খুললেন ‘সেনগুপ্তাস’ নামে। ‘ক্যালকাটা রেস্টুরেন্ট’  খুললেন জয়ন্ত ভট্টাচার্য, সুমিত্রা ভট্টাচার্য ও অশোক ভট্টাচার্যের সঙ্গে পার্টনারশিপে। এর সঙ্গে জর্জিয়া টেকের মতো বিখ্যাত কলেজে পড়াতেনও। অসিতদা জানালেন, ‘‘৬ বছর পর যখন প্রথম বোয়িং ৭০৬ এ দেশে গেলাম, এখনকার ‘ডোমেস্টিক ফ্লাইট’-এর মতো দু’ধারে তিনটে তিনটে সিট ছিল সেই প্লেনে।’’

US to deploy 1,000 more troops to boost Trump's immigration crackdown | World News - Business Standard

এরপর দেখা করলাম শিক্ষিকা রাজ্জার সঙ্গে। ‘এই দেশ তোমায় কী দিয়েছে?’ প্রশ্ন নিয়ে হাজির হতেই একমুখ হাসি ইরাকি অভিবাসী রাজ্জা-র মুখে। সাদ্দাম হুসেনের সেনাবাহিনীতে ছিল তাঁর স্বামী। ইরাকের বাগদাদের বিমানবন্দরে এয়ার ডিফেন্সের দায়িত্ব ছিল তাঁর। তেলের প্রাচুর্যে ধনী ছিল তাঁর ইরাক। এমতাবস্থায় আমেরিকার আক্রমণ, সিয়া-দের আধিপত্যে সাদ্দাম ধরা পড়ল। রাজ্জার স্বামীকে নিয়ে গেল হাজতে। কী অত্যাচার হয়েছিল, তাই নিয়ে মুখ খোলেনি সে এখনও। এদিকে একদিন তাঁর বাড়িটিও পুড়িয়ে দিল শত্রুপক্ষ। সিরিয়ার সীমান্তে একটা পরিত্যক্ত বাড়িতে পাঁচটি সন্তান নিয়ে বন্দুক হাতে সারারাত জাগত ভরযৌবনের রাজ্জা। আর সব গয়না বিক্রি করে দিনে ছুটত স্বামীকে ছাড়ানোর জন্য উকিলের কাছে। এমন সময়ে একদিন গুলি লাগল ছ’ বছরের ছেলে মাহমুদের পায়ে। স্বামী ছাড়া পেলে তিন দফায় রাষ্ট্রসংঘের অফিসে সাক্ষাৎকারের পর আমেরিকায় শরণার্থী হয়ে আসে সপরিবার। কিন্তু আমেরিকার সরকারি নিয়মানুযায়ী, তিনমাস বাসস্থান ও আর্থিক সাহায্য দেওয়ার পর শুধু বাচ্চাদের স্বাস্থ্য এবং ফুড স্ট্যাম্প ছাড়া আর কোনও দায়িত্বে সরকার থাকে না। চাকরি, গাড়ি, বাসস্থান বিহনে ৭টি মুখের অন্ন জোগাতে ইংরেজি না জানা রাজ্জা চলে যায় ইসলামিক বিদ্যায়তনে আরবি ভাষা শেখাতে। স্বামী যোগ দেন ঘর তৈরির কাজে। আজ রাজ্জা আমেরিকান নাগরিক। যুদ্ধের গুলির দাগ এখনও পায়ে নিয়ে মাহমুদ আইনে পি.এইচ.ডি। আমেরিকার ইরাকি অভিবাসী কমিউনিটিতে সে-ই প্রথম কৃতী এ বিষয়ে।

…………………………………………….

আরও পড়ুন মৌমিতা আলম-এর লেখা: আচ্ছা, একটি মানুষ কী করে অবৈধ হয়?

…………………………………………….

তুরস্ক থেকে আসা জেনেপের সংগ্রাম অন্য। গুলেন মুভমেন্ট সমর্থক হিসেবে সেই সংস্থা তুরস্কে আতঙ্কবাদী হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে আমেরিকায় শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয় গুলেন আন্দোলনের নেতা-সহ সকল সমর্থক– যাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তুরস্কের সরকার বাজেয়াপ্ত করেছে। এঁদেরই একজন তাঁর পরিবার। কিন্তু মাঝপথে গর্ভবতী হয়ে পড়ে সে আবার, একই সময়ে  স্বামী হারায় তাঁর কর্মভিসা। বাসস্থানের ঠাঁই এবং সংগ্রাম সত্ত্বেও স্বপ্ন দেখে সে– তুরস্কের স্বচ্ছল জীবন আবারও অর্জন করবে সে একদিন আমেরিকায়।

US Sends Back Illegal Indian Immigrants On Chartered Flight Ahead Of Polls

২০২৩-এর ২৬ জানুয়ারি। রাশিয়ার ৩০টি মিসাইল আঘাত হানল ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের ওপর। ৬ বছরের মেয়ের হাত ধরে দেশ ছাড়লেন অ্যালেনা পিয়াৎনিস্কা। লিয়েভ থেকে পোলান্ডের ওয়ারশো হয়ে স্পেনের গ্রান্ডিয়া, সেখানে ভিসা ও ভাষার সমস্যা। কানাডা ‘ইমিগ্রেশন প্রোগ্রাম’ চালু করায় পৌঁছল অটোয়াতে, সেখান থেকে আটলান্টা। বোমাতে ওঁর স্বামীর খারখিভ অফিস ধ্বংস হয়। আটলান্টার ব্রাঞ্চে চলে আসেন তিনি। এঁরা এসেছে ‘ইউনাইটেড ফর ইউক্রেন’-এর ‘হিউমেনেটেরিয়ান প্যারোলে’ যা আমেরিকায় থাকার দু’বছরের জন্য ভিসার অনুমোদন দেয়। এই ভিসার ‘নো সুইচিং স্টেটাস’। যদি দু’বছর পর মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন না পায়, ফিরে যেতে হবে ওদের যুদ্ধকবলিত দেশে। তাঁর অন্য বন্ধুদের রয়েছে ‘টেম্পোরারি প্রটেক্টেড স্টেটাস’ যা গ্রিনকার্ডে সহজে বদলে নেওয়া যায়। তবে শর্ত হচ্ছে ভিসা থাকাকালীন তাঁরা দেশ ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। চিকিৎসা বিমা, নগদ টাকা ও ফুড স্টাম্প দিয়ে শুরু হয়েছিল এলেনার শরণার্থী জীবন। বাড়িভাড়ার প্রোগ্রাম জর্জিয়াতে নেই। তিনি কাজ শুরু করেছেন একটি ডে কেয়ারে। এর মধ্যে স্বামীর সঙ্গে হয়েছে ছাড়াছাড়ি। এই মুহূর্তে সংগ্রাম থাকলেও তিনি বিশ্বাস করেন ১০ বছর পর এমন আর থাকবেন না। আপাতত চাকরি, গাড়ি, ভাড়াবাড়ি নিয়ে তিনি খুশি। আমেরিকা তাঁর মেয়েকে যুদ্ধের ‘ট্রমা’ থেকে এক ‘শান্তির শৈশব’ উপহার দিয়েছে বলে কৃতজ্ঞও।

পাকিস্তান থেকে আসা অভিবাসী ফাতিমা। বাবা ট্যাক্সিচালক, মা বাড়িঘর পরিষ্কারের কাজ করতেন। মেধাবী ফাতিমা বিল গেটস-কে চিঠি দিয়ে তাঁর ফান্ডের স্কলারশিপ জোগাড় করে পড়াশোনা চালিয়ে স্নাতক ও স্নাতোকত্তর শ্রেণিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম হয়। আজ তিনি এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে কয়েক একর জমির মালিক। আমেরিকাতে ভারতীয় চাকরিরত অনাবাসীদের জীবন অনেকটা জেরক্স কপির মতো গোছানো হয় অনেকটা যুদ্ধের গপ্পর পর। চারটা স্যুটকেস হাতে মঙ্গল গ্রহে ছেড়ে দিলে যেমন হয়, অনেকটা তাই। মাটিতে গদি পেতে শুয়ে যে জীবন শুরু হয়, অচিরেই সে হয়ে ওঠে আলাদিনের আশ্চর্যপ্রদীপের মতো ‘ফোর বেডরুম বাড়ি’। এই পদোন্নতির সোপানগুলো পেরোতে ধাপে ধাপে তাঁকে হয়ে উঠতে হয়েছে মালি, মালতীর মা, কাঠমিস্তিরি, প্লাম্বার, টিউটর ও  ড্রাইভার। বাড়িতে ‘জমাদার’ থেকে ‘জমিদার’-এর জীবন উপহার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রমের মূল্যের শিক্ষার ‘চক্ষুদান’ করেছে যে দেশ, তার নাম আমেরিকা। অভিবাসী তাকে ঋদ্ধ করেছে যেমন, সেও করেছে উজার করে ঋণস্বীকার। এভাবেই আমেরিকা তাকে কী দিয়েছে এবং সে আমেরিকাকে– এই দু’টি প্রশ্নের উত্তরই এক হয়ে তাদের জীবনের কথা বলে।

জো বাইডেনের আমলে মেক্সিকো সীমান্তে অভিবাসী আমন্ত্রণ রুখতে আমেরিকার সরকারের চূড়ান্ত পদক্ষেপের নমুনা ছিল যে প্রতিদিন ৩,০০০ শরণার্থীকে ঢুকতে দেওয়ার পর গেট বন্ধ করা হবে। মনে রাখুন, এই সংখ্যা প্রতি মাসে নয়, প্রতি দিনের জন্য বরাদ্দ।

Trump crackdown: India to repatriate 18,000 illegal immigrants from the US | Personal Finance - Business Standard

আজ এক দশক থাকার পর আফগানিস্থান থেকেই হোক বা অভিবাসী প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রেই হোক– বিমানের যাত্রামুখ বদলে, একদা অভিবাসীকেন্দ্রিক আমেরিকার ‘নির্দয়মুখ’ নয়, অভিবাসীসংখ্যা বিস্ফোরণের বুমেরাংয়ের সামনে ‘দেশ’ হিসেবে নিজের ‘আত্মরক্ষার তাগিদ’-এর কথাই বলে। গণবিক্ষোভ ও গৃহযুদ্ধ প্রতিরোধে এই বোধহয় একমাত্র উপায়।

…………………………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

…………………………………………………