একদিন সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের খেয়ালের লাইভ সম্প্রচার। সেজন্য তিনি স্টুডিওতে এসেছেন, বসেছেন সুর-টুরও মেলানো হয়ে গেছে তানপুরায় ও তবলায়। অনুষ্ঠানের ঠিক শুরুতে রেকর্ডিং অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদা কী বন্দিশ গাইছেন খেয়ালে?’ সত্যকিঙ্করবাবু বলেন– ‘বাংলা। বিলম্বিত ও মধ্যলয়ে বন্দিশ।’ অফিসার ‘বাংলা খেয়াল’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সত্যকিঙ্করবাবু বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি বাংলায় গাইব।’ অফিসার বলেন, ‘খেয়াল বাংলায় গাওয়া যায় না।’
২.
সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে একটি ইতিহাস চালু আছে। সেটা বলা উচিত এইখানে। ‘আকাশবাণী কলকাতা’র খেয়ালশিল্পী ছিলেন সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। ’৬১ সাল পর্যন্ত আকাশবাণীতে ‘লাইভ’ সম্প্রচার হত। ’৬২ সালে চিন-ভারত যুদ্ধের পর থেকে লাইভ সম্প্রচার আকাশবাণীতে বন্ধ হয়ে যায়। একদিন ওঁর খেয়ালের লাইভ সম্প্রচার। সেজন্য তিনি স্টুডিওতে এসেছেন, বসেছেন সুর-টুরও মেলানো হয়ে গেছে তানপুরায় ও তবলায়। অনুষ্ঠানের ঠিক শুরুতে রেকর্ডিং অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, ‘দাদা কী বন্দিশ গাইছেন খেয়ালে?’ সত্যকিঙ্করবাবু বলেন– ‘বাংলা। বিলম্বিত ও মধ্যলয়ে বন্দিশ।’ অফিসার ‘বাংলা খেয়াল’ বলে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সত্যকিঙ্করবাবু বলেন, ‘হ্যাঁ, আমি বাংলায় গাইব।’ অফিসার বলেন, ‘খেয়াল বাংলায় গাওয়া যায় না।’ সত্যকিঙ্করবাবু বলেন, ‘কোথায় সেই নিষেধাজ্ঞা লেখা আছে, দেখান।’ অফিসার বলেন, ‘তা আমি দেখাতে পারব না, কিন্তু বাংলায় খেয়াল গাওয়া যায় না।’
এই নিয়ে তুমুল বচসা! ইতিমধ্যে সম্প্রচারের সময়ও চলে আসে। সত্যকিঙ্কর বাংলায় খেয়াল ধরেন। এটা একটা মস্ত ঐতিহাসিক ঘটনা!
আপন খেয়ালে। প্রথম পর্ব: খেয়াল-ঠুংরি গাইতে গেলে কৃত্রিম বাংলা ভাষায় কেন গাইব?
এ নিয়ে হইচই পড়ে যায়। কাগজে কেউ কেউ ভূয়সী প্রশংসা করেন, কেউ নিন্দা করেন– এ হয় না, হয় না। একটি পত্রিকায় সত্যকিঙ্করের তির্যক কার্টুন বেরয়। ছবিটি হল– একজন গোবেচারা গোছের ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বয়স্ক মানুষ, টাক পড়ে গেছে। টাকের ওপরে একটা ট্যাম, মানে ফুলে গেছে, মার খেলে যেমন ফুলে যায়। বগলে একটি ছাতা, হাতে একটি কাপড়ের থলি, ফ্রেমের পিছনে দেখা যাচ্ছে একটি পুলিশ বা এরকম কারও একটি মুখ, হাতে একটা লাঠি ধরা, তিনি দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে আছেন। আর একজন ভদ্রলোক আসছেন, তাঁকে ওই মার খাওয়া, আঘাতের চিহ্নসমেত প্রবীণ মানুষটি বলছেন, ‘বাংলায় খেয়াল গাইতে চেয়েছিলাম, সেই দোষে।’
‘মাসিক বসুমতি’ পত্রিকা, এবং আরও দু’-একটি পত্রিকায় বাংলা ভাষায় খেয়াল নিয়ে নানা লেখা বেরয়। বিভূপদ আচার্য নামে একজন চমৎকার একটা লেখা লেখেন– ‘কেন বাংলায় খেয়াল হবে না?’ তিনি আরও বলেন, আঙ্গিক যদি ঠিকঠাক রাখা যায়, তাহলে ইংরেজি বা চিনা ভাষাতেও খেয়াল হতে পারে। ভাষাটা এখানে কোনও বিষয় নয়। এবং সত্যি বলতে কী, খেয়ালের কোনও হ্যান্ডবুক নেই। খেয়ালের কোনও সংবিধান নেই। বলা নেই– অমুকটি না হইলে খেয়াল হইবে না বা তমুকটি না হইলে খেয়াল হইবে না, খেয়াল হতে গেলে এরকম হতে হবে– না, এরকম কিচ্ছু নেই। তবে দীর্ঘকাল ধরে অভ্যেসের মধ্য দিয়ে, গাওয়ার মধ্য দিয়ে এটা দাঁড়িয়ে গেছে যে, বিবেকানন্দ যেমনটা বলেছিলেন– দুই লাইনের স্থায়ী, দুই লাইনের অন্তরা। এটা বিলম্বিত লয়েও, আবার মধ্য বা দ্রুত লয়েও। দু’টি পর্বে খেয়াল গাওয়া হয়ে থাকে। যাকে বলে ‘বড় খেয়াল’ সেখানে বিলম্বিত লয়ে তারপর দ্রুত। আবার ‘ছোট খেয়াল’, সেটা শুধুই দ্রুত লয়ে। যখন ’৭৮ আরপিএম রেকর্ডিংয়ের যুগ ছিল তখন তো ২ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় ছিল বড় জোর, তার মধ্যেই শেষ করে দেওয়া হত। সে সময় বড় খেয়াল আমরা শুনতে পেতাম গ্রামোফোন রেকর্ডিংয়ে এবং ছোট খেয়াল।
সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই ঘটনা যখন ঘটছে, তখন সেই সময়কার কেন্দ্রীয় সরকারের বেতার ও তথ্যমন্ত্রী ছিলেন বি. ভি. কেশকর। স্বাধীনতার পর যে দু’টি কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত হয়েছিল– দু’টিরই বেতার ও তথ্য মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তিনি কোনও একটা কাজে কলকাতায় এসেছিলেন তখন, আর সমস্ত সাংবাদিক মিলে তাঁকে একযোগে প্রশ্ন করেন: স্যর, এরকম একটা ঘটনা ঘটেছে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে, আপনি কী বলেন? তিনি বলেন, ‘আমাদের সরকারের নীতিই তো সব ভাষায় সব কিছু হবে। গান সব ভাষায় হবে। আর যদি তা না হয়, প্রচার হবে কী করে!’ এটা বলার পর তিনি আরও বলেন, ‘আমি দিল্লি ফিরে গিয়ে কাগজপত্র দেখে আপনাদের আবার জানাব।’ দিল্লি ফিরে যাওয়ার পর বি. ভি. কেশকর একটা কন্ট্রাক্ট পাঠান সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে।
তাতে দেখা যাচ্ছে, সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও আকাশবাণী’ একটি বাংলা খেয়াল গাওয়ার জন্য অনুষ্ঠান দিচ্ছেন। বাংলা খেয়াল গাওয়া এবং সেই সঙ্গে আলোচনা। তখন সবাই দেখলেন, ভারত সরকার মেনে নিচ্ছে, তাহলে অসুবিধা কোথায় আকাশবাণীতে?
(চলবে)
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved