সুন্দর কী– তা নির্দেশ করে দেবে পুঁজির পৃথিবী। অর্থাৎ যে নিজেকে পণ্যে পরিণত করল দ্রুত, যে পণ্য অতি সহজে বিক্রয়ক্ষম, আকর্ষণ করল জনমানস, যে পণ্যকে স্মার্টফোন সুন্দরের নিদান দিল– ইদানীং সুন্দর সে-ই। তাই খাসির মাংসের ঝরে ঝরে পড়াটা সুন্দর। উরফি জাভেদ সুন্দর। আর্ট গ্যালারির ৩০ সেকেন্ডের রিলও সুন্দর। এত সুন্দরের মাঝে অসুন্দর তবে ফিনিশ? কখনও না। ফুটপাথের গুমটি ভেঙে দেওয়ার পরে যে দুই কিশোরী হাউহাউ করে কাঁদল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল না কেউ, তখনই তৈরি হল রিল। হ্যাশট্যাগ ‘মানুষ বড় কাঁদছে’। এই অসুন্দর ইন্সটাগ্রামে ট্রেন্ডিং। এই অসুন্দর যেন আমাদের ভীষণ কাম্য। কারণ, এই অসুন্দরই আমাদের ভাইরাল করেছে।
প্রচ্ছদ শিল্পী: অর্ঘ্য চৌধুরী
৯ সেপ্টেম্বর। ১৮৮৮। ফ্রান্সের আর্ল শহর থেকে চিঠি লিখছেন ভ্যান গঘ।
মাই ডিয়ার থিও, এ শহরের নাইট ক্যাফের কিছু স্কেচ তোমায় পাঠালাম। আমার চেতনায় রাতের ক্যাফেটেরিয়া কী জানো? এমন এক স্থান, যেখানে কেউ নিজেকে ধ্বংস করতে পারে। উন্মাদ হতে পারে। অথবা, খুন করতে পারে। তাই চেষ্টা করেছি মৃদু গোলাপি রঙের সঙ্গে রক্তের লাল ও মদের আভা মিশিয়ে দিতে। পাশাপাশি ব্যবহার করেছি ভেরোনিজ সবুজ এবং অমার্জিত নীল-সবুজ। কোনও সরাইখানার অন্তবর্তী যে আঁধার, যে ক্লান্তি, যে উদ্দামতা– নির্মাণের চেষ্টা করেছি শুধু সেটাই।
ভ্যান গঘ থামলেন। অবিস্মরণীয় ‘ক্যাফে নাইট’ ছবিটি যে মিউজিয়ামে, তার সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলল বছর ২১। ইন্সটাগ্রাম রিলস তৈরি করল বছর ৩১। বছর ৪১, খুব ‘কুল’ সেজে, মেটা-দুনিয়ায় লিখল: হ্যাশট্যাগ ভিনসেন্ট। হ্যাশট্যাগ পেইন্টিংস। হ্যাশট্যাগ এস্থেটিক। আর আর্ট? শৈল্পিক বোধ? সে হল ছাতার মাথা!
একুশ শতকে যাহা ‘ফিল’যোগ্য, তাহাই রিলযোগ্য! ধরুন, একটি প্রকাণ্ড বটগাছের কাছে এসে দাঁড়িয়েছেন। নরম হাওয়া বইছে। দু’একটা হলুদ পাতা খসে পড়ল কাঁধে। ঝুরিমূলের অসংখ্য পায়ের ফাঁকে আবিষ্কার করলেন, স্টিলের পুরনো বাটিতে আটা মেখে রেখেছে কেউ। তৈরি হয়েছে লাল পিঁপড়ের কলোনি। কেন? দু’-পা হাঁটলেই নদী। মাছ ধরতে হবে। মাছের চারা প্রস্তুতির জন্য কিঞ্চিৎ পরিশ্রম।
অথচ, এই সময়ে, অনুসন্ধিৎসু যে মন অথবা পরিসর– এক্কেরে উবে গিয়েছে। মনোযোগের কাল ক্রমে কমিতেছে। তাই বটগাছের দিকে তাকানোমাত্র প্রথম জিজ্ঞাসা, এ কি আদৌ রিলযোগ্য? বটগাছ কি ফোটোজেনিক? সোশাল মিডিয়ায় হাততালি কুড়োবে? কমেন্টে ফুটবে কোনও সূর্যমুখী ফুল? যদি হয়, তবেই সে-বটগাছ মনোগ্রাহী এবং সুন্দর।
……………………………………………………………………………….
কেনট্যাকি শহরের বেলারমাইন মিউজিয়াম অফ আর্ট। একটি চমৎকার গবেষণা করেছে সম্প্রতি। স্নাতকস্তরের একঝাঁক ছেলেমেয়েকে মিউজিয়ামে ছেড়ে দিয়েছিল। এক অংশের হাতে স্মার্টফোন। সেলফি তোলায় মত্ত। অন্য অংশের স্মার্টফোন নেই। পরবর্তীকালে, তথ্য অনুযায়ী, যে অংশের হাতে স্মার্টফোন ছিল না, আর্টের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেছে তারাই। যেহেতু তাদের চোখ এবং পেইন্টিং-এর আলাপচারিতায় কোনও ‘মাধ্যম’ ছিল না। যা দেখেছে, তা নিখাদ আর্ট। অথচ অন্যদের মনে ছিল অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা। কেমন? আর্টের সঙ্গে ছবি তুলে হয়ে উঠতে হবে স্বয়ং ‘পিস অফ আর্ট’।
……………………………………………………………………………….
দেশ-সম্পর্কিত ধারণাটি যেমন প্রতি পলে বদলে যাচ্ছে! সুন্দরের ধারণাটিও ঠিক তাই। সুন্দর আসলে কী? আব্বাস কিয়েরোস্তামির একটি ছবির কথা বলি। ‘হোয়্যার ইজ দ্য ফ্রেন্ডস হাউজ’। আট বছরের আহমেদ। বন্ধু নেমাতজাদেহ্-র বাড়ি খুঁজছে। আকুল হয়ে। হোমওয়ার্কের খাতাটি ফেরত দেওয়ার জন্য। যেহেতু শ্রেণিশিক্ষক বেদম রাগী। সমস্ত দিন, দিন গড়িয়ে বিকেল এবং রাত– আহমেদ বন্ধুর বাড়ি খুঁজে পায় না। পরদিন স্কুলে আহমেদ খাতাটি যখন ফেরত দেয়, সে খাতার ভেতরে ফুটে থাকে সেই দিনের হোমওয়ার্ক এবং কোনও এক বুনোফুল। সুন্দরের সংজ্ঞা বলতে এটুকুই বুঝেছি।
কিন্তু এ-ও বুঝেছি, সুন্দর কী– তা নির্দেশ করে দেবে পুঁজির পৃথিবী। অর্থাৎ, যে নিজেকে পণ্যে পরিণত করল দ্রুত, যে পণ্য অতি সহজে বিক্রয়ক্ষম, আকর্ষণ করল জনমানস, যে পণ্যকে স্মার্টফোন সুন্দরের নিদান দিল– ইদানীং সুন্দর সে-ই। তাই খাসির মাংসের ঝরে ঝরে পড়াটা সুন্দর। উরফি জাভেদ সুন্দর। আর্ট গ্যালারির ৩০ সেকেন্ডের রিলও সুন্দর। এত সুন্দরের মাঝে অসুন্দর তবে ফিনিশ? কখনও না। ফুটপাথের গুমটি ভেঙে দেওয়ার পরে যে দুই কিশোরী হাউহাউ করে কাঁদল, মাথায় হাত বুলিয়ে দিল না কেউ, তখনই তৈরি হল রিল। হ্যাশট্যাগ ‘মানুষ বড় কাঁদছে’। এই অসুন্দর ইন্সটাগ্রামে ট্রেন্ডিং। এই অসুন্দর যেন আমাদের ভীষণ কাম্য। কারণ, এই অসুন্দরই আমাদের ভাইরাল করেছে।
কেনট্যাকি শহরের বেলারমাইন মিউজিয়াম অফ আর্ট। একটি চমৎকার গবেষণা করেছে সম্প্রতি। স্নাতকস্তরের একঝাঁক ছেলেমেয়েকে মিউজিয়ামে ছেড়ে দিয়েছিল। এক অংশের হাতে স্মার্টফোন। সেলফি তোলায় মত্ত। অন্য অংশের স্মার্টফোন নেই। পরবর্তীকালে, তথ্য অনুযায়ী, যে অংশের হাতে স্মার্টফোন ছিল না, আর্টের খুঁটিনাটি পর্যবেক্ষণ করেছে তারাই। যেহেতু তাদের চোখ এবং পেইন্টিং-এর আলাপচারিতায় কোনও ‘মাধ্যম’ ছিল না। যা দেখেছে, তা নিখাদ আর্ট। অথচ অন্যদের মনে ছিল অনিবার্য আকাঙ্ক্ষা। কেমন? আর্টের সঙ্গে ছবি তুলে হয়ে উঠতে হবে স্বয়ং ‘পিস অফ আর্ট’। ইন্সটাগ্রামে বেচে দেওয়ার লোভ। এ হল লোভের এ-আই ভার্সান।
……………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন রোদ্দুর মিত্রর লেখা: বিপক্ষের ডিফেন্স কিংবা বর্ণবাদ ছিঁড়ে ফুটবল শাসন করছেন নিকো উইলিয়ামস
……………………………………………………………………………………….
‘ক্লাসিক’ প্রসঙ্গে রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য দুরন্ত একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। বলছেন, “নিজেকে চেনা ও নিজের চারধারের মানুষ ও পরিবেশকে জানা– এই দুটো কাজেই পথ দেখায় ক্লাসিক। মনের অনেক আঁধার কোণে হঠাতই এসে পড়ে আলোর ঝলক। ‘আপন’ ও ‘পর’-কে মিলিয়ে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে গড়ে ওঠে এক সুসংহত উপলব্ধি…”
উপলব্ধির জন্য ভাবের প্রয়োজন। প্রয়োজন তলিয়ে যাওয়ার। দশ সেকেন্ডের রিলসের সে ক্ষমতা নেই। আর্ট গ্যালারি তাই পরিণত হত সেলফি জোনে। এস্থেটিক ব্যাকগ্রাউন্ড বলতে ভ্যান গঘের ছবি। দুর্গাপুজোর লাইনে দাঁড়াই। ক্যামেরা অন। ‘মা গো, প্রোমোশানটা এবার যেন হয়!’ সরাসরি বলা হয়ে ওঠে না। ক্যামেরা অন। ফোন মেমোরি হাঁপিয়ে ওঠে। চৌষট্টি। একশো আঠাশ। দুশো ছাপান্ন। দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটির কথা মনে পড়ছে। ‘এলএসডি টু’। প্রত্যেকের একেকটি মেটা-ইমেজ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ‘সদরে, বাজারে, আড়ালে’। অসুন্দর ধোপে টিকছে না। সুন্দরেরই রমরমা। তুরন্ত বেচতে হবে গ্রামে। ইন্সটাগ্রামে। এ-হল গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরে ফেলার স্বপ্নের এ-আই ভার্সান।
……………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………..