Robbar

‘ওদের’ কী একটা আছে তাই ছুটির ঘোষণা, অধিকাংশ হিন্দু মধ্যবিত্ত বাঙালিই প্রতিবেশীদের চেনে না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:February 13, 2025 9:57 pm
  • Updated:February 14, 2025 9:50 pm  

এই বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি যে, আমরা অন্য ধর্ম, জাতির আচার-আচরণ সম্বন্ধে এতটাই অজ্ঞ যে, অধিকাংশই জানার চেষ্টা অবধি করি না– প্রতিবেশী খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের অনুষ্ঠানগুলো কী বা কেন, ওই মানুষেরা এই অনুষ্ঠান পালন করেন? সেই জায়গা থেকেই গুড ফ্রাইডে, ইস্টার সানডে বা শবে-বরাত গড় মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিদের ছুঁতে পারে না বা বলা ভালো, তারাও ছুঁতে চায় না। সেই জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে যখন এই ধরনের দিনগুলোতে ‘ছুটি’ ঘোষণা করা হয়, তখন কেউ কেউ বলেন, ওই মুসলমানদের কী একটা অনুষ্ঠান আছে, তাই ছুটি দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেন, এই সরকার তো মুসলমানদের তোষণ করে, তাই ছুটি দিয়েছে।

সুমন সেনগুপ্ত

ক্রুশবিদ্ধ করার সময়ে যিশু নাকি বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর ওদের ক্ষমা করে দিও ওরা জানে না, ওরা কী ভুল করছে’। এই লেখা যদিও যিশুর বাণী বা খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারের জায়গা নয়, কিন্তু তাও কিছু কথা প্রাসঙ্গিক ভাবেই উঠে আসতে চায়। শোনা যায়, যিশু বলেছিলেন, ‘ঈশ্বরকে ভালবাসুন, মনপ্রাণ দিয়ে, সমস্ত শক্তি দিয়ে এবং এর পাশাপাশি নিজের প্রতিবেশীকে ভালবাসুন সমস্ত কিছু দিয়ে।’ তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ ছবির একটি গানের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ‘যদি বেহেস্তে যাইতে চাও গো, তবে প্রেম রাখিও অন্তরে’।

THE CLAY BIRD (MATIR MOINA) - South Asian Heritage Month
তারেক মাসুদ পরিচালিত ‘মাটির ময়না’ ছবির একটি দৃশ্য

অপরকে ভালোবাসার এই আর্তিটাই আসলে ঈশ্বরকে ভয় পাওয়ার বদলে মানুষকে অন্য চিন্তাজগতে নিয়ে যেতে পারে। এই বক্তব্যের সঙ্গে অনেকের দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু প্রতিবেশীকে ভালোবাসা– এই বিষয়টি নিয়ে আজকের এই অশান্ত সময়ে কারওর দ্বিমত থাকা উচিত নয়। এই বিপন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে বুঝতে পারি যে, আমরা অন্য ধর্ম, জাতির আচার-আচরণ সম্বন্ধে এতটাই অজ্ঞ যে, অধিকাংশই জানার চেষ্টা অবধি করি না– প্রতিবেশী খ্রিস্টান এবং মুসলমানদের অনুষ্ঠানগুলো কী বা কেন, ওই মানুষেরা এই অনুষ্ঠান কেন পালন করেন? সেই জায়গা থেকেই গুড ফ্রাইডে, ইস্টার সানডে বা শবে-বরাত গড় মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালিদের ছুঁতে পারে না বা বলা ভালো, তারাও ছুঁতে চায় না। সেই জন্যই সরকারের পক্ষ থেকে যখন এই ধরনের দিনগুলোতে ‘ছুটি’ ঘোষণা করা হয়, তখন কেউ কেউ বলেন, ওই মুসলমানদের কী একটা অনুষ্ঠান আছে, তাই ছুটি দেওয়া হয়েছে। কেউ বলেন, এই সরকার তো মুসলমানদের তোষণ করে, তাই ছুটি দিয়েছে!

হিজড়ি সনের শাবান মাসের ১৫ তারিখ রাতে পৃথিবীর সব মানুষের আগামী বছরের ভাগ্য লেখা হয় বলে মুসলমানরা বিশ্বাস করে। পরের বছর কে পৃথিবীতে জন্মাবে, আর কার মৃত্যু হবে– তা-ও এই রাতেই লেখা হয় বলে মুসলমানদের বিশ্বাস। মানুষের রুজিও এই রাতেই নির্ধারিত হয় বলে তাঁরা মনে করেন। এই রাতে মুসলমান মানুষদের কেউ কেউ আত্মীয়স্বজনদের কবরস্থান জিয়ারত করেন, মানে ভক্তি ভরে ওই কবরস্থানে জড়ো হন। কবরে প্রদীপ বা মোমবাতি জ্বালানোর চলও রয়েছে। কোনও কোনও কবরস্থানে আলোকসজ্জাও করা হয়। বাড়িতে বাড়িতে হালুয়া রুটি তৈরি করাও হয়। অনেকটা ‘হিন্দু’দের ভূতচতুর্দশীর মতো। ১৪ প্রদীপ দেওয়ার সঙ্গে হয়তো মিল খুঁজে পাওয়া যেতে পারে, গ্রামের ১৪টা জায়গায় প্রদীপ জ্বালানোর যে রেওয়াজ হিন্দু সমাজে আছে, যা আজকে বাড়ির চোদ্দটা কোনায় এসে ঠেকেছে, তার সঙ্গে এই রীতির বেশ কিছু মিল আছে। আমাদের পূর্বপুরুষদের আলো দেখানোর জন্য এই যে পদ্ধতি, তার সঙ্গে মিল আছে কিছুটা মুসলমানদের শবে বরাতের, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা জানার চেষ্টা অবধি করিনি এই বিষয়ে।

Kamal Haasan says Shah Rukh Khan worked in Hey Ram for free: I'm ever thankful to him | Bollywood - Hindustan Times
‘হে রাম’ সিনেমার দৃশ্যে শাহরুখ খান-কমল হাসান

আমরা ছুটি উপভোগ করেছি, কিন্তু জানার চেষ্টা করিনি ঈদুলফিতর এবং ঈদজ্জোহার তফাত কী? কোনটাতে কুরবানি হয়, কোনটাতে হয় না? অথচ আমরা পাশাপাশি বাস করেছি দীর্ঘদিন ধরে। আমাদের কোনও খ্রিস্টান কিংবা মুসলমান বন্ধু নেই। থাকলেও সেটা বেজায় কম। আমরা চিরকাল আমাদের স্বেচ্ছাবৃত্ত অজ্ঞতা দিয়ে অন্য ধর্মের মানুষদের দূরে সরিয়ে রেখেছি। সেখান থেকে তৈরি হয়েছে অবিশ্বাস আর তারপর বেড়েছে দূরত্ব। আর এই দূরত্বের ফোকর গলে ঢুকে পড়েছে ঘৃণা ও বিদ্বেষ। এই ঘৃণা ও বিদ্বেষ হয়তো অন্তর্নিহিত ছিল, কিন্তু এই অপরিচয় আমাদের মধ্যেকার পাঁচিলটাকে আরও পাকাপোক্ত করেছে, কেউ মনে করেন সমস্ত মুসলমান সন্ত্রাসবাদী, সমস্ত মুসলমান অন্তত ১৪টি সন্তানের পিতা! আবার কেউ মনে করেন সমস্ত খ্রিস্টান ধর্মীয় ভাবে প্রভাবিত করতে পারে এবং সমস্ত মুসলমান একদিন দেশের সমস্ত কিছু দখল করে নেবে। তাও খ্রিস্টানদের সম্পর্কে অতটা বিদ্বেষ না থাকলেও মুসলমানদের মনেই করা হয় সন্ত্রাসবাদী এবং সেই অনুযায়ী সমস্ত মুসলমানদের পিটিয়ে মারার পক্ষে সওয়ালও করা হয়!

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘কালান্তর’ গ্রন্থের ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে লিখেছিলেন, ‘ধর্মমত ও সমাজরীতির সম্বন্ধে শুধু প্রভেদ নয়, বিরুদ্ধতা আছে, এ কথা মানতেই হবে। অতএব আমাদের সাধনার বিষয় হচ্ছে, তৎসত্ত্বেও ভালো রকম করে মেলা চাই।’ কিন্তু আমরা কি সত্যিকারের মিশতে পারি বা বলা ভালো মিশতে চাই? এই না মেলামেশার ফলে দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বেড়েছে দূরত্ব এবং সেখান থেকে জন্ম নিয়েছে অভিমান। ব্যক্তিগত এমন বহু উদাহরণ দেওয়া যায়, যা থেকে প্রশ্ন উঠতে পারে, আমাদের এই না-জানাটা কি আমাদের শিক্ষার অভাবে না এর মধ্যেও কোনও আধিপত্যবাদী চিন্তাও আছে?

অন্য রাজ্যের কথা জানা নেই, কিন্তু হিন্দু বাঙালি মধ্যবিত্তের বেশ কিছু ধারণা আছে। যেমন কেউ মনে করেন একজন মুসলমান যদি কোনও জলের বোতল থেকে জল খান তারপর নাকি সেই বোতলে জল খাওয়া উচিত নয়, কারণ সেই বোতলে ওই মুসলমান মানুষটি তাঁর থুতু মিশিয়ে দেন। কেউ ভাবতেই পারেন এটা ‘বাড়িয়ে বলা’, কিন্তু এই ধারণা অনেক মানুষের মনে বদ্ধমূল হয়ে আছে, কিন্তু কোথা থেকে এই ধারণার উৎপত্তি, জানা নেই। একটা কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। ইদানীং যুক্ত হয়েছে দেশের শাসক দলের তরফ থেকে পরিকল্পিত মিথ্যাচার, যা রোজ হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে ছড়ানো হয়। অনেকে ভাবেন মুসলমান মানেই তাঁরা পাকিস্তানের সমর্থক, তাঁদের শুধু তোষণ করা হয় এবং তাঁরা সুবিধা ভোগ করেন। অথচ মধ্যবিত্ত হিন্দু বাঙালি এটা কক্ষনও ভাবে না তাঁর এই ভুল ধারণা পাশের মুসলমান মানুষটিকে আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে। মুসলমান মানুষের সঙ্গে মিশতে গিয়ে বারবার দেখা গেছে যে, তাঁরা কিন্তু চিরকাল বঞ্চনারই শিকার। যদি ৭০ বছর ধরে তোষণই হত তাহলে কি আজও প্রতিবেশীকে চিনুন বা পড়শির সঙ্গে অনুষ্ঠানগুলো করতে হত? এই মুহূর্তে দেশের যা অবস্থা সেখানে বড় বড় রাজনৈতিক সভা সমাবেশ কতটা হিন্দু- মুসলমান-খ্রিস্টানদের কাছাকাছি আনতে পারবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। তার পাশাপাশি যদি এই ধরনের ছোট ছোট উদ্যোগ নেওয়া যায় তাহলে হয়তো দূরত্ব কিছুটা কমতে পারে।

Sad that 'My Name Is Khan' is still relevant: SRK
মাই নেম ইজ খান-এ শাহরুখ খান

উড়িষ্যার কেওনঝড়ে আদিবাসীদের মধ্যে কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষদের সেবা করতেন কাজ করতেন গ্রাহাম স্টুয়ারট স্টাইন্স। বজরং দলের কর্মীরা মনে করেছিলেন যে, এই মানুষটি ধর্মান্তর করাচ্ছেন! তাই তাঁকে তাঁর দুই নাবালক পুত্র-সমেত জ্বালিয়ে দেওয়া হয় জীবন্ত। তারপর কবীর সুমনের কলমে বেরিয়েছিল একটি গান, যা আজকেও হয়তো সমান প্রাসঙ্গিক।

‘ঐ তো মানুষ ধর্মের কথা বলছে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ জ্বলছে,
কেওনঝাড়ের আদিবাসীদের গ্রামে
বজরঙ্গদল মানুষ পোড়াতে নামে।
ঐ তো কেমন ধর্মের ধ্বজা উড়ে
আগুনে তিনটি মানুষের দেহ পোড়ে,
হাতের সঙ্গে দুই নাবালক ছেলে
ঐ তো মানুষ ধর্মের কথা বলছে
বজরঙ্গদল দিয়েছে আগুন জ্বেলে।
ঐ তো কেমন ধর্মের ভগ্নাংশ
গন্ধ ছড়ায় মানুষের পোড়া মাংস,
পুড়ছে ছেলেরা পুড়ছে তাদের বাপ
ধর্ম নিচ্ছে বেধর্মীদের মাপ।
ঐ তো কেমন ধর্মের খাঁটি দর্শন
সহজেই হয় ধর্মযাজিকা ধর্ষণ,
কে ছিল হিন্দু কে হল খ্রিষ্টান
কে হল বৌদ্ধ কে হল মুসলমান।
ঐ তো কেমন ঘৃণার ঘৃণ্য আইন
শহীদ হলেন গ্রাহাম স্টুয়ার্ট স্টাইন্স,
থেকেছেন তিনি কুষ্ঠ রোগীর পাশে
তাঁর ধর্মটা মানুষকে ভালোবাসে।
আমার ধর্ম তোমায় জানিয়ে যাই
গানের দিব্যি আমি প্রতিশোধ চাই,
আমার বোধের হাতিয়ারে সান দিয়ে
পুড়ছি আমিও তোমায় সঙ্গে নিয়ে।’

এই লেখাটা যখন প্রায় শেষের পর্যায়ে, তখন আমার কন্যা আমার সঙ্গে কথা বলতে এল। তারপর কী কথা প্রসঙ্গে বলল ‘বাবা, আমার স্কুলের এক বন্ধু ওয়ালিউল্লা, ও তো বাংলাদেশি।’ আমি বললাম, ‘বাংলাদেশি কেন হবে? ও তো ভারতীয় ও তো তোমার সঙ্গে পড়ে।’ বলল, ‘না, ও কীরকম ভাবে কথা বলে জানো? ও বলে মিস আমার টয়লেট লেগেছে।’ আমি বললাম, ‘তাতে কী ও যেভাবে বাড়িতে কথা শোনে সেভাবেই বলে, এর মানে কি ও বাংলাদেশি হয়ে গেল?’ আসলে মানুষের কথা বলার ধরন দেখে আমরা তাঁদের দাগিয়ে দিয়ে থাকি।

আমার মেয়ের বয়স ১৩, ওর দেশ সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। ও কাঁটাতার জানে না, ও ভারতীয় বা বাংলাদেশির তফাত বোঝে না, কিন্তু এই ধারণা কোথা থেকে পেল? নিশ্চিত ওর অন্য কোনও বন্ধু বলেছে যে, তাঁর বাড়িতে শুনেছে। যে বাবা কিংবা মায়েরা এই কাজটা জেনে হোক না জেনে এই কাজটা করলেন তাঁরা কি অজান্তে দেশের পরিবর্তে দ্বেষ ঢেলে দিলেন না? সুতরাং, শিক্ষা শুরু হোক বাড়িতে। তথ্য এবং অপতথ্যের ফারাক করতে শিখি আমরা। মুসলমান প্রতিবেশীদের সম্পর্কে একটু জানার চেষ্টা করি আমরা, বড়রা, যাতে আমাদের পরিবারের শিশুদের একটা নতুন পৃথিবী দিয়ে যেতে পারি আমরা।

……………………………………

ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল

……………………………………