দশদিনের ভারী স্কুলব্যাগের ওজন রেহাই এবং একার্থে পাঠ্যবই থেকে মুক্তি কি আদতে কোনও সুরাহা দেবে পড়ুয়াদের মানসিক বা শারীরিক চাপের? শিক্ষা-শিকলের যে কঠিন বাঁধনে তাদের বেঁধে ফেলা হচ্ছে, তা থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ কি এই পরিকল্পনায় লুকিয়ে কোথাও? হয়তো সময় বলবে। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, যে জটিল বিধি-ব্যবস্থার দিকে শিক্ষানীতি এগোচ্ছে, তাকে পরিমার্জন বা সংস্কারের পথ না খুঁজলে সমস্যা বরং বাড়বে। একটা ব্যাগের ওজন হয়তো শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে, ধ্বস্ত করে পড়ুয়াদের, কিন্তু ছদ্মবেশী ছুটির চক্করে পড়লে, তারা কি আরও ক্লান্ত হবে না?
প্রচ্ছদ শিল্পী: সোমোশ্রী দাস
খুদে আঙুল দুঁদে সিলেবাস কী করে সামলাবে? শুধু কি পাঠ্যক্রম ছাই! তার পাশাপাশি সংস্কৃতিবান হয়ে ওঠারও কি কম চাপ? ছবি আঁকো, গান শেখো, আবৃত্তি করো, নাচ করো। পারলে সাঁতার, জুডো, কুংফু ইত্যাদি ইত্যাদি। আত্মীয়স্বজন এলে, সে যত দূর সম্পর্কেরই হোক, যেন তারা ট্যালেন্ট হান্টের অবৈতনিক বিচারক– খুদেদের দেখাতেই হবে প্রতিভার প্রদর্শনী। মোট কথা, গায়ে-গতরে বড় হওয়ার আগে পর্যন্ত ‘শৈশব’ নামক যে বস্তুটি ছিল, তা ডিলিট করে দেওয়ার এক মস্ত বেআক্কেলে পদ্ধতি সমাজে এসে জুটেছে অনেক কাল হল। এগুলোকেই ওয়াইটুকে নাগাদ লোকজন ‘ইঁদুর দৌড়’, তাপ্পর ‘কম্পিটিশনের মার্কেট’– এইরকম নানা বিশেষণে ভূষিত করেছে। কিন্তু তার ফলে পড়ুয়াদের ওপর থেকে চাপ কিছু কমেনি।
এখানে বলে নেওয়া ভালো, চাপ দু’-প্রকার– মানসিক ও শারীরিক। সম্প্রতি এই শারীরিক চাপের ব্যাপারটা নজরে এসেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ব্যাগের ওজন সম্পর্কে তারা তৎপর হয়ে ওজনহিতকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ নাগাদ কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ক্লাসপিছু ব্যাগেও ওজন নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু তা কি যথেষ্ট মান্য করা হয়নি? নতুবা, আবারও এই নির্দেশ কেন? শিক্ষামন্ত্রকের পক্ষ থেকে স্কুলগুলিতে ব্যাগ-বিহীন দিবসের নির্দেশিকা এসে পড়েছে। কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে যে, পড়ুয়াদের মূলত অ্যাক্টিভিটি বেসড্ লার্নিংয়ের দিকে উৎসাহী করে তুলতেই এই প্রয়াস। বলা হয়েছে, ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়ুয়াদের শিক্ষাবর্ষের মোট ১০ দিন ব্যাগ নিয়ে স্কুলে আসতে হবে না। প্রস্তাবটি প্রাথমিকভাবে শুনতে মন্দ নয়। কিন্তু তা কতটা বাস্তবে সম্ভব, তাও বুঝতে হবে। ব্যাগে তো শুধুই বইপত্র থাকে এমন না, থাকে জলের বোতল, টিফিন বাক্স ও টুকিটাকি নানা জিনিস। সেগুলোর বহনপদ্ধতি বিষয়ে কি কেন্দ্র নির্দেশ দিয়েছে কোনও? যদি কেউ স্বেচ্ছায় মনে করে, ব্যাগের ওজনে সেই পড়ুয়া আদৌ বিব্রত নয়, সেক্ষেত্রে তার প্রতি কি এই নিয়ম বলবৎ হবে না হবে না?
স্কুলের শিক্ষাবর্ষে মোটামুটি ২৪৮ থেকে ২৫০ দিন ধার্য করা থাকে। কেন্দ্রের নয়া নির্দেশিকা অনুযায়ী, দিনগুলির মধ্যে নির্ধারিত ১০টি দিন পড়ুয়ারা ব্যাগ ছাড়া স্কুলে যেতে পারবে। ওই নির্দিষ্ট ১০ দিনে পড়ুয়াদের খেলাধুলা, ক্যুইজ, শিক্ষামূলক ভ্রমণ, তাৎক্ষণিক বক্তৃতা, জীবনশৈলী, পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়গুলির সঙ্গে একাত্ম করে তোলার চেষ্টা করা হবে। এর ফলে পড়ুয়ারা মুক্তশিক্ষার প্রতি অধিকতর আগ্রহী হবে এবং তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটবে। কিন্তু এই সৃজনশীল হয়ে ওঠার যে বাড়ি-ইশকুলবাড়ির যৌথ চাপ, তা কি মনের ভেতর বড় ভারী হয়ে বসছে না– এ-ও খানিক ভাবা দরকার। রুটিন মেনে পরিবেশের সঙ্গে যে একাত্মতাবোধ কি তৈরি করা সম্ভব? আমাদের কাছে উদাহরণ হিসেবে তো রবীন্দ্রনাথ রয়েইছেন, যিনি শিক্ষাই দিতে চেয়েছেন প্রকৃতির ভেতর, একাত্ম হয়েই, বিচ্ছিন্ন না হয়ে।
ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রের মানচিত্র বিগত দুই-আড়াই দশকে আমূল বদলে গিয়েছে। নরসিমা রাও সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহের হাত ধরে এদেশে উদার অর্থনীতি আসার এক দশকের মধ্যেই ঠাওরানো গিয়েছিল, শিক্ষাক্ষেত্রগুলি হয়ে উঠতে পারে পুঁজিপতিদের কাছে বেজায় লাভজনক একটি ব্যবসা! সেই পথেই ক্রমে কলকাতা-বৃহত্তর কলকাতা এবং ছোট-বড় মফস্সল শহরে গজিয়ে উঠতে থাকে অসংখ্য ইংরেজি মাধ্যম স্কুল। এখন মফস্সল ছাড়িয়ে বাংলার প্রায় প্রতিটি জেলার গ্রামগঞ্জেও ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে ছাত্র ভর্তির চাহিদা তুঙ্গে! ফলে ছাত্রভর্তির প্রতিযোগিতা যত এগিয়েছে, পাল্লা দিয়ে বেড়েছে স্কুল-পড়ুয়াদের ওপর সিলেবাসের দাপট ও তৎসহ নম্বর আঁকড়ানোর চাপ। ‘টার্গেট ওরিয়েন্টেড’ পড়াশোনা হলেও সিলেবাসে বেড়েছে বইয়ের সংখ্যা। শুধু বই নয়, প্রতি অর্ধে এসেছে প্রকল্পপত্রও। যার দরুণও স্কুলব্যাগে ওজন বেড়েছে। এসেছে অজস্র বই, হোমওয়ার্কের খাতা– ব্যাগের পেট হয়েছে স্থূল।
………………………………………………
চাপ দু’-প্রকার– মানসিক ও শারীরিক। সম্প্রতি এই শারীরিক চাপের ব্যাপারটা নজরে এসেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। ব্যাগের ওজন সম্পর্কে তারা তৎপর হয়ে ওজনহিতকর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ নাগাদ কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক ক্লাসপিছু ব্যাগেও ওজন নির্দিষ্ট করে দিয়েছিল। কিন্তু তা কি যথেষ্ট মান্য করা হয়নি? নতুবা, আবারও এই নির্দেশ কেন? শিক্ষামন্ত্রকের পক্ষ থেকে স্কুলগুলিতে ব্যাগ-বিহীন দিবসের নির্দেশিকা এসে পড়েছে। কেন্দ্রের তরফে জানানো হয়েছে যে, পড়ুয়াদের মূলত অ্যাক্টিভিটি বেসড্ লার্নিংয়ের দিকে উৎসাহী করে তুলতেই এই প্রয়াস।
……………………………………………..
স্কুল ব্যাগের এই ঊর্ধ্বমুখী ওজন কিন্তু শুধুই একটি ক্রমবর্ধমান সংখ্যা নয়। বেসরকারি স্কুলগুলির শিক্ষানীতির নেপথ্যে একটি বড়সড় ভূমিকা রয়েছে নাগরিক রুচি এবং অবশ্যই রয়েছে লগ্নিকারী পুঁজিপতির মুনাফার প্রশ্ন। ফলে পুঁজির সঙ্গে একটি আপসকামিতার শর্তও তৈরি হয়ে গিয়েছে স্কুলের পরিবেশ ও অভ্যন্তরীণ পঠনপাঠনে। পড়াশোনার বহর যতখানি, তার থেকেও বেড়েছে দেখনদারি। শহরের বেশিরভাগ বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলি থেকেই পড়ুয়াদের সিলেবাসের বইখাতার পাশাপাশি ইউনিফর্ম এবং পড়াশোনার হরেক উপকরণ কিনতে হয়। ফলত, কিছুটা নিরুপায় হয়ে এবং ব্যবস্থাতন্ত্র অক্ষুণ্ণ রাখতে পড়ুয়াদের সেই সমস্ত সামগ্রী নিয়ে স্কুলে আসতে বাধ্য করা হয়। ওজনের ব্যাপারে আপত্তি তুললে, এই ব্যবস্থা কি আদৌ কোনও প্রশ্নের মুখে পড়বে?
……………………………………………….
আরও পড়ুন বিশ্বজিৎ রায়-এর লেখা: একদিকে বই পোড়ানোর হুকুম, অন্যদিকে নিভৃত গ্রামে খুলে যায় বইয়ের ঘর
……………………………………………….
মাত্র দশদিনের ভারী স্কুলব্যাগের ওজন রেহাই এবং একার্থে পাঠ্যবই থেকে মুক্তি কি আদতে কোনও সুরাহা দেবে পড়ুয়াদের মানসিক বা শারীরিক চাপের? শিক্ষা-শিকলের যে কঠিন বাঁধনে তাদের বেঁধে ফেলা হচ্ছে, তা থেকে নিস্তার পাওয়ার পথ কি এই পরিকল্পনায় লুকিয়ে কোথাও? হয়তো সময় বলবে। কিন্তু একটা ব্যাপার স্পষ্ট যে, যে জটিল বিধি-ব্যবস্থার দিকে শিক্ষানীতি এগোচ্ছে, তাকে পরিমার্জন বা সংস্কারের পথ না খুঁজলে সমস্যা বরং বাড়বে। একটা ব্যাগের ওজন হয়তো শারীরিকভাবে ক্লান্ত করে, ধ্বস্ত করে পড়ুয়াদের, কিন্তু ছদ্মবেশী ছুটির চক্করে পড়লে, তারা কি আরও ক্লান্ত হবে না? ইঁদুর দৌড়ের প্রস্তুতির জন্য আরেকরকম ছল নয়, সত্যিকারের বিরতি পাক পড়ুয়ারা। যে বিরতিতে আলাদা আলাদা করে তারা যেন গুরুত্ব পায়, সময় পায় খানিক শ্বাস নেওয়ার, ঘাসের ওপর শুয়ে অসীমে তাকিয়ে থাকার জন্য যে অপরূপ সময় নষ্ট, সে জন্য যেন তাদের নির্বিচারে ক্ষমা করা হয়।
.………………………………………….
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার.ইন
…………………………………………..
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved