Robbar

ক্ষতবিক্ষত ‘ছায়ানট’-এর সঞ্জীবনী হতে পারে রবীন্দ্রনাথের গানই

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 22, 2025 5:26 pm
  • Updated:December 22, 2025 7:36 pm  
India bangladesh cultural relation and chhayanaut

১৯৬১-তে রবীন্দ্র শতবর্ষে যখন শান্তিনিকেতন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনে ব্যস্ত তখন আরোপিত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি-হৃদয় ভাষা আন্দোলনের পর সংগঠিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলল ‘ছায়ানট’, বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এই সংগঠনের কাজ সহজ ছিল না, ছিল অপরাশক্তির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও চেতনার পরিবেশ গড়ে তোলার দুর্নিবার প্রয়াস। তাই ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা কীভাবে সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যায়, তার অন্যতম পথিকৃৎ ছিল ‘ছায়ানট’। 

মানস বন্দ্যোপাধ্যায়

অসুর-শাসিত ছায়ানটের বিপর্যস্ত ভবন থেকে বলছি না, বলছি সুরের শান্তিনিকেতন থেকে, যার সঙ্গে ছায়ানটের ছিল অচ্ছেদ্য বন্ধন।

১৯৬১-তে রবীন্দ্র-শতবর্ষে যখন শান্তিনিকেতন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদনে ব্যস্ত, তখন আরোপিত পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি-হৃদয় ভাষা আন্দোলনের পর সংগঠিত প্রচেষ্টায় গড়ে তুলল ‘ছায়ানট’, বাঙালির সংস্কৃতি চর্চার প্রাণকেন্দ্র। এই সংগঠনের কাজ সহজ ছিল না, ছিল অপরাশক্তির বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও চেতনার পরিবেশ গড়ে তোলার দুর্নিবার প্রয়াস।

ছায়ানটের সূচনা দিবস, ১৯৬১

 

সেদিন দেশজননী বেগম সুফিয়া কামালের সভা নেতৃত্বে গড়ে উঠল ‘ছায়ানট’, যার সদস্য ছিলেন মোখলেসুর রহমান সিধু, ওয়াহিদুল হক, জহুর হোসেন চৌধুরী, সাইদুল হাসান, সন্‌জীদা খাতুন, কলিম শরাফী প্রমুখ। প্রথম সম্পাদক ফরিদা হাসান।

ভাষা আন্দোলনের তীব্রতা কীভাবে সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষের মধ্যে দিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপান্তরিত করা যায়, তার অন্যতম পথিকৃৎ ‘ছায়ানট’। রবীন্দ্রনাথকে সমগ্র বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার যে প্রচেষ্টা পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল, তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের গানই হয়ে উঠল ‘ছায়ানট’-এর আয়ুধ। বাংলাদেশের সাংবাদিকতার পুরোধাপুরুষ ওয়াহিদুল হক চারণের মতো বাংলাদেশের জেলায় জেলায় রবীন্দ্রনাথের গানের প্রচারে নামলেন; আর তাঁর স্ত্রী সন্‌জীদা খাতুন বাংলা ভাষা সাহিত্যের অধ্যাপনার পাশাপাশি ছায়ানট সংগীত বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষের ভার গ্রহণ করলেন। তারপর ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এল স্বাধীনতা। ‘ছায়ানট’ দায়িত্ব গ্রহণ করল দেশের সংস্কৃতি চেতনাকে আরও প্রদীপ্ত করার।

সন্‌জীদা খাতুন, তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ঘটল আটের দশকে শান্তিনিকেতনে, তখন তিনি তাঁর ‘ধ্বনি থেকে কবিতা’ গবেষণামূলক গ্রন্থটি রচনায় মগ্ন ছিলেন। লক্ষ করলাম, তাঁকে ঘিরে বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগতের সকল মানুষের আসা-যাওয়া এবং ছায়ানটের সকল কার্যক্রমের যোগসূত্র বজায় রাখা। আমারও পরিচয় ঘটতে থাকল বিশিষ্ট মানুষজনের সঙ্গে। দু’বছর পরে বেগম সুফিয়া কামাল শান্তিনিকেতনে এলেন, তাঁকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিপত্র রবীন্দ্রভবনে জমা দিতে। মহীয়সী সেই নারীর সান্নিধ্য পেলাম। ওয়াহিদুল হক, জামিল চৌধুরী, পাপিয়া সারোয়ার, অজিত রায় এবং সন্‌জীদা খাতুনের পরিবারের সকল সদস্যের সঙ্গে আত্মিক পরিচয় ঘটল।

ছায়ানটে আক্রান্ত ও বিক্ষত সনজীদা খাতুনের ছবি, সূত্র: টাইমস অফ বাংলাদেশ

১৯৮৭ সালে সন্‌জীদা খাতুন ছায়ানটের দল নিয়ে শান্তিনিকেতনে এলেন বসন্তোৎসবের সময়। তাঁরা একটি অনুষ্ঠান করতে চান কিন্তু কোনও স্থান সংকুলান হচ্ছে না। কলকাতা থেকে মাসিমা দায়িত্ব দিলেন আমাকে। তৎকালীন কলাভবনের অধ্যক্ষ সনৎ করের কাছে আবেদন রাখতেই কলাভবনের চাতালে মুক্তমঞ্চে হল তাঁদের অপূর্ব অনুষ্ঠান। কে ছিলেন না সেই দলে! ফাহমিদা খাতুন, রেজওয়ানা চৌধুরী, সেলিনা মালেক, অঞ্জলি রায়, আব্দুল ওদুদ, খাইরুল আনাম শাকিল– তাঁরা তাঁদের সংগীতের শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করলেন অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে।

ছায়ানট, দুষ্কৃতিদের হামলার পর। সূত্র: টাইমস অফ বাংলাদেশ

১৯৮৮ সালে ডিসেম্বর মাসে গেলাম ঢাকায়। বেশ মনে আছে, শুক্রবারের ভোরবেলা ওয়াহিদুল হকের সঙ্গে রিকশায় চড়ে চলেছি কণ্ঠশীলনের ক্লাসে। সমগ্র বাংলাদেশের নানা জেলা থেকে ছাত্রছাত্রীরা রাতের ট্রেনে ঢাকায় আসে শুদ্ধভাবে বাংলা ভাষায় উচ্চারণ শেখার জন্য। অভিভূত হলাম সেই প্রচেষ্টা দেখে। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন মিলনায়তনে তৎকালীন ছায়ানট ভবনে। প্রতিটি ক্লাসরুমে নিষ্ঠার সঙ্গে শেখানো হচ্ছে রবীন্দ্র সংগীত, নজরুল সংগীত, অতুলপ্রসাদ, রজনীকান্তের গান এবং লোকসংগীত। বিস্ময় আর উত্তেজনা অনুভব করলাম, বাংলা ভাষা আর সংগীত-চর্চার এমন অসাধারণ উদ্যোগ দেখে। সেদিনের সেই উপলব্ধি আজও বুকে ধরে রেখেছি।

ওয়াহিদুল হক এবং সনজীদা খাতুন, ১৯৬৬

বেশ মনে পড়ে, সন্‌জীদা খাতুন তখন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সংগীতের স্বরলিপির ওপর গবেষণা করছেন। এই শতাব্দীর প্রথম দশক। পয়লা বৈশাখ রমনার বটমূলে ছায়ানটের ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠানের সময় বোমা বিস্ফোরণ ঘটল। হতাহতের সংখ্যা সামান্য হলেও সেই আঘাতের বিরুদ্ধে শান্তিনিকেতন সরব হল, সেদিন দেখেছিলাম সন্‌জীদা খাতুনের প্রতিবাদী সত্তার স্বরূপ।

২০০১ সাল থেকে ছায়ানটের সভানেত্রী রূপে যেমন তাঁর সংগীত-শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়গুলি তুলে দিয়েছেন ছাত্রছাত্রীদের হাতে, তেমনই গড়ে তুলেছেন নালন্দা স্কুল। বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতির যথার্থ স্বরূপটি উৎঘাটিত করতে চেয়েছেন ছায়ানটের প্রেক্ষাপটে।

রমনা বটবৃক্ষমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান

২০১২ সালে বিশ্বভারতী সন্‌জীদা খাতুনের সামগ্রিক অবদানের জন্য তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ সম্মানে ভূষিত করে। সেবার তাঁর সঙ্গে এলেন ছায়ানটের ৩০ জন সদস্য। দেশিকোত্তম গ্রহণের আগের সন্ধেয় আমাদের চতুর্দশী সাহিত্য সভায় ছায়ানটের শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করে আমাদের হার্দিক বন্ধনকে দৃঢ় করলেন। শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের নিরন্তর আসা-যাওয়া পাঠগ্রহণ দুই বাংলার মধ্যে সেতু রচনা করে আসছে নিরন্তর। ছায়ানটের সঙ্গে প্রতিনিয়তই সেই বিনিময় ও বন্ধন অটুট রয়েছে। কারণ, আমরা রবীন্দ্রনাথকে আমাদের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ও মানবতার বটবৃক্ষ রূপে জানি।

ছায়ানট ভবনে ঘটে যাওয়া হামলা ও ন্যক্কারজনকভাবে সব ভাঙচুর করার মধ্যে রয়েছে বিদ্বেষী ও উৎশৃঙ্খল মানুষের বর্বরতা। শান্তিনিকেতন এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়।