ভোটের আগে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে আরও জোরদার করার কাজে মন না দিয়ে রাহুল কেন মণিপুর থেকে ভারত জোড়ার যাত্রা করছেন, এই প্রশ্ন যাঁরা করেছিলেন, তাঁরাই এখন সেই যাত্রার গুণগান করছেন। কর্নাটকে কেন কংগ্রেসের ফল আরও ভাল হল না, সেই প্রশ্ন উঠছে না। বিজেপির সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য ৭০ শতাংশ, অখিলেশের সাফল্য প্রায় ৬০ শতাংশ সেখানে কংগ্রেস এবারও দাঁড়িয়ে মাত্র ২৪ শতাংশে। কেন কংগ্রেস রাহুলের নেতৃত্বে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতা-অখিলেশদের সাফল্যের ধারেকাছে নেই, সেই প্রশ্ন তোলার বালাইও নেই।
আসন সংখ্যা ১০০ পার না করতে পেরেও দিল্লিতে দলের সদর দপ্তরে গণনার দিন কার্যত বিজয়োৎসব সেরে ফেলল কংগ্রেস। শামিয়ানা খাটিয়ে ঢাক-ঢোল পেটানো হল। উড়ল সবুজ আবির। নেতারা লাড্ডু বিলি করলেন। এবারের ঐতিহাসিক লোকসভা ভোটের পরিসমাপ্তি ঘটল রাজধানীকে এইরকম ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী রেখেই। আসলে পরপর তিনটি লোকসভা নির্বাচনে ১০০ পার না করতে পারার গ্লানি আড়াল করতে দেশের ‘গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি’র এছাড়া কিছু করারও ছিল না। আগের দু’টি লোকসভা ভোটের পর আমরা দেখেছি ফল প্রকাশের দিন বিকেলে ১০ জনপথ থেকে মাথা নিচু করা রাহুলকে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন সোনিয়া গান্ধী। ওই দৃশ্যের কিছুতেই আর হ্যাটট্রিক চাইছিলেন না রাহুলের প্রচার ম্যানেজাররা। তাই ৪৪ থেকে ৫২ হয়ে এবার কংগ্রেস ৯৯-তে পৌঁছতেই জয়ের ‘মাহোল’ তৈরি করা হল এআইসিসি দপ্তরে। তৃতীয় বারেও কেন রাহুল কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন জোটকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা এনে দিতে পারলেন না, সেই প্রশ্ন তোলার সুযোগই দেওয়া হল না। গত এক দশকে ‘অপটিক্স’ তৈরির লড়াইয়ে এই প্রথমবার সম্ভবত রাহুলের কাছে গোহারা হারলেন নরেন্দ্র মোদি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বিকেলে যখন রাহুল সোনিয়াকে পাশে বসিয়ে সংবিধান হাতে নিয়ে দৃপ্ত সাংবাদিক বৈঠক করছেন, তখন মোদির নৈতিক পরাজয়ের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিতে এই দ্রুত ধারণা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাতে মোদি যখন পাল্টা বিজেপির দপ্তরে গিয়ে বলছেন যে কংগ্রেস ও তার জোট সঙ্গীদের আসন সংখ্যা বিজেপির আসন সংখ্যাকে ছাড়াতে পারেনি, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। যে বার্তা মানুষের কাছে চলে যাওয়ার তা চলে গিয়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সংখ্যা যে কথাই বলুক না কেন, লোকসভা ভোটে যে মোদির পরাজয় হয়েছে, এই ধারণাটা বিশ্বের দরবারে দ্রুত পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে রাহুল ব্রিগেড। একদিকে কংগ্রেস সদর দপ্তরে সাত সকাল থেকে ঢাক-ঢোল-কাড়া-নাকাড়ার আওয়াজ, অন্যদিকে বেলা সামান্য গড়াতেই মোদির ইস্তফা চেয়ে জয়রাম রমেশের টুইট। বিকেলে যখন রাহুল সোনিয়াকে পাশে বসিয়ে সংবিধান হাতে নিয়ে দৃপ্ত সাংবাদিক বৈঠক করছেন, তখন মোদির নৈতিক পরাজয়ের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠিত। রাজনীতিতে এই দ্রুত ধারণা প্রতিষ্ঠা করে দেওয়ার কাজটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাতে মোদি যখন পাল্টা বিজেপির দপ্তরে গিয়ে বলছেন যে কংগ্রেস ও তার জোট সঙ্গীদের আসন সংখ্যা বিজেপির আসন সংখ্যাকে ছাড়াতে পারেনি, তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। যে বার্তা মানুষের কাছে চলে যাওয়ার তা চলে গিয়েছে। ‘চারশো পার’ স্লোগান দিয়ে মোদি বিরোধীদের বিপাকে ফেলেছিলেন। ফল বেরনোর পর ঠিক উল্টোটা হল। দ্রুত মোদির পরাজয় ঘোষণা করে ও ইস্তফা চেয়ে রাহুলরা বিজেপিকে বিপাকে ফেললেন এবং নিজেদের হারের হ্যাটট্রিকের পরেও দলে প্রশ্ন তোলার সুযোগ দিলেন না।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: রাজনৈতিক ইস্তাহারে পরিবেশ কেন ব্রাত্য?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কংগ্রেস ১০০ পার না করলেও জয়রাম রমেশদের কৌশলী চালে এতদিনে মনে হয় জনমানসেও রাহুলের নেতৃত্বও কিছুটা প্রতিষ্ঠা পেল। রাহুল বন্দনায় মাততে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের কুখ্যাত ‘জি ২৩’ গোষ্ঠীর নেতাদেরও। ভোটের আগে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে আরও জোরদার করার কাজে মন না দিয়ে রাহুল কেন মণিপুর থেকে ভারত জোড়ার যাত্রা করছেন, এই প্রশ্ন যাঁরা করেছিলেন, তাঁরাই এখন সেই যাত্রার গুণগান করছেন। কর্নাটকে কেন কংগ্রেসের ফল আরও ভালো হল না, সেই প্রশ্ন উঠছে না। মধ্যপ্রদেশে, হিমাচল প্রদেশে কংগ্রেসের সাফ হয়ে যাওয়ার কারণ খোঁজা হচ্ছে না। মহারাষ্ট্রে ১৩টা, রাজস্থানে আট-নটা, কেরল ও তামিলনাড়ুতে গতবারের ফল ধরে রাখা, উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ যাদবের কাঁধে চেপে ছ’টা আসন ও মণিপুরে দু’টি আসন জেতা ছাড়া বলার মতো সাফল্য কংগ্রেসের কিছু নেই। বিজেপির সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে যেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাফল্য ৭০ শতাংশ, অখিলেশের সাফল্য প্রায় ৬০ শতাংশ সেখানে কংগ্রেস এবারও দাঁড়িয়ে মাত্র ২৪ শতাংশে। মোদির বিরুদ্ধে দেশবাসীর এত ক্ষোভের পরেও কেন কংগ্রেস রাহুলের নেতৃত্বে বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে মমতা-অখিলেশদের সাফল্যের ধারেকাছে নেই, সেই প্রশ্ন তোলার বালাইও নেই।
তবে লোকসভায় কংগ্রেস এবার বিরোধী দলনেতার পদ পাবে। ওই পদে রাহুলই যাবেন বলে ধরে নেওয়া যায়। গত এক দশক সরকারিভাবে বিরোধী দলনেতা কেউ ছিলেন না। বিরোধী দলনেতা হিসেবে রাহুলের দায়িত্ব অনেক বাড়বে। সংসদ পরিচালনায় তাঁর ভূমিকা থাকবে। বিভিন্ন কমিটিতে তাঁকে যেতে হবে। সোজা কথায় বিকল্প প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজেকে মেলে ধরার বিরাট সুযোগ তাঁর সামনে। প্রবীণ কংগ্রেস নেতাদের কৌশলী চালে হারের হ্যাটট্রিকের পরেও রাহুল তাঁর নেতৃত্বকে এতদিন বাদে এক প্রশ্নহীন উচ্চতায় দাঁড় করাতে পেরেছেন। এবার কি তিনি সংসদীয় কাজে সিরিয়াস হবেন? উঠছে সেই প্রশ্ন।
পৃথিবী জুড়ে সংবাদমাধ্যম লিখছে, জিতলেও মোদির কর্তৃত্ব খর্ব। ওয়াশিংটন পোস্ট লিখেছে, ভারতীয় ভোটাররা মোদিকে বকে দিয়েছেন। গণদেবতার এই রোষকে কি মাটি কামড়ে পড়ে থেকে রাহুল কংগ্রেসের পুনর্জাগরণের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন? ভারত মানে মোদি, মোদি মানে ভারত– সঙ্ঘ পরিবারের এই ‘ইমেজ’ তৈরির প্রয়াসকে ধাক্কা দিয়েছেন ভারতবাসী। কিন্তু ভারতীয় রাজনীতিতে মোদি যুগের অবসান ঘটেছে বলার সময় এখনও আসেনি। মোদির নৈতিক পরাজয়কে রাজনৈতিক পরাজয়ে পর্যবসিত করার লড়াই সবে শুরু বলা যায়। এই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে রাহুল কতটা আন্তরিক এবং যোগ্য, এবার পালা সেটা প্রমাণের।
রাহুলের ‘মোহব্বত কি দুকান’ যে আপাতত বিপন্মুক্ত সেটা ঠিক। কিন্তু ঘন ঘন বিদেশ যাওয়া বন্ধ রেখে গোটা দেশ ঘুরে ঘুরে এর বিক্রিবাটা আরও বাড়ানোর কৌশল তিনি সঠিকভাবে নিতে পারেন কি না, এবার তার পরীক্ষা। ভারতীয় রাজনীতিতে ‘রাহুল-যুগ’ এসে পড়া আর শুধুই অলীক কল্পনা নয়, অনেকেই তা বলা শুরু করেছেন। কিন্তু এখনই কি এই দাবি তোলা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না! ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতির বাস্তবতা বিশ্লেষণ করে একমাত্র বিশেষজ্ঞরাই এই দাবির সম্ভাবনা কতটা সেই উত্তর দিতে পারবেন।
দারিদ্রে লালিত, আজন্ম বস্তুসুখে বঞ্চিত মেয়েটি যেন এক আশ্চর্যময়ী। সে দুয়ারের ভিখারিকে ভিক্ষা দেয় পিছনপানে সংকটের দিকে তাকাতে তাকাতে, মৃদু ভীত, অপারগ, যে সমস্যাগুলি সে এখনও পুরোপুরি বোঝে না, তাকে বুঝছে কিন্তু বুঝছে না... পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে ভাইয়ের গুরুত্ব বেশি সে জানে।