Robbar

মিথ্যে আশা নয়, নোবেল বক্তৃতায় ‘সত্যি হতাশার’ কথা শুনিয়ে গেলেন লাজলো

Published by: Robbar Digital
  • Posted:December 15, 2025 4:37 pm
  • Updated:December 15, 2025 4:37 pm  

এই জেগে থাকা, এই সাক্ষী হওয়াই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ। আমরা সবাই সেই ট্রেনের যাত্রী, কোথাও নামার জায়গা নেই। কিন্তু যতক্ষণ আমরা চোখ খোলা রাখি, যতক্ষণ দেখি, ততক্ষণ আমরা মানুষ। আশা মৃত, কিন্তু উপস্থিতি সম্ভব। আর এই ‘উপস্থিতি’-ই হল নৈতিকতার নতুন ভাষা। ক্রাজনাহরকাই-এর বক্তৃতা শেষ হয় এই বলে: “I feel that I’ve thought about everything, and I have said everything about what I think about rebellion, about human dignity, about the angels, and yes, maybe about everything– even hope”।

নীলাঞ্জন হালদার

শূন্যতার ঘোষণা

নোবেল পুরস্কারের মঞ্চ মানেই তো আলোয় ঝলমলে এক উদ্‌যাপনের আবহ। প্রথা মেনে সেখানে জয়ের গল্প শোনানো হয়, মানবতার টিকে থাকার আশ্বাস দেওয়া হয়। ফকনার বলেছিলেন– মানুষ কেবল টিকেই থাকবে না, বিজয়ী হবে। কাম্যু বলেছিলেন সত্য আর স্বাধীনতার সেবার কথা। কিন্তু ১০ ডিসেম্বরে সুইডিশ অ্যাকাডেমির গ্র্যান্ড হলে যখন লাজলো ক্রাজনাহরকাই-এর নামটা উচ্চারিত হল, তিনি এমন এক সুরে কথা শুরু করলেন, মনে হল আধুনিক সভ্যতার কফিনে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিচ্ছেন কেউ। কলকাতার বাসিন্দা, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র ভক্ত আমি শুনতে পেলাম যেন সেই পরিচিত গান–

আমি ডানদিকে রই না
আমি বামদিকে রই না
আমি দুই দিকেতেই রই
পরান জলাঞ্জলি দিয়া রে
না আমি বড় রাস্তায় দাঁড়ায়ে
কবিতা করি আঁকিবুকি করি।

এই দুইদিকেই শুধু ‘উপস্থিত’ হয়ে থাকার দর্শন ঝরে পড়ল যেন তাঁর নোবেল ভাষণে।

লাজলো ক্রাজনাহরকাই

সহজ, কিন্তু ভয়ংকর এক দার্শনিক ভূমিকম্প দিয়ে শুরু করে তিনি বললেন, সাহিত্যে এই নোবেল পুরস্কার নেওয়ার মুহূর্তে ভেবেছিলাম আপনাদের সাথে ‘আশা’ নিয়ে দুটো কথা বলব। কিন্তু মুশকিল হল, আমার আশার ভাণ্ডার এখন নিশ্চিতভাবে ফুরিয়ে গেছে। তাই ওসব বাদ, আমি বরং দেবদূতদের নিয়ে কথা বলি।”

বিংশ শতাব্দীর মানবতাবাদ আর একবিংশ শতাব্দীর ঝকঝকে প্রযুক্তিগত ইউটোপিয়ার মুখে যেন এ এক সপাটে থাপ্পড়। ক্রাজনাহরকাই এখানে কোনও বিনয়ী লেখক নন, তিনি ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এক সংবাদবাহক। যুদ্ধ, জলবায়ু পরিবর্তন আর পুঁজিবাদের করাল গ্রাসে পৃথিবী যখন ধুঁকছে, তখন ‘আশা’ ফেরি করাটা তাঁর কাছে সবচেয়ে বড় মিথ্যাচার। তাই তিনি বেছে নিলেন দেবদূতদের– যাদের দিয়ে তিনি উন্মোচন করবেন আমাদের সময়ের সবচেয়ে নির্মম সত্যটা। 

টাওয়ার রুমের নির্জনতা

বক্তৃতার শুরুতেই তিনি যেন এক অদ্ভুত বিভ্রান্তিমূলক গোলকধাঁধা তৈরি করলেন। তিনি দাঁড়িয়ে আছেন স্টকহোমের মঞ্চে, অথচ মনে মনে তিনি আসলে পায়চারি করছেন তাঁর সেই নির্জন টাওয়ার রুমে। আমি পায়চারি করছি আর ভাবছি দেবদূতদের কথা… আসলে আমি কেবল গোলকধাঁধায় ঘুরছি’– এই ঘোরাঘুরি বা ‘পেস অ্যারাউন্ড’ তাঁর লেখারও সিগনেচার। তাঁর ‘স্যাটানট্যাঙ্গো’-র চরিত্ররা যেমন এক অন্তহীন বৃত্তে ঘোরে, লেখক নিজেও তেমনই চিন্তার গোলকধাঁধায় বন্দি।

জায়গাটা কেমন? কোনও রূপকথার আইভরি টাওয়ার নয় কিন্তু। সস্তা নরওয়ে স্প্রুস কাঠে বানানো একটা নড়বড়ে ঘর, যার ভিতরে উষ্ণতা খোঁজার চেষ্টা বাতুলতা। মিশেল ফুকো যাকে বলতেন ‘হেটেরোটোপিয়া’– সমাজের ভেতরে থেকেও যা সমাজের বাইরের জগত। সেখান থেকেই তিনি দেখেন সভ্যতার পতন। ঘরটা একটা ঢালের ওপর, যে ঢাল গড়িয়ে নেমে গেছে গভীর উপত্যকায়। এই নিচে নেমে যাওয়াটাই আসলে আমাদের ইতিহাসের গতিপথ।

তিনি বলছেন, আপনার চোখকে বিশ্বাস করবেন না। মনে হচ্ছে আমি মাইক্রোফোনের সামনে, আসলে আমি কিন্তু নিজের মনে ঘুরপাক খাচ্ছি।’ ওয়াল্টার বেঞ্জামিন শহরের পথে পথে হাঁটা ‘ফ্ল্যানর’-এর কথা বলেছিলেন, কিন্তু ক্রাজনাহরকাই-এর হাঁটা আরও নিঃসঙ্গ। তিনি কেবল শহরের ভেতর দিয়ে নয়, হাঁটছেন সময় আর নৈতিকতার ধ্বংসস্তূপের ওপর দিয়ে।

ডানাহীন, নির্বাক নতুন দেবদূতেরা

সবচেয়ে পরাবাস্তব অংশটা আসে দেবদূতদের প্রসঙ্গে। তিনি এদের ভাগ করলেন দু’ দলে– পুরাতন আর নতুন।

সেই রেনেসাঁস বা মধ্যযুগের ছবির ডানাওয়ালা দেবদূতদের কথা মনে পড়ে? ওরা ছিল ‘মেসেজ’ বা বার্তার বাহক। ওদের কাজই ছিল ঈশ্বরের সাথে মানুষের সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া। ওরা ছিল যাকে বলে– ‘সাবলাইম’। ওদের জন্যই আমরা বুঝতাম, মাথার ওপর একটা স্বর্গ আছে, মহাবিশ্বের একটা দিক আছে, নৈতিকতা আছে। বেঞ্জামিনের ‘এঞ্জেল অফ হিস্ট্রি’-এর মতো, যারা ঝড়ের মুখেও অতীত আর ভবিষ্যতের সেতু হয়ে ছিল।

ওয়াল্টার বেঞ্জামিন

কিন্তু ক্রাজনাহরকাই ঘোষণা করলেন– ওদের দিন শেষ। এখন যারা আছে, তারা ‘নতুন দেবদূত’। এদের ডানা নেই, এরা আমাদের মতোই সাধারণ রাস্তার পোশাকে ঘোরে। এদের কাছে কোনও ‘মেসেজ’ নেই। এরা বেঞ্জামিনের সেই দেবদূত নয় যে ঝড়ের দিকে তাকিয়ে আছে; এরা আমাদের মতোই ধুলোমাখা পথে হাঁটছে, কিন্তু একটু অন্য ছন্দে।

সবচেয়ে ভয়ের কথা হল, এরা আমাদের চোখের দিকে তাকায়, যেন আমরা ওদের কোনও বার্তা দেব। কিন্তু আমাদের কাছেও কোনও বার্তা নেই। প্রশ্নও নেই, উত্তরও নেই। এই নতুন দেবদূতরা আসলে বার্তা নয়, এরা হল ‘স্যাক্রিফাইস’ বা বলি। আগামবেন যেমন ‘হোমো স্যাকার’-এর কথা বলেছিলেন– যাদের হত্যা করা যায়, কিন্তু বলিদান করা যায় না– এরা ঠিক তাই। যুদ্ধের সামনে, নিষ্ঠুরতার সামনে এরা সম্পূর্ণ নিরস্ত্র। ‘বেয়ার লাইফ’ বা নগ্ন প্রাণের প্রতীক।

আর স্বর্গ? ওসব এখন এলন মাস্কদের দখলে। এখন ‘স্পেস’ আর ‘টাইম’ ঈশ্বর ঠিক করেন না, করে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর অ্যালগরিদম। এলন মাস্ক যখন মঙ্গলে উপনিবেশের স্বপ্ন বেচেন, তখন আসলে এই পৃথিবীটাকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। ক্রাজনাহরকাই যেন স্টেথোস্কোপ দিয়ে এই নতুন দেবদূতদের বুকের শব্দ শোনেন– সেখানে কোনও বার্তা নেই, আছে শুধু অনন্ত যন্ত্রণা।

কাদার ‘ফ্ল্যাটল্যান্ডে’ মানুষের ‘ডিগনিটি’

হঠাৎ বিষয় পালটে তিনি বললেন, থাক ওসব দেবদূত, এবার মানুষের মর্যাদার কথা বলা যাক।’ কিন্তু এখানেও সেই তীব্র স্যাটায়ার। চাকা আবিষ্কার থেকে শুরু করে চাঁদে যাওয়া– মানুষের এই যে লম্বা জার্নি, তার শেষটা কোথায়?

আপনারা এমন অস্ত্র বানিয়েছেন যা দিয়ে পৃথিবীটাকে বহুবার উড়িয়ে দেওয়া যায়… আপনারা আর কিছুতেই বিশ্বাস করেন না।’ থিওডর অ্যাডোর্নো যেমন বলেছিলেন, যুক্তির চরম শিখর শেষ পর্যন্ত বর্বরতাতেই পৌঁছায়। আমরা জ্ঞান পেয়েছি, প্রজ্ঞা হারিয়েছি। লিওনার্দো বা বাখ-এর মতো সৃষ্টি আমাদের আছে, কিন্তু এখন আমাদের সম্বল কেবল ‘শর্ট-টার্ম মেমোরি’।

সোশাল মিডিয়া আর রিলসের যুগে আমরা ইতিহাস মনে রাখি না। গাজায় গণহত্যা হয়, আমরা পরের দিন ভুলে যাই। ক্রাজনাহরকাই এই অবস্থাকে বলছেন ‘ফ্ল্যাটল্যান্ডস’ বা কাদার সমতল। মানুষ মঙ্গলে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছে, কিন্তু নৈতিকভাবে তলিয়ে যাচ্ছে এক বিশাল জলাভূমিতে। তিনি স্পষ্টই বলছেন, মানুষের সেই বিবর্তন বা ইভোলিউশন আর রিপিট করা সম্ভব নয়। স্বর্ণযুগ শেষ, এখন শুধু পচনের অপেক্ষা। অ্যাডোর্নোর সেই বিখ্যাত উক্তি– আউশউইৎজের পর কবিতা লেখা বর্বরতার সমতুল– যেন এখানে এসে আরও ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। এখন পুরো পৃথিবীটাই একটা আউশউইৎজ।

বার্লিন সাবওয়ের দশ মিটারের ব্যবধান

তত্ত্বের কচকচি ছেড়ে তিনি হঠাৎ আমাদের নিয়ে গেলেন ন’য়ের দশকের বার্লিনে। রুহলেবেন-গামী একটা সাবওয়ে স্টেশন। আধুনিক রাষ্ট্র আর মানবিক সংকটের এর চেয়ে বড় রূপক আর হয় না।

প্ল্যাটফর্মে একটা হলুদ দাগ বা ‘ইয়েলো লাইন’– রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার সীমানা চিহ্ন, বর্ডার। তার ওপাশে, অর্থাৎ নিষিদ্ধ জোনে দাঁড়িয়ে একজন ‘ক্লোচার্ড’ বা ভবঘুরে যিনি রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার বাইরে, কিন্তু রাষ্ট্রীয় শাস্তির আওতাভুক্ত। সে রেললাইনের ওপর প্রস্রাব করার চেষ্টা করছে। লোকটার শরীর ব্যথায় কুঁকড়ে আছে, ফোঁটায় ফোঁটায় কষ্ট বের হচ্ছে শরীর থেকে। আর উল্টো দিকের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে একজন পুলিশ অফিসার চিৎকার করছে, লাঠি উঁচিয়ে আছে।

পুলিশ হল রাষ্ট্র, আইন, আর তথাকথিত ‘ভালো’। আর ভবঘুরেটি হল ব্রাত্য, উচ্ছিষ্ট, আইনের চোখে ‘মন্দ’। ভবঘুরেটি কোনও রাজনৈতিক বিদ্রোহ করছে না, সে শুধু শরীরের যন্ত্রণার কাছে হার মেনেছে। আগামবেনের সেই অধিকারহীন মানুষ। 

মজার ব্যাপার হল, পুলিশ আর ভবঘুরের মাঝখানের দূরত্ব মাত্র দশ মিটার। রেললাইনের ট্রেঞ্চ। পুলিশ চাইলেই লাফ দিয়ে ওই দশ মিটার পার হতে পারে না, কারণ ওটাও আইনত দণ্ডনীয়। তাকে সিঁড়ি ভেঙে, ওভারব্রিজ পার হয়ে আসতে হবে– আমলাতান্ত্রিক পথের জটিলতা!

ক্রাজনাহরকাই একটা মুহূর্তের কথা বললেন– যখন দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকাল। ভালো এবং মন্দের মাঝখানে কোনও আশা নেই, একেবারেই নেই– between Good and Evil there is no hope, none whatsoever’। প্রাতিষ্ঠানিক ‘ভালো’ (রাষ্ট্র, এনজিও, জাতিসংঘ) কখনওই প্রান্তিক মানুষের (শরণার্থী, দরিদ্র) আসল যন্ত্রণাকে স্পর্শ করতে পারে না। মাঝখানে ওই দশ মিটারের অনতিক্রান্ত দূরত্বটা থেকেই যায়। এই অনন্ত দূরত্বের ধারণাটি ফ্রাঞ্জ কাফকার ‘দ্য ট্রায়াল’ এবং ‘দ্য ক্যাসল’-এর ব্যুরোক্র্যাটিক অবক্ষয়ের সাথে সরাসরি সংযুক্ত। কাফকার চরিত্ররাও এমন একটি অর্থহীন ব্যবস্থার মুখোমুখি হয় যেখানে আইন আছে, কিন্তু ন্যায়বিচার নেই।

বিদ্রোহ আসলে কী?

তাহলে বিদ্রোহের মানে কী? ওই ভবঘুরেরা কি একদিন বিপ্লব করবে? ক্রাজনাহরকাই বলছেন– না। বিদ্রোহ হতে হবে সমগ্রের সাপেক্ষে।’ কাম্যুর বিদ্রোহের ধারণার চেয়েও এই বক্তব্য আরও গভীর, যা শুধু খণ্ডসময়ের সাপেক্ষে কিছু দাবি আদায় নয়। এই যে মহাবিশ্বের ত্রুটিপূর্ণ কাঠামো, এই যে পুলিশ আর ভবঘুরের ইঁদুর-দৌড়– এর পুরোটার বিরুদ্ধেই একটা নীরব, নিস্পৃহ প্রত্যাখ্যান। এটাই আসল বিদ্রোহ। দার্শনিক বেঞ্জামিনের ‘উইক মেসিয়ানিক পাওয়ার’-এর মতো, যা মুহূর্তের জন্য ইতিহাসের চাকা থামিয়ে দেয়।

২০২৫-এর আয়নায় লাজলো-র বক্তৃতা

২০২৫ সালে দাঁড়িয়ে এই কথাগুলো কেন এত প্রাসঙ্গিক?

আজকের বিশ্বে যারা যুদ্ধের কারণে বা জলবায়ু বিপর্যয়ে উদ্বাস্তু, তারাই তো সেই ‘নতুন দেবদূত’। ইউরোপ-আমেরিকার সীমান্তে তারা দাঁড়িয়ে আছে, নির্বাক। তাদের পাসপোর্ট নেই, দেওয়ার মতো কোনও বার্তা নেই, শুধু টিকে থাকার আকুতি। আর রাষ্ট্রশক্তি তাদের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। ওই ‘দশ মিটারের দূরত্ব’ আজ ভূমধ্যসাগর বা গাজার কাঁটাতার।

আমরা প্রকৃতির বিরুদ্ধেও যুদ্ধ ঘোষণা করেছি। ওই ‘ফ্ল্যাটল্যান্ড’ তো আসলে পরিবেশগত বিপর্যয়ও। আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করেছি, এখন প্রকৃতি শোধ নিচ্ছে হড়পা বানে-ভূমিধ্বসে। আর আমরা ভাবছি মঙ্গলে পালাব। ফুকোর ‘বায়োপাওয়ার’-এর মতো রাষ্ট্র আজ আমাদের শরীর, স্বাস্থ্য সব নিয়ন্ত্রণ করছে। ক্রাজনাহরকাই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, আমরা ‘স্মৃতি’ হারিয়েছি এবং আমাদের ‘কল্পনাশক্তি’ ধ্বংস হয়ে গেছে। আজকের ‘সার্ভিল্যান্স ক্যাপিটালিজম’-এর যুগে আমাদের প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি চিন্তা অ্যালগরিদম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। আমরা ভুলে গেছি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা, আমরা ভুলে গেছি ঔপনিবেশিক শোষণের ইতিহাস। 

অনন্ত সাবওয়ে যাত্রা: শুধু সাক্ষী থাকা

বক্তৃতার শেষে তিনি আমাদের একটা অবিস্মরণীয় দৃশ্যের সামনে দাঁড় করালেন। তিনি আজও যেন সেই বার্লিনের সাবওয়ে ট্রেনে বসে আছেন। ট্রেন চলছে, স্টেশনগুলো পার হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তিনি কোথাও নামছেন না। আমি কোথাও নামি না… আমি শুধু দেখি স্টেশনগুলো সরে সরে যাচ্ছে।’

একজন আধুনিক লেখকের ভবিতব্য তো এটাই। তিনি পুলিশকে থামাতে পারবেন না, ভবঘুরেকে বাঁচাতে পারবেন না। তিনি কেবল ‘দেখতে’ পারেন। কেবল সাক্ষী হতে পারেন, খানিকটা সাংবাদিকের মতো।

ক্রাজনাহরকাই-এর এই ‘আশাহীনতা’ আসলে এক চরম সততা। মিথ্যা আশার চেয়ে এই সত্য হতাশা অনেক শক্তিশালী। যখন আমরা মেনে নিই যে কোনও আশা নেই’, তখনই আমরা মিথ্যা সান্ত্বনার মায়া থেকে মুক্তি পাই। তখনই আমরা ওই ‘দশ মিটার’ দূরত্বের দিকে অন্তত তাকিয়ে দেখার সাহস পাই।

আমাদের কাজ হল এই নতুন দেবদূতদের স্বীকৃতি দেওয়া। তাদের যন্ত্রণার সাক্ষী হওয়া। আশার মৃত্যু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু ‘উপস্থিতি’ বা প্রেজেন্স তো আছে। আমরা কিছু করতে পারি না, কিন্তু আমরা উপস্থিত থাকতে পারি। লাজলো ক্রাজনাহরকাই আমাদের আশার মৃত্যু সংবাদ শুনিয়েছেন, কিন্তু তার আড়ালে তিনি আমাদের ‘জেগে থাকার’ আহ্বান জানিয়েছেন– মহাপ্রলয়ের ঠিক আগের মুহূর্ত পর্যন্ত।

এই জেগে থাকা, এই সাক্ষী হওয়াই আমাদের সময়ের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহ। আমরা সবাই সেই ট্রেনের যাত্রী, কোথাও নামার জায়গা নেই। কিন্তু যতক্ষণ আমরা চোখ খোলা রাখি, যতক্ষণ দেখি, ততক্ষণ আমরা মানুষ। আশা মৃত, কিন্তু উপস্থিতি সম্ভব। আর এই ‘উপস্থিতি’-ই হল নৈতিকতার নতুন ভাষা। ক্রাজনাহরকাই-এর বক্তৃতা শেষ হয় এই বলে: “I feel that I’ve thought about everything, and I have said everything about what I think about rebellion, about human dignity, about the angels, and yes, maybe about everything– even hope”। এই ‘আশা’ শব্দটি শেষে আসে, কিন্তু এই নতুন আশার ধরনটি নতুন– এমন একটি আশা যা আশাবাদের উপর নির্ভর করে না। মহীনের গানের কথায়– 

আমি কেমনি মানুষ হই
আমার মহান হবার সাধই জাগে
মহান হতে পারিনে
আমি যে সাধ আহ্লাদ ছাড়িনে।