Robbar

সান্তা সেজে ফুড ডেলিভারি করলে ভারতীয় সংস্কৃতির বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয় না

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 3, 2025 8:56 pm
  • Updated:January 3, 2025 8:56 pm  

ক্রিসমাস উপলক্ষে কোনও একটি ফুড ডেলিভারি সংস্থা তার কর্মীদের সান্তা ক্লজের পোশাক দিয়েছিল। কিন্তু তা সহ্য হয়নি ‘মোড়ল’দের। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে সেই ডেলিভারি এজেন্টকে পোশাক খুলতে বাধ্য করা হয়েছে। সংস্থা পোশাক বিধি বাধ্যতামূলক করেছে বলা সত্ত্বেও ‘মোড়ল’দের প্রতি প্রশ্ন ছিল, ‘দিওয়ালিতে কি ভগবান রামের মতো পোশাক পরে খাবার ডেলিভারি করা হয়? তা যখন হয় না, তাহলে সান্তা ক্লজের পোশাকও পরা চলবে না।’ হাস্যকর যুক্তি! এই মোড়লরা না জানে ইতিহাস, না জানে নিজেদের সংস্কৃতি।

অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়

ভারত কী? শুধু একটি দেশ? বারবার করে তাকে খুঁজে চলি আমরা? দেখি, যাঁরা, যে মনীষীরা খুঁজতে বেরিয়েছে এই ভারত, তাঁরা হেঁটে বেরিয়েছে এই ভারতের পথ। খেয়েছে ভারতের বিচিত্র খাবার। যাপন করেছেন নানা ভাষাভাষীয় মানুষের কাছে। এবং তাঁরা হয়তো ধরতে পেরেছে ভারতের অন্তরাত্মা। আজ, এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই অন্তরাত্মার সঙ্গে ভারতের সাধারণ মানুষের যোগাযোগ কতটুকু?

অন্তরাত্মার সেই চরিত্র বুঝতে ব্যর্থ বর্তমান ভারত। তাই মানুষে-মানুষে ভেদাভেদ বাড়ছে। কখনও ধর্ম, কখনও জাতি, কখনও ভাষার নামে বিভেদ সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন মদত দিচ্ছেন ক্ষমতার ধামাধারীরা। অসহিষ্ণুতার হাত থেকে রেহাই নেই সাধারণ মানুষের।

ক্রিসমাস বা বড়দিন উপলক্ষে দেশের নানা প্রান্তেই কেক, সান্তা ক্লজের লাল পোশাক-টুপি, ক্রিসমাস ট্রি, বাহারি আলোর পসরা বসে। আজ থেকে নয়, বহুদিন ধরেই। স্থান-কাল-পাত্র ভেদে হয়তো হুজুগের তারতম্য হয়। যেমনটি হয় নানা ধর্মীয় উৎসব, পালা-পার্বণেই। ক্রিসমাস উপলক্ষে কোনও একটি ফুড ডেলিভারি সংস্থা তার কর্মীদের সান্তা ক্লজের পোশাক দিয়েছিল। কিন্তু তা সহ্য হয়নি ‘মোড়ল’দের। মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে সেই ডেলিভারি এজেন্টকে পোশাক খুলতে বাধ্য করা হয়েছে। সংস্থা পোশাক বিধি বাধ্যতামূলক করেছে বলা সত্ত্বেও ‘মোড়ল’দের প্রতি প্রশ্ন ছিল, ‘দিওয়ালিতে কি ভগবান রামের মতো পোশাক পরে খাবার ডেলিভারি করা হয়? তা যখন হয় না, তাহলে সান্তা ক্লজের পোশাকও পরা চলবে না।’

Hindu Ho Kar...': Zomato Rider, Dressed As Santa, Forced To Remove Costume On Christmas | Times Now
ইন্দোরের সেই ফুড ডেলিভারি বয়

হাস্যকর যুক্তি! এই মোড়লরা না জানে ইতিহাস, না জানে নিজেদের সংস্কৃতি। সান্তা ক্লজ পাশ্চাত্য সংস্কৃতির একটি চরিত্র হতে পারেন। প্রচলিত কিংবদন্তি অনুযায়ী, তিনি সেন্ট নিকোলাস বা ফাদার ক্রিসমাস। যিনি ২৪ ডিসেম্বর রাতে ও ৬ ডিসেম্বর, ফিস্ট ডে-র দিন ভালো ছেলেমেয়েদের বাড়ি ঘুরে উপহার দেন। তাঁর তো বাড়ি বাড়ি উপহার দেওয়াই দস্তুর। ভগবান রাম কেন বাড়ি ঘুরে ঘুরে উপহার দিতে যাবেন? মোড়লদের পাল্লায় পড়ে এবার কি তাঁকে ‘ডেলিভারি এজেন্ট’ সাজতে হবে? দিওয়ালির কী তাৎপর্য, তা-ও এই মোড়লদের হয়তো জানা নেই। একদিকে ‘রাম’কে মর্যাদাপুরুষোত্তম বলছে, ভগবান বিষ্ণুর অবতার বলছে। আবার সান্তার সঙ্গে টক্কর দিতে তাঁকে ডেলিভারি এজেন্টের পোশাকে সাজাতে চাইছে! ‘জয় শ্রী রাম’ ধ্বনির মাহাত্ম্য যে এতে ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, সেই বোধটুকুও তাদের নেই।

ভারতীয় সংবিধানের ২৫-২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ধর্মের স্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ ভারতে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা বাড়ছে দ্রুত হারে। বিশ্বের ১৯৮টি দেশের মধ্যে কোন দেশে ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা সবচেয়ে বেশি, সেই তালিকায় কয়েক বছর আগেও ভারত ছিল চার নম্বরে। সামনে শুধু সিরিয়া, নাইজেরিয়া এবং ইরাক। মার্কিন সমাজ-গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার এই তথ্য জানিয়েছে। বাড়ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অধিকারের উপর সরকারি হস্তক্ষেপ, ধর্মকে কেন্দ্র করে সামাজিক অস্থিরতা। এমনকি, দলিতদের উপর বর্ণহিন্দুদের অত্যাচার অনেক বেড়েছে। ন্যাশনাল ক্রাইম ব্যুরোর পরিসংখ্যান বলছে, খুন-ধর্ষণ-নির্যাতন-হেনস্তার শিকার বেশি হচ্ছেন দলিত মহিলারা। বহু ক্ষেত্রে অপরাধীদের বিচারই হচ্ছে না। শাস্তি তো দূর অস্ত।

Rohith Vemula’s memory lives on, but promise of casteism-free campuses forgotten
রোহিত ভেমুলা

কখনও রোহিত ভেমুলা, কখনও আখলাক, কখনও ফাদার গ্রাহাম স্টেইনস। পাল্টে যাচ্ছে নাম-ধাম-ধর্মীয় পরিচয়। পাল্টাচ্ছে না পরিণতি। আবার ইন্দোরে হেনস্তার শিকার ডেলিভারি এজেন্ট কিন্তু অর্জুন। অর্থাৎ মোড়লদের গোঁড়ামি থেকে ছাড় নেই হিন্দুদেরও। অথচ ঋগ্বেদেই বলছে, ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ অর্থাৎ ‘বিভিন্ন রূপে জগতের আরাধ্য একজনই’। কিন্তু অশিক্ষা ও স্বল্পশিক্ষা মানুষকে আরও ধর্মান্ধ করে তোলে। আর তার সঙ্গে যদি ধর্ম ব্যবসায়ী আর ধর্মকে হাতিয়ার করা সুযোগসন্ধানী রাজনীতিকরা হাত মেলান, তাহলে তো সোনায় সোহাগা। মনে হয় ‘আচ্ছে দিন’ সমাগত।