পিচ এমনভাবেই তৈরি করা যেখানে চার-ছয় খাওয়া বোলারদের অমোঘ নিয়তি। না হলেই সৌভাগ্য। অথচ কালেভদ্রে একটা বোলিং পিচ হলেই সবাই রে রে করে ওঠে, হাকডাক শুরু হয়ে যায় ‘খারাপ পিচ’ রব তুলে। অথচ আজ? কেউ বলছে না খারাপ পিচ। বরং সকলের চোখেমুখে তৃপ্তির আমেজ। এর নাম নাকি ক্রিকেট?
কাকভোরে গড়ের মাঠে টেনিদার সঙ্গে দেখা। একটা বটগাছের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে। খাঁড়ার মতো বোম্বাই নাকখানা একদম মিইয়ে গেছে। ব্যাপারখানা কী! জিজ্ঞাসা না করে আর পারলাম না। ফস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে যা বলল টেনিদা, শুনে আমার মনটা দমে গেল। কাল রাত থেকে চোখের দু’পাতা নাকি এক করতে পারেনি! বন্ধ করলেই চোখের সামনে হেনরিক ক্লাসেন, ট্রাভিস হেড, তিলক ভার্মারা ভেসে উঠছেন। শুধু উঠছেনই না, ব্যাট নামক শস্ত্র হাতে তাঁদের সংহারক মূর্তি দেখে পিলে চমকে উঠছে। ইহাকেই কি ব্যাটসম্যান কয়? নাকি জল্লাদ? ব্যাট হাতে যে নির্মমতার তাঁরা কচুকাটা করছেন বিপক্ষ বোলারদের তা দেখে করুণা জাগছে বোলার নামক ক্রিকেট-প্রজাতির ওপর। তাই দিনমণি দেখা দিতেই পড়িমড়ি করে টেনিদার গড়ের মাঠে ছুটে আসা। আসার সময় মনস্থির করে এসেছে, মাঠে ক্রিকেট খেলতে দেখলেই ছুটে গিয়ে নিরস্ত করবে বোলারদের। ক্রিকেট এখন তাদের না খেললেও চলে। ওখানে বোলারদের আর দরকার নেই। পুরোটাই ব্যাটারদের খেলা। এককথায় ‘স্বর্গরাজ্য’। বোলারদের দশা অনেকটাই সাত-আটের দশকে বলিউডি ফিল্মের সেই ভিলেনের মতো– ঠাট-বাট যতই থাক, পরিশেষে ‘উত্তম-মধ্যম’ কপালে নাচচ্ছে।
টেনিদার সঙ্গে তর্কে গিয়ে লাভ নেই। উচ্চিংড়ের মতো তর্ক করলে বেমক্কা গাট্টা খেতে হতে পারে। আর টেনিদা বাড়িয়ে তো কিছু বলেনি। ক্রিকেট মানে ঝিঁঝি নয়, একশো শতাংশ এন্টারটেনমেন্ট। প্রথম বল থেকে শেষ বল পর্যন্ত। আইপিএল তার জ্বলন্ত প্রমাণ। নয়তো এক ম্যাচে রেকর্ড ৫২৩ রান। রেকর্ড ৩৮টা ছয়। হয়? হয় কখনও? বাস্তবে এখন সেটাই হচ্ছে। রেকর্ড ভাঙছে, আবার তৈরি হচ্ছে।
বোলাররা শস্তায় বেধড়ক মার খাচ্ছে। হার্দিক পান্ডিয়া নিয়ে যত অসূয়াই থাক ক্রিকেট-জনতার, তিনি যে গুণমানসম্পন্ন অলরাউন্ডার, সবাই একবাক্যে মানবেন। তার দলে জসপ্রীত বুমরার মতো এক বোলিং ক্ষেপণাস্ত্র আছে, যা বিপক্ষ শিবিরে আছড়ে পড়লে ‘বুম বুম’ গগনভেদী শব্দ হয়। আছেন জেরাল্ড কোয়েৎজে, প্রোটিয়া বোলার, ডোনাল্ড-স্টেইনদের দেশোয়ালি। বোলার হিসেবে ওজনদার কম নন। কিন্তু মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের পেস বোলিংয়ের প্রথম চতুঃষ্টয় মিলে ম্যাচে খরচ করলেন ২০৫ রান! যার মধ্যে কোয়েনা মাফাকা নামক বছর সতেরোর প্রোটিয়া তরুণ একাই দিলেন চার ওভারে ৬৬!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ক্লাসেন-অভিষেক-হেডদের যত না কৃতিত্ব তারচেয়েও বেশি কৃতিত্ব প্রাপ্য হয়দরাবাদের ২২ গজের। এককথায় বলতে গেলে সেটা বোলারদের বধ্যভূমি। বোলারদের নুন মাখিয়ে ছাল ছাড়ানোর যা যা উপকরণ দরকার সবই ছিল সেই বধ্যভূমিতে। তাই বুমরা, হার্দিকরা শুধু নন, উল্টোদিকে প্রতি ওভারে ১৩ করে রান দিয়ে গেলেন সানরাইজার্সের ভুবনেশ্বরের মতো অভিজ্ঞ বোলারও।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সময়টা যে হার্দিকের বড্ড খারাপ যাচ্ছে, সেটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ‘ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার’ হিসেবে মাফাকাকে নামিয়ে চমক দিতে চেয়েছিলেন মুম্বই অধিনায়ক। হল ঠিক তার বিপরীত। বুমরার বদলে অনামি মাফাকা বোলিং ওপেন করে ভরাডুবি ঘটালেন। হেড-ক্লাসেন এমন ধোলাই করলেন, মাফাকা তাতে চোখে সর্ষেফুল দেখার জোগার। হয়তো ইষ্টনাম জপ করতে করতে ভাবছিলেন, কেন খেলতে এলাম আইপিএলে!
তবে পাহাড়প্রমাণ রানে ক্লাসেন-অভিষেক-হেডদের যত না কৃতিত্ব তারচেয়েও বেশি কৃতিত্ব প্রাপ্য হয়দরাবাদের ২২ গজের। এককথায় বলতে গেলে সেটা বোলারদের বধ্যভূমি। বোলারদের নুন মাখিয়ে ছাল ছাড়ানোর যা যা উপকরণ দরকার সবই ছিল সেই বধ্যভূমিতে। তাই বুমরা, হার্দিকরা শুধু নন, উল্টোদিকে প্রতি ওভারে ১৩ করে রান দিয়ে গেলেন সানরাইজার্সের ভুবনেশ্বরের মতো অভিজ্ঞ বোলারও। আসলে এমন ব্যাটিং-স্বর্গ তৈরি হলে তাদের বিশেষ করণীয় কিছু থাকেও না। স্রেফ হাত ঘুরিয়ে চার ওভার মার খাওয়া ছাড়া। এরচেয়ে বোলিং মেশিন দাঁড় করিয়ে খেলে নিলে বরং বোলারদের মানইজ্জত কিছুটা বাঁচে।
পিচ এমনভাবেই তৈরি করা যেখানে চার-ছয় খাওয়া বোলারদের অমোঘ নিয়তি। না হলেই সৌভাগ্য। অথচ কালেভদ্রে একটা বোলিং পিচ হলেই সবাই রে রে করে ওঠে, হাকডাক শুরু হয়ে যায় ‘খারাপ পিচ’ রব তুলে। অথচ আজ? কেউ বলছে না খারাপ পিচ। বরং সকলের চোখেমুখে তৃপ্তির আমেজ। এর নাম নাকি ক্রিকেট? ছোঃ! তারচেয়ে বরং বোলারদের কেটে ওই ২২ গজে ছড়িয়ে দিলে দর্শক মনোরঞ্জনের ষোলোকলা পূর্ণ হত।
যাক গে যাক। ক্রিকেট চরাচরে কবেই বা আর দাম পেলেন বোলাররা। তারা তো বরাবরই ত্যাজ্যপুত্তুর! নির্বিচারের তাদের ওপর খড়্গহস্ত হন ক্রিকেট-নিয়ন্ত্রারা, অক্লেশে। এই অবিচার তো আজকের নয়, ক্রিকেটের সেই আদিকাল থেকেই চলছে। মনে করুন, ‘বডিলাইন বোলিং’-এর কথা। ব্র্যাডম্যানদের বিরুদ্ধে লারউডদের সেই স্ট্র্যাটেজির শোরগোল ফেলে দিয়েছিল আচমকাই। তার জন্য অবশ্য প্রশংসা নয়, কাঠগড়ায় তোলা হয়েছিল ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনকে। কই, যখন পাটা-পিচে বোলারদের সংহার করতেন ক্রিস গেইল, এবি ডিভিলিয়ার্স, কিংবা আজকের বিরাট কোহলি, ট্র্যাভিস হেডরা, তখন তো কেউ প্রশ্ন তোলেননি। একবারও নয়।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: নিজেকে না বদলালে হার্দিকের পক্ষে দেশনায়ক হওয়া কতটা সম্ভব বলা মুশকিল
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আসলে ক্রিকেট যে ব্যাট-বলের খেলা, সেই সাম্যের কথা ভুলেই গিয়েছে জনতা। তাই হেডের ‘হেডমাস্টারি’-তে উল্লাসে মাতোয়ারা হয় কমলা-গ্যালারি। বাহবা দিতে গিয়ে অনেকে অবার বিশ্বকাপের ফাইনালের তুলনাও টেনে বসছেন চক্ষুলজ্জা ভুলে। বাষ্প গদগদ হয়ে বলছেন, ‘বিপক্ষে নীল জার্সি দেখলেই জ্বলে ওঠে ব্যাটা!’ ম্যাচ শেষে চওড়া হাসি হেসে ক্লাসেনও দরাজ সার্টিফিকেট দিয়ে গেলেন পিচ কিউরেটরকে। তাদেরই বা দোষ কী! এমন হাতের সুখের মঞ্চ পেলে আয়েশ করতে কে ছাড়ে! তাছাড়া মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যাচ থাকা মানেই একপ্রস্ত অপেরা। সেখানে খেলা শুধু ২২ গজে নয়, জনতা খোঁজে রোহিত-হার্দিকের পারস্পরিক জটিল রসায়নে। তাই মুম্বই বেহাল বোলিংয়ে হার্দিকের অসহায় মুখ দেখে ‘রোহিত-বদলা’র তৃপ্তির ঢেকুর তোলে স্টেডিয়ামের আনাচ-কানাচে উপবিষ্ট শর্মারা। এসবের চক্করে ক্রিকেট নামক মহান খেলাটার যে সলিল সমাধি ঘটল নিজামের শহরে, সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই।
তাতে বয়ে গেল জনতা-জনাদর্নের। ব্যাটসম্যান বেধড়ক ঠেঙাচ্ছে, চার-ছয়ের বন্যা ছুটছে। রেকর্ডের বুর্জ খলিফা তৈরি হচ্ছে। কী অনিন্দ্যসুন্দর দৃশ্য। জন্ম জন্মান্তরেও ভোলার নয়। কিন্তু বোলার? তারা কি এভাবেই পড়ে পড়ে মার খাবে? তাদের কথা কে ভাববে?
চোপ! আইপিএল চলছে!