Robbar

বোপান্না বোঝালেন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’

Published by: Robbar Digital
  • Posted:January 28, 2024 1:11 pm
  • Updated:January 28, 2024 7:39 pm  

টেনিসবিশ্বে সবচেয়ে বয়স্ক প্লেয়ার হিসেবে সদ্য সদ্য ডবলসে একনম্বর হয়েছেন। সেটাও ‘মাত্র’ ৪৩ বছর বয়সে। তারপর এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়। এমন একটা বয়সে কেরিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডবলস (ফরাসি ওপেনের মিক্সড ডাবলস জিতেছেন ২০১৭-তে) খেতাব জিতলেন, যে বয়সে টেনিসের পাট-চুকিয়ে কোচিংয়ে নামার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তাঁর একসময়ের সতীর্থরা।

সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়

‘দুটো ঘোড়া ছুটছে।

প্রবীণ প্রাণপণে ছুটছে। এমন ছোটা তার কেউ কোনদিন দেখেনি। সেও জীবনে কোনদিন এমন ছোটা ছোটেনি।

রাস্তার লোক দেখছে। হাততালি দিচ্ছে।–কে জেতে?–কে জেতে?

–বলিহারি–বাহবা–প্রবীনোয়া! বাহবা-বাহবা!

সামনেই সাঁকোটা বাজি-জেতার চিহ্নিত স্থানের মত দাঁড়িয়ে আছে।

–বলিহারি প্রবীনোয়া! বলিহারি!

প্রবীণই পৌঁছল সেখানে বড় ঘোড়ার আগে।

বাস! আর তার জীবনের কী প্রয়োজন? উঁচু সাঁকোটার পাশের রেলিং অনেক দিন ভেঙেছে। ডিস্ট্রিক্ট বোর্ড মেরামত করায় নি। বিশ হাত নিচে নুড়ি-পাথর-ভরা নদীর গর্ভ। প্রবীণ সেইখান দিয়ে খেলে ঝাঁপ।’

‘গবিন সিংয়ের ঘোড়া’ গল্পে ‘বুড়ো ঘোড়া’ প্রবীণের অবহেলিত, লাঞ্ছনাময় জীবনের এমন করুণ পরিণতি এঁকেছেন গল্পকার তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।

মৃত্যু দিয়ে যার শেষ। কিন্তু জেদ, জেতার অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে তারুণ্যের আস্ফালনকে উপড়ে ফেলে, ওই যে এক ব্রাত্য ‘বেতো ঘোড়া’র জীবনের শেষ দৌড়ে জীবনকে বাজি রেখে জিতে যাওয়ার স্বপ্নপূরণ, সেটাই যেন মহাকালের শাশ্বত-বাণী। জীবনযুদ্ধে পোড়খাওয়া লেখক তারাশঙ্কর তারই প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন ‘গবিন সিংয়ের ঘোড়া’য়, ওই নিঃস্বার্থ, অবলা জীবের মধ্য দিয়ে।

সেই অমোঘ সত্য কি শনিবাসরীয় মেলবোর্ন পার্কে অনুভব করতে পারছিলেন রোহন মাচান্দা বোপান্না?

ভাগ্যনির্ধারক দ্বিতীয় সেটে জ্যা-মুক্ত তিরের মতো টেনিস-বলটা তাঁর র‌্যাকেট ছুঁয়ে বিপক্ষ কোর্টে আছড়ে পড়তেই সেই বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হল রড লেভার এরিনায়। ভারতীয় টেনিস-নক্ষত্রের মন তখন ঠিকানা খুঁজে পেয়েছে স্বপ্নপূরণের বাস্তুভিটে। তাই হয়তো মেলবোর্ন কোর্টের ওই নীলাভ হার্ডকোর্টে মুহূর্তের জন্য বিছিয়ে দিয়েছিলেন পরিশ্রান্ত শরীরটাকে। কাঁচা-পাকা দাড়ির ফাঁক গলে ঠিকরে বের হচ্ছে যুদ্ধ-জয়ের হাসি। ঠিক যেন নিজেকে ছুঁড়ে দেওয়া ‘গবিন সিংয়ের ঘোড়া’র মতো। কী ভাবছিলেন রোহন? যা দেখছেন, যা অনুভব করছেন, তা সত্যি? নাকি সবই স্বপ্নের মায়াজাল?

Australian Open 2024: Rohan Bopanna Becomes Oldest Men's Doubles Grand Slam Winner
রোহন বোপান্নার অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়ের মুহূর্ত

………………………………………………………………………………………………………………………………………

আরও পড়ুন: কার্লেস কুয়াদ্রাত, ইস্টবেঙ্গলের আত্মার সঙ্গে আপনার শিকড়ের যোগ

………………………………………………………………………………………………………………………………………

আসলে রোহন বোপান্না একা তো অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতেননি। তিনি একলহমায় জিতিয়ে দিয়েছেন অসংখ্য, অগণন ‘বুড়ো ঘোড়া’দেরও। উপেক্ষার পৃথিবীতে খাবি খেতে-খেতে যেমন জিতে গিয়েছিল মতি নন্দীর জহর পাল, কমল গুহরা। রোহন বোপান্না যেন সেই বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা জীবন্ত অঙ্গার। যে হারতে হারতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার পরেও হাল ছাড়ে না। বিপক্ষের চালে বারংবার কিস্তিমাত হয়েও মনকে ভরসা জুগিয়ে বলে, ‘হাল ছেড়ো না বন্ধু’। বুঝিয়ে দেয়, ইচ্ছাশক্তি অফুরান হলে বয়স স্রেফ সংখ্যামাত্র। যেমন তা বুঝিয়েছেন, সিকে নাইডু থেকে মহেন্দ্র সিং ধোনি, রজার মিল্লা থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো, কিংবা মার্টিনা নাভ্রাতিলোভা থেকে লিয়েন্ডার পেজ– কাল থেকে কালান্তরে। শনিবারের মেলবোর্ন পার্ক-সহ তামাম দুনিয়া সেই ব্রতপাঠ নিল বোপান্নার কাছ থেকে।

………………………………………………………………………………………………………………………………………

পুরুষ ডাবলসে সবচেয়ে প্রবীণ হিসেবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়, অথচ কয়েক বছর আগে টানা পাঁচ মাস জয়ের মুখই দেখেননি বোপান্না। হতাশায় ভিডিও-বার্তায় স্ত্রী সুপ্রিয়াকে লিখেছিলেন, আর নয়, অবসর নিতে চান। টেনিস-দেবতা হয়তো মুচকি হেসেছিলেন বোপান্নার মনের কথা পড়ে। শনিবার মেলবোর্ন পার্কে যুদ্ধ-জয়ের পর কি সেই ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ছিল তেতাল্লিশের ‘তরুণ’ কর্ণাটকীর?

………………………………………………………………………………………………………………………………………

টেনিসবিশ্বে সবচেয়ে বয়স্ক প্লেয়ার হিসেবে সদ্য সদ্য ডবলসে একনম্বর হয়েছেন। সেটাও ‘মাত্র’ ৪৩ বছর বয়সে। তারপর এই অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জয়। এমন একটা বয়সে কেরিয়ারের প্রথম গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডবলস (ফরাসি ওপেনের মিক্সড ডাবলস জিতেছেন ২০১৭-তে) খেতাব জিতলেন, যে বয়সে টেনিসের পাট-চুকিয়ে কোচিংয়ে নামার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত তাঁর একসময়ের সতীর্থরা।

বোপান্না সেখানে যেন উল্টোস্রোতের নাবিক। অস্তরাগের অবসন্ন ঘোর কাটিয়ে ভারতীয় টেনিস তারকার খেলায় আচমকাই মধ্যগগনের তেজ। পুরুষ ডাবলসে সবচেয়ে প্রবীণ হিসেবে গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়, অথচ কয়েক বছর আগে টানা পাঁচ মাস জয়ের মুখই দেখেননি বোপান্না। হতাশায় ভিডিও-বার্তায় স্ত্রী সুপ্রিয়াকে লিখেছিলেন, আর নয়, অবসর নিতে চান। টেনিস-দেবতা হয়তো মুচকি হেসেছিলেন বোপান্নার মনের কথা পড়ে। শনিবার মেলবোর্ন পার্কে যুদ্ধ-জয়ের পর কি সেই ফেলে আসা দিনের কথা মনে পড়ছিল তেতাল্লিশের ‘তরুণ’ কর্ণাটকীর?

Historic! Rohan Bopanna becomes oldest-ever Grand Slam winner after clinching maiden Australian Open men's doubles title with Matthew Ebden | Tennis News - News9live

আসলে রোহন বোপান্না একা অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জেতেননি। তারসঙ্গে জিতে গিয়েছে অনেক বুকভাঙা স্বপ্নরাও। যার একদিন ডানা-ভেঙে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। ক্রমশ হারিয়ে যেতে যেতে নিজেকে ফিরে পাওয়া বোপান্নার সঙ্গে তাই কোথাও গিয়ে লীন হয়ে যায় ঐতিহ্যের রড লেভার এরিনা। যেখানে বুড়ো হাড়ে রাজপাট গড়েন কোনও এক নোভাক জকোভিচ, তারও আগের রজার ফেডেরার নামক শিল্পী। আর অস্ট্রেলিয়ান ওপেন হয়ে ওঠে ফুরিয়ে যাওয়া রোহন বোপান্নাদের একমুঠো অক্সিজেন। বয়স তখন আর রোহন বোপান্নাদের ৪৩ থাকে না। হয়ে যায়, ‘লেভেল ৪৩’। যে তেতাল্লিশে দাঁড়িয়ে ‘লেভেল ৪৪’-এ সাফল্যের শপথ নেন বোপান্নারা। বুঝিয়ে দেন, অধ্যাবসায় আর খেলার প্রতি অতলান্ত ভালোবাসা থাকলে বয়সকে তুড়ি মেরে প্রতিকূলতার পাহাড় ডিঙানো যায়।

রোহন বোপান্না আসলে সেই শ্রেণির প্রতিভূ, যাঁদের চেনা জাগতিক নিয়মে বাঁধা যায় না। সাফল্যের বিনির্মাণ তাঁদের সহজাত। শুরু আর শেষটাও তাই তাঁদের বয়সের মাপকাঠিতে নির্ধারিত নয়। তাঁরা আসলে ইচ্ছাধারী টেনিস-ক্ষত্রিয়। অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতে তাই বোপান্না বোঝালেন, ‘শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?’