পেশা ও নেশা– দু’টিকে আঁকড়ে ধরে সুখে ঘরকন্না করেছেন নেত্রভালকর। ব্যস্তসমস্ত অফিস জীবনের পাশে ২২ গজের রানআপ চিনে নিতে ভুল হয়নি তাঁর। লং জার্নি করে সান ফ্রান্সিসকো থেকে কখনও লস অ্যাঞ্জেলস, কখনও আবার ফ্লোরিডায় গিয়ে খেলতে নেমে ক্লান্তি আসেনি সৌরভের চোখেমুখে। যেমন বিরক্তি গ্রাস করেনি ম্যাচ খেলে হোটেলে ফিরে ল্যাপটপের সামনে বসে অফিসের কাজ করে যেতে।
আমাদের মনের মধ্যে একটা সৌরভ নেত্রভালকর বাস করে। যদিও ‘সৌরভ’ বলতে এতদিন আমরা একডাকে একজনকেই চিনতাম। ওই যে, বেহালার বাঁ-হাতি। আমার, আপনার, সকলের ‘দাদা’। কিন্তু এখন সৌরভ মানে সৌরভ নেত্রভালকরও। কপালগুণে তিনিও বাঁ-হাতি। এ সৌরভ আমার আপনার মতোই রক্তমাংসের মানুষ। এককথায় ‘জিনিয়াস’। না-রেঁধে এবং না-চুল বেঁধে এবং একইসঙ্গে দু’নৌকায় পা রেখেও সফল হওয়া যায়– দেখাচ্ছেন নেত্রভালকর। দেখছে তামাম দুনিয়া, মার্কিন মুলুকে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে।
বড় হয়ে ক্রিকেটার হব– এ স্বপ্ন অনেক ভারত-সন্তানই দেখে। কিন্তু চাকরি করতে করতে সমান তালে শীর্ষ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলব, এমন স্বপ্ন ক’জন দেখে? বলা মুশকিল। সৌরভ সেই কঠিন সংকল্পে এক সফল মানুষ। এজন্য তাঁর সাবাশি প্রাপ্য। পাচ্ছেনও। পাচ্ছেন, কারণ, আমাদের মনের মধ্যে সবসময় একটা সৌরভ নেত্রভালকর হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে। যে স্বপ্নের পিছনে ছুটে যায়, ব্যর্থতার ধাক্কায় মুখ থুবড়ে পড়ে, তারপর গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বিকল্প পথের সন্ধান করে রুটিরুজির টানে, জীবনের নিশ্চয়তা খোঁজে। তাতে পেট ভরে, কিন্তু মন ভরে না। মনের কোঠায় কাচ-ভাঙা স্বপ্ন উসখুস করে। কখনও কখনও মাথাচাড়া দেয়। অধিকাংশ সেই ইচ্ছার টুটি চেপে বলেন– থাক, অনেক হয়েছে, আর নয়। এই বেশ ভালো আছি। কেউ কেউ আবার উল্টোস্রোতে পা বাড়িয়ে দেন। আঁকড়ে ধরেন স্বপ্ন। তারা সফল হলে, আমাদের মনের চোরাকুঠুরিতে আটকে পড়া সৌরভ নেত্রভালকর জিতে যায়। তখন হৃদয়ের দখিন দুয়ার খুলে আমরা তাকে সাবাশি দিই। সৌরভ নেত্রভালকর তাই একা জেতেন না। ওই দু’নৌকায় টলমল পা-ধারী মানুষগুলোকে জিতিয়ে দেন। জুগিয়ে দেন একবুক অক্সিজেন।
ভারতের হয়ে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলেছিলেন সৌরভ। স্বপ্ন ছিল দেশের হয়ে সিনিয়র পর্যায়ে খেলবেন। কিন্তু অকালে কুঁড়ি যেমন ঝরে যায়, তেমনই ভারতের হয়ে খেলার স্বপ্ন-সৌরভও মিলিয়ে গিয়েছিল নেত্রভালকরের। বলা ভালো, তেমন যুত করতে পারেননি ধাপে ধাপে সিনিয়ার পর্যায়ে উঠে আসার লড়াইয়ে। মুম্বইয়ের হয়ে অভিষেক হয়েছিল। একটা ম্যাচ খেলেছিলেন কর্ণাটকের বিরুদ্ধে। ব্যস, ওইটুকু। তারপর ড্রেসিংরুমের ঠান্ডাঘরে ‘গ্যারেজ’। সৌরভ ললাটলিখন পড়তে পেরেছিলেন। বুঝেছিলেন, যা চাইছেন, তা হবে না। যেমন আমরা কখনও কখনও পারি স্বপ্নের অপমৃত্যুর ঘ্রাণ নিতে, আমাদের দীর্ঘশ্বাসেও তো মিশে থাকে ‘না হয়ে ওঠার’ যন্ত্রণা।
………………………………………………
সৌরভ এরপরেও লড়ে গিয়েছেন। যে লড়াইটা আমআদমি-র অচেনা নয়। পড়াশোনায় তুখোড় নেত্রভালকর, নিজেকে বিষাদসিন্ধুতে ডুবিয়ে দেননি। একটা নোঙর খুঁজেছেন যা তাকে জীবনযুদ্ধে, রুজি-রোজগারের ইঁদুরদৌড়ে টিকিয়ে রাখবে। সেখানে ক্রিকেটারেরর চেয়ে সাধারণের ভিড় আরও বেশি ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র সৌরভ ভুলচুক করেননি।
………………………………………………
সৌরভ এরপরেও লড়ে গিয়েছেন। যে লড়াইটা আমআদমি-র অচেনা নয়। পড়াশোনায় তুখোড় নেত্রভালকর, নিজেকে বিষাদসিন্ধুতে ডুবিয়ে দেননি। একটা নোঙর খুঁজেছেন যা তাকে জীবনযুদ্ধে, রুজি-রোজগারের ইঁদুরদৌড়ে টিকিয়ে রাখবে। সেখানে ক্রিকেটারেরর চেয়ে সাধারণের ভিড় আরও বেশি ছিল। কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ছাত্র সৌরভ ভুলচুক করেননি। ফলে প্রথমে দেশ, তারপর বিদেশে ডিগ্রি এবং মোটা অঙ্কের চাকরি। সেটাও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এককথায় সেলেটড লাইফ। সৌরভের জীবনের গল্পটা হতেই পারত সমীরুদ্দীর গল্পের মতো। ইশকুলপাঠ্যে যাকে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আলীসাহেব (সৈয়দ মুজতবা আলী)। ‘মিরকিন’ মুলুকে অনেক টাকা রুজি-রোজগার করে দেশে ফিরে জীবনটাকে থিতু করবে, ভেবেছিল সমীরুদ্দী। অনেক বাধাবিপত্তি পেরিয়ে, হাড়ভাঙা পরিশ্রম শুষে নিয়ে সেই উপার্জনের পাহাড় জমেছিল। কিন্তু নিশ্চিত জীবন? ছলনা করেছিল সমীরুদ্দীর সঙ্গে।
জীবন এতটা নিষ্ঠুর হয়নি সৌরভের সঙ্গে। বরং দিয়েছে ‘সেকেন্ড চান্স’, দ্বিতীয় ইনিংসের মতো। যেমন দেয় প্রত্যেক মানুষকে। সেখানে কেউ পেশাকে আঁকড়ে ধরে ত্যাগ করেন প্যাশনকে, নিশ্চয়তার হাতছানিতে। সৌরভের সামনেও সেই সুযোগ ছিল। সফ্টওয়ার ইঞ্জিনিয়ারের কাজ সামলে হেসেখেলে কেটে যেতে পারত তাঁর আপাত নিরীহ জীবন। তবু পেশা ও নেশা– দু’টিকে আঁকড়ে ধরে সুখে ঘরকন্না করেছেন নেত্রভালকর। ব্যস্তসমস্ত অফিস জীবনের পাশে ২২ গজের রানআপ চিনে নিতে ভুল হয়নি তাঁর। লং জার্নি করে সান ফ্রান্সিসকো থেকে কখনও লস অ্যাঞ্জেলস, কখনও আবার ফ্লোরিডায় গিয়ে খেলতে নেমে ক্লান্তি আসেনি সৌরভের চোখেমুখে। যেমন বিরক্তি গ্রাস করেনি ম্যাচ খেলে হোটেলে ফিরে ল্যাপটপের সামনে বসে অফিসের কাজ করে যেতে।
………………………………………………
আরও পড়ুন: ইউরো অঘটনের মাস্টারমাইন্ড এক কফি বিক্রেতা
………………………………………………
জীবনযুদ্ধের এই ভারসাম্যটাই জিতিয়ে দিয়েছে সৌরভকে। তাই বাবর আজমদের বিরুদ্ধে সুপার ওভারের অনিশ্চয়তায় তাঁর ওপর ভরসা করা যায়। বিরাটকে গোল্ডেন ডাকে প্যাভিলিয়নে ফেরাতে তাঁর ওপর ভরসা করা যায়, ভরসা করা যায় ‘সিনিয়র’ রোহিতের উইকেট হাশিলে।
মধ্যবিত্তের সংকট অনেক সময় মানুষের স্বপ্নের গতিরোধ করে। আমরা যারা সেই ভুবনে বাস করি, তাদের অনেকক্ষেত্রেই সৌরভ নেত্রভালকর হয়ে ওঠা হয় না। কিন্তু আমাদের মনের বাসা থেকে নেত্রভালকররা পালায় না। সুযোগের প্রহর গোনে। তাই ‘জো জিতা ওহি সিকান্দার’ শুধু নয়, ‘জো জিতা ওহি নেত্রভালকর’ও। সেটা সৌরভ হতে পারে, আমি-আপনি কিংবা অন্য কেউ।