গ্রহান্তরের লোকটা বদল আনছে! প্রতিশোধ নিচ্ছে নির্মম। যে ইউরোপ তাকে রাখেনি, সেই ইউরোপের ফুটবল-রাজকোষ ফাঁকা করে দিয়ে! নাহ্, নেমারদের আনতে পয়সা দেয়নি সে, তবে পথ দেখিয়েছিল, প্রকৃত প্রবর্তকের মতো। অর্থ চিরকাল ছিল সৌদির। কিন্তু সৌদি জানত, শুধুই অর্থ দিয়ে অগ্রগতি হবে না। অর্থই উন্নতির একমাত্র সূচক হলে, অনেক আগে এ জিনিস করে দেখাতে পারত চিন, সৌদি প্রো লিগের বহু আগে। অকাতর অর্থের সঙ্গে সৌদির তাই দরকার ছিল এক তারকা পৃষ্ঠপোষক।
সে এক মানুষ বটে। বড় মানুষ, বেড়ে মানুষ, মানুষের মতো দেখতে, হাত-পা-মাথাওয়ালা এক গ্রহান্তরের মানুষ। জন্ম যার অবহেলায়, আক্ষেপের আঁস্তাকুড়েতে। সম্পত্তি বলতে তার দু’-তিনটে জিনিস। সৌম্য কান্তি, পাশবিক জেদ, আর স্বর্গীয় দু’পা! যে দু’পায়ে বিছিয়ে থাকে কুহক, যার বনফুল-গন্ধে আকৃষ্ট হয়ে ছুটে আসে এক চর্মগোলক– নাম ফুটবল। সে মানুষের দেশ, তার জন্মভিটে, প্রসবের সময় জানত না, তার সন্তান একদিন এত বড় হবে যে, উঁকি দেবে আকাশে! মানবপ্রজাতির অগণিতকে বশে এনে নিজেই সে একদিন হয়ে উঠবে এক ‘দেশ’, শুধুই নিজের দেশের প্রতি দাসত্ব না করে।
বরাবরের ডানপিটে, বিদ্রোহী, বেপরোয়া সে। বহু কাল আগের এক কোঁকড়া চুলের বেঁটে দশ নম্বরের মতো। তার মতো একইরকম, মুখের সঙ্গে পায়েও মারিতং জগৎ। এই গ্রহ-মানব গোল করে, গোল করায়, অলৌকিক ক্ষমতায় শূন্যে ভেসে থাকে, থেকে হেড দেয়। প্রচুর পুরস্কার, প্রচুর টুর্নামেন্ট জিতেছে সে। পায়নি শুধু বিশ্বকাপ। পারেনি ‘রাম নামক সুবোধ বালক’ হয়ে, ফিফার শ্রেষ্ঠ মুখ হতে। কী করা যাবে, কর্ণের জীবন তার, মোক্ষম সময়ে রথের চাকা বসে যাওয়াই দস্তুর। কাতার বিশ্বকাপে বসিয়ে দিয়েছিলেন যেমন ফের্নান্দো স্যান্টোস নামধারী এক, ঠিক সময়ে বন্ধুত্বের মুখোশ খুলে, পিঠে ছুরি মেরে! সে ভেবেছিল, বেঁচে যাবে ঠিক। লড়ে নেবে। জনতার স্বপ্ন দিয়ে তৈরি তো, জনতাই জিতিয়ে দেবে। পারেনি জনতা। পারেনি তাদের আবেগী ঝোড়ো হাওয়া স্যান্টোসের পিঠে প্রতিবাদী ধাক্কা দিতে। বরং অপমানের বেঞ্চে বসেই খেলা দেখতে হয়েছে তাকে, যন্ত্রণায় নীল হয়ে, টানেলে কেঁদে শেষ হয়েছে শেষ বিশ্বকাপ। ফিফা লিখেছে, ‘ওব্রিগাদো’, ফিনকি দিয়ে ছিটকে এসেছে বিদ্রূপ। ততদিনে ইউরোপের ক্লাব ভবিষ্যৎ ধূসর, ইউনাইটেডও জানিয়ে দিয়েছে রাখবে না। সময় ওদিকে ‘লাস্ট কল’ দিচ্ছে, ঘোর প্রতিপক্ষের বিশ্বজয়ের হট্টগোলের মাঝে, সময় শেষের বার্তা পাঠিয়ে। করত কী সে? সৌদি আরব নামের এক ফুটবল-ঊষর দেশকে আঁকড়ে ধরা ছাড়া? পায়ের মোচড়ে বিশ্বকে শেষ বার দেখে নেওয়া ছাড়া?
তবু দুয়ো দিয়েছে লোকে, ফুট কেটেছে। হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছে শত্রুরা। আর আসবে না এ ‘অলক্ষুণে’, ব্যালনের প্লেটে ভাগ বসাতে। দুশ্চিন্তায় হাড়ে কালি আর পড়বে না। শেষে সবাই ভুলে গিয়েছে। ধুস! ইউরোপের রাজদরবারে যে থাকে না, ঠাঁই হয় না যার, কে তাকে মনে রাখে? কৌলিন্য অত শস্তা নয়, স্মৃতির শতদল বলেও কিছু হয় না।
কেউ শুধু ভাবেনি, বায়ুমণ্ডলে ভক্তদের দুঃখী দীর্ঘশ্বাস সম্বল করে ক্ষতবিক্ষত, সেই গ্রহান্তরের লোক গড়তে বসবে এবার নতুন দেশ। নতুন এক ফুটবল-দেশ! বিশ্বজয়ের অভিলাষ ছেড়ে, ফুটবলের বিশ্ব-প্রসারক হয়ে। তা-ও এমন এক মরুপ্রান্তরে, যেখানে গত এক শতাব্দীতে প্রকৃত ফুটবলের বীজ কেউ কখনও পোঁতেনি। প্রথমে একজন, দু’জন। তার পর পরপর কয়েকজন। শেষে দলে দলে। বেঞ্জেমা থেকে মানে, মানে থেকে মেন্ডি, মেন্ডি থেকে কন্তে, কন্তে থেকে নেমার। ফুটবল প্রাজ্ঞরা প্রথমে আমল দেননি, সরেস ফুটবল বাণপ্রস্থের ঠিকানা বলে খোঁটা দিয়েছেন। কিন্তু দ্রুতই সে পরিহাস রূপান্তরিত হয়েছে টেনশনের স্বেদবিন্দুতে, আঁতকে উঠেছেন পেপ, যিনি কিনা আবার বিশ্বফুটবলের ‘পোপ’। পরিত্রাহী চিৎকার ছেড়েছেন তখন তাঁরা, সভয়ে, ফুটবল উঠে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে। গ্রহান্তরের লোকটা বদল আনছে যে, বদল! প্রতিশোধ নিচ্ছে, নির্মম প্রতিশোধ। যে ইউরোপ তাকে রাখেনি, সেই ইউরোপের ফুটবল-রাজকোষ ফাঁকা করে দিয়ে! নাহ্, নেমারদের আনতে পয়সা দেয়নি সে, তবে পথ দেখিয়েছিল, প্রকৃত প্রবর্তকের মতো। অর্থ চিরকাল ছিল সৌদির। কিন্তু সৌদি জানত, শুধুই অর্থ দিয়ে অগ্রগতি হবে না। অর্থই উন্নতির একমাত্র সূচক হলে, অনেক আগে এ জিনিস করে দেখাতে পারত চিন, সৌদি প্রো লিগের বহু আগে। অকাতর অর্থের সঙ্গে সৌদির তাই দরকার ছিল এক তারকা পৃষ্ঠপোষক। যে তার ফুটবল বাণিজ্যে জোয়ার আনবে। ইউরোপের উন্নাসিকতাকে সিধে করে দেবে একদিন, ফুটবলের নতুন উপকূল খুলে। আজ দেখুন, ইউরোপের অর্ধেক তারকা এখন সৌদিতে। আজ দেখুন, ২০৩৪ বিশ্বকাপও সম্ভবত সৌদিতে। ফিফাই বলছে, আর কেউ ‘বিড’ করেনি। রক্ষণশীলতার বাহক হিসেবে পরিচিত সৌদির পরিচয় কিন্তু বদলাচ্ছে দ্রুত। সৌদি এখন তেলের নয়, ফুটবলেরও দেশ।
কী, নাম চান এবার, নাম? গ্রহান্তরের সে মানুষের নাম? মানুষের ভালোবাসা আর ঘৃণার সঙ্গমে সৃষ্ট যে? থাক না। যারা চেনার, চিনবে ঠিক। যারা জানার, জানবে ঠিক। শুধু এটুকু লেখা যাক, ভুল করেছিল ইউরোপ, ভুল ভেবেছিল বিশ্ব। পর্তুগীজদের কখনও ঘাঁটাতে নেই। জন্মের সময় জঠরে তারা একটা নেশা নিয়ে জন্মায়। নতুন দেশ আবিষ্কারের নেশা। নতুন সভ্যতা আবিষ্কারের নেশা। প্রজন্ম আসে, প্রজন্ম যায়, নেশা কাটে না। শুধু নাম পাল্টায় আবিষ্কারকের।
কোনও শতাব্দীতে ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। কোনও শতাব্দীতে ভাস্কো দা গামা!
গোবলয়ে যেমন কন্যা-সন্তানদের আজকাল খবর অনুযায়ী স্রেফ গলা টিপে খুন করা হয় না ডিসেন্সির খাতিরে, তেমনটা এখানকার রীতি নয়। বাপ, দাদা, ভাই ডিম তো বটেই, এমনকী মাংসও খাবে আর বোনের কপালে শুকনো রুটি-সবজি, অতটা পৌরুষ প্রদর্শন প্রায় কোনও জেলাতেই দেখিনি অদ্যাবধি।
মজার বিষয়, শ্যাম বেনেগাল যখন হঠাৎই 'বোস: দ্য ফরগটেন হিরো' বানাচ্ছেন, এনডিএ আমলের শেষ ও ইউপিএ আমলের শুরুর আবহে, তার আশপাশে ভগৎ সিংয়ের গোটা দুই বায়োপিক মুক্তি পেয়ে গেছে, একটিতে নায়ক অজয় দেবগণ, অন্যটিতে সানি দেওল। অজয় দেবগণ অভিনীত বায়োপিকটিই বেশি স্মর্তব্য হয়ে রইল, সানি দেওলের 'ঢাই কিলো কা হাত' এক্ষেত্রে অকেজো হয়ে গেল।