Robbar

জেমিমাদের জয়ে যে ভারত হারল

Published by: Robbar Digital
  • Posted:October 31, 2025 1:49 pm
  • Updated:October 31, 2025 7:51 pm  
Indian women's cricket team victory and its impact on society

হারল সেই ভারত, যে-ভারত মনে করে মেয়েদের ক্রিকেট মানে ‘ধুস’! হারল সেই ভারত যে-ভারত মনে করে, রাতে হোটেল থেকে বেরনোর আগে অস্ট্রেলিয়ান মহিলা ক্রিকেটারদের সিকিউরিটিকে জানানো উচিত ছিল।  হারল সেই ভারত, যে-ভারত পুরুষ ক্রিকেট টিমের জয়কে কেন্দ্র করে জাতীয়তাবাদের বিষ ছড়িয়ে দেয় রাজ্যে রাজ্যে। জিতল আরেক ভারত। সেই ভারতকে আমরা কতটুকু চিনি? 

অর্পণ গুপ্ত

জেমিমা রডরিগেজ জিতে গেলেন।

জিতে গেলেন হরমনপ্রীত কৌর। ডাকাবুকো রিচা ঘোষ।

জেমিমা রডরিগেজ, ভারতের জয়ের কাণ্ডারি

সেমিফাইনাল। প্রতিপক্ষ? অস্ট্রেলিয়া। সেই অস্ট্রেলিয়া, যারা গত ৬ বছরে মাত্র ৫টা ওডিআই ম্যাচ হেরেছে। সেই অস্ট্রেলিয়া, যারা সেমিফাইনালে ওঠার পর, বিশ্বের তাবড় ক্রিকেট অ্যানালিস্টরা অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা, নাকি ইংল্যান্ড-কে ফাইনাল খেলবে, তা ক্যালকুলেট করতে বসে গিয়েছিল! অথচ, ভারতের গড় জনমানসে তাপ-উত্তাপ নেই। বিরাট-রোহিত নেই। পাকিস্তান-বাংলাদেশ খেউড় নেই। মাঠে খেলোয়াড়দের সেলিব্রেশন– অঙ্গভঙ্গি বেচে টু-পাইস কামিয়ে নেওয়ার সুযোগ নেই, উগ্র জাতীয়তাবাদের বিষ নেই। তবে আর উত্তাপ থাকবেই বা কেন? বরং বিহার ইলেকশান-এসআইআর-গরমাগরম দেশপ্রেম কপচানোর বাজার দর বেশি।

জেমিমাদের দুরন্ত জয়ে দর্পচূর্ণ অস্ট্রেলিয়ার

তাও তো জেমিমারা জিতে গেলেন।

অস্ট্রেলিয়ার ওই হলদে বিভীষিকার নেপথ্যে থাকা আরও কত লৌহকপাট ভেঙেচুরে জিতে গেলেন!

ইন্দোরে, হোটেল থেকে ক্যাফে-তে যাওয়ার পথে অস্ট্রেলিয়ার দু’জন মহিলা ক্রিকেটারকে যে ছেলেটা বাইক চালিয়ে এসে অশ্লীল স্পর্শ করে গেল, এই ঘটনায় নির্লজ্জ ভিক্টিম ব্লেমিং করে দেশের যে ক্ষমতাশীল নেতা বলল, মেয়েদের বেরনোর আগে সিকিউরিটিকে ইনফর্ম করা উচিত ছিল– জেমিমারা এদের বিরুদ্ধে জিতলেন, জিতলেন ভারতের সেই মহান অধিনায়কের বিরুদ্ধেও, যিনি বাংলা টক শো-তে এসে দিব্যি বলতে পেরেছিলেন, ‘আমি মনে করি মেয়েদের ক্রিকেট খেলার দরকার নেই…!’

জেমিমা ‘রণংদেহি’ রডরিগেজ

এদেশের প্রতি ঘণ্টায় হওয়া ৪৯টিরও বেশি নারী নির্যাতনের পিছনে থাকা বিকৃতকাম পৌরুষ, এদেশে পণ দিতে না পারার জন্য অত্যাচারে প্রত্যেক বছর খুন হয়ে যাওয়া ৬,৫০০ মেয়ের অসহায় মুখ বুকে নিয়ে জেমিমা-রিচা-হরমন-অমনজ্যোতরা জিতলেন।

জেমিমা সেঞ্চুরি করেও সেলিব্রেট করেননি। তিনি জানেন, খেলা শেষ না হওয়া অবধি তাঁর মুক্তি নেই। ক্লান্ত-অবসন্ন শরীরেও শেষতক লড়াই– এবং জয়! ক্রিকেট দেবতার বরমাল্য এহেন ক্ষেত্রে সবসময় শ্রেষ্ঠ যোদ্ধার গলায় থাকার সৌভাগ্য হয় না, কিন্তু ওই যে, পোয়েটিক জাস্টিস, জেমিমাদের আজ জিতে যাওয়ার পিছনে অজস্র ক্রিকেটীয় বিশ্লেষণ ছাড়াও যা আছে, তা হল, বিশ্বাস।

ভারতের জয়ের কাণ্ডারি: হরমনপ্রীত-জেমিমা

স্মৃতি-রেণুকা-রিচা ঘোষরা জানেন, একটা জয় এদেশের মেয়েদের ভাগ্য বদলে দিতে পারবে না রাতারাতি, কিন্তু একটা জয় ক্রমশ বেড়ে চলা পেট্রিয়ার্কির গালে একটা সপাটে চড় মেরে এদেশের অসংখ্য মেয়েকে দু’-হাতে ঝাঁকিয়ে দিয়ে এই বিশ্বাস গেঁথে দিতে পারবে যে, কেবলই মাংসপিণ্ড হয়ে তিল তিল করে মরা-ই তাদের নিয়তি নয়, হতে পারে না, ট্রেনে-বাসে অস্বস্তিকর স্পর্শ কিংবা বাঁকা চাউনির বিপ্রতীপে একজন জেমিমা, একজন রিচা, একজন স্মৃতি মন্ধানা, আজীবন ছায়ার মতো থেকে যাবেন– আর বারবার বলে যাবেন, এদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম ইনিংসটি বিরাট-রোহিত-শচীন নন, বরং খেলেছিলেন– জেমিমা রডরিগেজ। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম জয়টি এনে দিয়েছিল ১১টি মেয়ে।

আনন্দের অশ্রুধারা: আবেগপ্রবণ জেমিমা, সতীর্থদের মাঝে

স্মৃতির উইকেটের পর উইন প্রেডিক্টরে ভারতকে কার্যত বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল লড়াই থেকে। কেউ দূর কল্পনাতেও হয়তো ভাবেনি, মেয়েগুলো পারবে, জিতবে।

তবু ভারত জিতেছে।

জেমিমা: জেদ-লড়াই-জয়ের প্রতীক

একটু একটু করে পার্টনারশিপের ঢিপির পাশে জমিয়েছে একটা বিশ্বাস– ‘আমরা পারব’। স্কোরবোর্ডের উত্তাপ কমে এলে, ঘৃণার ভারতে, এই বিশ্বাসটুকুই সংক্রমিত হবে।

ধীরে। নিঃশব্দে।

………………..

রোববার.ইন-এ পড়ুন অর্পণ গুপ্ত-র অন্যান্য লেখা

…..…………..