নীরজ চোপড়া এসেছেন এক বিপ্লবের শরিক হতে। আর কে না জানে, বিপ্লব বা বিপ্লবীর জন্ম কখনও রাজপরিবারে হয় না। বিপ্লব যে চিরকালই আম-আদমির অহংকার, মজদুরের হাতিয়ার। নীরজ চোপড়াদের হাতে তাই বর্শাই মানায়।
বর্শা অস্ত্রটাকে ছোট থেকেই বেশ বিকারগ্রস্ত লাগে! বড় একগুঁয়ে। একবগ্গা। শৈশবে যত লোভ আমার ছিল তরোয়াল আর তির-ধনুক নিয়ে। তির-ধনুকের তীক্ষ্মতা, তরোয়ালের আভিজাত্য টানত ভীষণ। মহাভারতে থাকত সব, থাকত বাবর-আকবরের পাতায়। শাণিত তরবারি– শব্দজোড়া শুনলে কেমন রাজ-রাজাদের ব্যাপার বলে মনে হয় না? বর্শার গায়ে সেখানে মজদুর-মজদুর গন্ধ! বল্লমের খোঁচায় পেটের নাড়িভুঁড়ি বের করে দেওয়ার মধ্যে কতটুকুই বা লালিত্য আছে? কতটুকুই বা সাহিত্য আছে, শিল্প আছে?
কিন্তু সেই বর্শাই রাতে এখন ঘুমোতে দেয় না। পানিপথের সোনার ‘গৌর’ বর্শা হাতে মাঝরাত্তিরে জানা-অজানা প্রতিযোগিতায় নামলে ঘুম নিরুদ্দেশের অলিগলিতে হারিয়ে যায়, অসম্ভব টেনশন শেষে চিৎকারের চোটে পাড়া-পড়শির নির্ঘুম রাত কাটে। সময় সময় মনে হয়, নীরজ চোপড়া সত্যি এক অ্যাথলিটের নাম তো? নাকি ভারতের ইতিহাসের এক চলমান সমনাম? যে শত-শত যুগ পরে ফিরে এসেছে এ দেশের পুরনো এক অস্ত্রকে পুনরায় প্রাসঙ্গিক করতে। অ্যাদ্দিনের অবহেলা আর উপেক্ষার জল-কাদা সরিয়ে। হস্তিনাপুর কিংবা পলাশী যুদ্ধের ভারতে নয়। পারমাণবিক শক্তিধর ভারতে। চন্দ্রযানের ভারতে। যে নতুন ভারতে ফিরিয়ে এনেছে এক পুরাতন জয়-অস্ত্রকে, নতুন অবতারে।
জ্যাভলিনের রূপে!
রবিবার রাতে নীরজের নবতম ইতিহাসের পর তাঁর মহাকীর্তির নক্ষত্রমণ্ডলে চোখ গেল। অলিম্পিকে সোনা। কমনওয়েলথে সোনা। এশিয়াডে সোনা। ডায়মন্ড লিগে সোনা। পড়ে ছিল শুধু বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের স্বর্ণ-সিংহাসন, জ্যাভলিন আবাহন করছিল তার শ্রেষ্ঠ সম্রাটকে। এবার তাতেও সোনা! ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে দেখলাম, সুনীল গাভাসকর বলে দিয়েছেন যে, আগামী দশ-পনেরো বছরের মধ্যে ‘স্পোর্টিং নেশন’ হিসেবে ভারতকে চিনবে পৃথিবী। নেপথ্যে যে নীরজের নতুন রাজত্বলাভ, না বললেও চলে। কিন্তু এতে অবাক লাগেনি। নীরজ নিয়ে গাভাসকরের গুণমুগ্ধতা আজকের নয়, বহু পুরনো। নইলে ‘লিট্ল মাস্টার’ কি আর বুড়ো বয়সে হাঁটুর বয়সি অলিম্পিয়ানের মধ্যে নিজের আদর্শকে খুঁজে পেতেন? অস্ট্রেলিয়ার মতো ভারতও যে একদিন ‘স্পোর্টিং নেশন’ হবে, তা-ও মোটে আশ্চর্যের নয়। ক্রীড়া জাগরণের ঊষাকাল যে দিগন্তে বড়ই স্পষ্ট। দেখার চোখ লাগবে শুধু। হকিতে। ব্যাডমিন্টনে। জ্যাভলিনে। ফুটবলে। দাবায়। এ দেশে আর ‘অরক্ষণীয়া’ হয়ে পড়ে নেই অন্য খেলা। এ দেশের সবেধন নীলমণি আর ক্রিকেট নয়। অবাক লাগে বরং নীরজকে দেখে, অবাক লাগে নীরজের কথাবার্তায়। গত রাতে বিশ্বজয়ী হওয়ার পর যে গগনভেদী গর্জন ছেড়েছিলেন নীরজ, তা দিন কয়েক আগে ‘ইসরো’ সেন্টারে শুনেছি। চন্দ্রযানের চন্দ্রে অবতরণের পর! অথচ অলিম্পিকের ‘কোহিনুর’ শোভা পায় তাঁর বাড়িতে, হিরের বদলে সোনা দিয়ে যা তৈরি। আর বিশ্বজয়ী হয়ে নীরজ যা বললেন, তা প্রথম স্বপ্নের তাকে হাত রেখে বলে লোকে। নীরজেরই মতো বলে, ‘দেশের হয়ে আরও পদক জিততে হবে আমায়।’
কিছু করার নেই। নীরজ চোপড়া যে নিছকই অলিম্পিকে সোনা জিততে জন্মগ্রহণ করেননি। নীরজ চোপড়া জন্মগ্রহণ করেননি বিশ্বজয়ীর রত্নসিংহাসনে বসতে। শতবর্ষের সেরা অ্যাথলিট হতেও দেশের কোলে আসেননি নীরজ। তিনি এসেছেন এক বিপ্লবের শরিক হতে। কিংবা স্বয়ং বিপ্লব হতে। আর কে না জানে, বিপ্লব বা বিপ্লবীর জন্ম কখনও রাজপরিবারে হয় না। রাজতন্ত্রের পথ ধরে সে কখনও হাঁটে না। অপমানের ধুলোমাখা ‘আল’ তার চিরাচরিত পথ। বিপ্লব যে চিরকালই আম-আদমির অহংকার, মজদুরের হাতিয়ার।
নীরজ চোপড়াদের হাতে তাই বর্শাই মানায়। নীরজ চোপড়াদের হাত তাই লেখে প্রকৃত বর্শামঙ্গল কাব্য!
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved