‘চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু’ বইটি প্রকাশের পরে পাঠকমহলে যথেষ্ট সাড়া পড়ে যায়। দু’-মলাটের মধ্যে ঋত্বিকের এতগুলো লেখা এর আগে কখনও আসেনি। তবে এ-কাজটিও সুরমা বউদি এবং ঋতবান ঘটকের সাগ্রহ অনুমোদন ছাড়া করা সম্ভব হত না।
ঋত্বিকের মতো বন্ধুর বোহেমিয়ান জীবনচর্চার অনিবার্য পরিণতির দৃষ্টান্ত তো ১৯৮৮-তে টাটকা স্মৃতির দগদগে ঘা। আর নিজের অভ্যন্তরের দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতি আরও জমাট বেঁধে উঠেছে তখন, সমস্যাসংকুল শরীরের তরফে দেওয়া বিবিধ ইঙ্গিতে। তাই প্রয়াণের বছর সাতেক আগে সলিল চৌধুরী ধূমপান বর্জনের উপলব্ধিতেই ক্রমশ জারিত হচ্ছেন।
“সেই মদ্যপানই ঋত্বিকের জীবনের অভিশাপ হয়ে দেখা দিল এবং আমার জীবনেরও বহু অমূল্য মুহূর্তের জলীয় সমাধি ঘটাল। ১৯৪৭ সাল থেকেই ঋত্বিক, মৃণাল (সেন) এবং আমি ছিলাম অবিচ্ছেদ্য বন্ধু।… উত্তর-জীবনে আমি আর ঋত্বিক দু’জনেই বয়ে গেলাম– মৃণালটাই কী করে জানি সচ্চরিত্র রয়ে গেল। মদ ছুঁল না জীবনে।…”
নায়ক নয়, চরিত্রাভিনেতা হওয়ার দিকেই ঝোঁক দিয়েছিলেন তিনি। অসম্ভব ভালোবাসতেন ছবি। নিজের ছবি আঁকার হাতটিও ছিল চমৎকার। ছবির সমঝদার সেই মানুষটি চিঠির সঙ্গে মাঝে মাঝেই এঁকেছিলেন ছবি। সেসব ছবি ও ব্যক্তিগত স্মৃতির ঝলক মিশিয়ে এই লেখা।
বিখণ্ডিত বাঙালি জাতির জন্য কি মিলনান্তিকতা আশা করেছিলেন ঋত্বিক? ‘কোমল গান্ধার’-এ অবুঝ অনসূয়া তো শুরুতে চেষ্টা করেছিল দুই দল একসঙ্গে একটা প্রোডাকশনের ব্যবস্থা করতে, ঋত্বিকের নিজের চিত্রনাট্যেই কি তার পরিণতি শুভ হয়েছিল। মহাকাল যে আরও নির্মম এক চিত্রনাট্যকার।
পাঞ্জাব, বিহার, বাংলা ১৯৪৬-’৪৭ সালে খুনে লাল হয়ে ছিল। দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছেন জয়নুল আবেদিন, চিত্তপ্রসাদ, সোমনাথ হোড়। দাঙ্গায় অবিরাম রক্তস্রোত আঁকলেন না কেন? যাঁরা এঁকেছেন, আগুন জ্বেলেছেন, রক্তের দিকটা ধুয়ে দিয়েছেন।
এখন খানিকটা বুঝতে পারি জীবনানন্দ দাশ কেন তাঁর মাতৃভাষায় ‘জল’ নামের একটি অতিব্যবহৃত শব্দের নিকট ও সুদূর অর্থ বিষয়ে চিন্তিত হয়ে উঠেছিলেন।
প্রথম যুগের চাকুরিরতারা চিরাচরিত সাংসারিক নিয়ম নীতিকে প্রশ্ন করেছিলেন, ছক ভেঙেছিলেন, একটু হলেও বাড়তি গুরুত্ব আদায় করেছিলেন ঘরে বাইরে। উত্তরকন্যাদের চৌকাঠ পেরনো মসৃণ হয়েছিল তাঁদের মা, দিদিমা, ঠাকুমাদের জন্য।
তিনি অভিনেতা হিসেবে সবসময় পার্শ্ব কিন্তু তীক্ষ্ণ। প্রতিনিধিত্ব করেছেন সাধারণের, কিন্তু প্রতিনিধিত্ব করেছেন অসাধারণ। তিনি টলেছেন কম, টলিয়েছেন বেশি। ভারতীয় সিনেমায় তিনি একটা যুগ, যেখানে ক্ষুদ্র ভূমিকা তুচ্ছতার সঙ্গে পরিকল্পিত হত না।
কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে, ১৯৪৮ সালের জুলাই মাসে গ্রেফতার হন রণেন রায়চৌধুরী। ১১ মাস কারাবাস আর ৭ মাস নজরবন্দি থাকার পর মুক্তি পেয়ে, আটক করা বইপত্র ফেরত পেলেও, তার মধ্যে থাকা গানের খাতাগুলি আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। তারপরে ছিন্নমূল হয়ে দেশ ছাড়ার কারণে শুধু স্মৃতিতে থেকে যাওয়া গানগুলিই হয়ে উঠেছিল তাঁর ‘নির্ধনিয়ার ধন’।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved