শুভ্রা যেহেতু মোহনবাগান সমর্থক ছিল, তাই তাঁকে আমার বন্ধু রিকোয়েস্ট করল, বাড়িতে এসে আমাদের ক্লাস নেওয়ার জন্য। কার্যত ইনস্টিটিউটের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়েই বাড়িতে এসে আমাকে ইংরাজি পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে গেল শুভ্রা। বলা যায়, এরপর থেকে কলকাতার অনেক কিছুই শুভ্রার চোখ দিয়ে জেনেছি।
১০.
বারপুজোর আগে যে আই লিগ জয়ের কথা বলছিলাম, সেখান থেকেই শুরু করি।
কেষ্টপুর খাল সংলগ্ন রাস্তা দিয়ে সল্টলেকে বৈশাখীতে পৌঁছতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু মানুষের ভালোবাসার অত্যাচারে বিমানবন্দর থেকে বৈশাখীর ওই সামান্য রাস্তা পার করতে পারছি না! ঠিক ছিল, বাগুইআটিতে আমাদের বাস থেকে নামিয়ে একবার সংবর্ধনা দেওয়া হবে। কিন্তু চারিদিকে তখন লোকে লোকারণ্য, লিগ-জয়ের উন্মাদনায় মাতোয়ারা সমর্থকরা ঘিরে রেখেছে আমাদের বাস, নামবই বা কী করে! সত্যি বলছি, ফুটবলকে কেন্দ্র করে জীবনে অনেক সেলিব্রেশন দেখেছি, কিন্তু ওইরকম পরিবেশ আর কোনও দিন দেখতে পাইনি। আমাদের লিগ জয় ঘিরে এমন উন্মাদনা সৃষ্টি হবে, স্বপ্নেও কল্পনা করিনি!
সেদিনই আমার রাতে ব্রাজিল যাওয়ার ফ্লাইট। গোয়ায় খেলতে যাওয়ার জন্য অনেক দিন কলকাতার বাইরে থাকতে হয়েছে। ফলে লাগেজ কিছুই গোছানো হয়নি। ভেবেছিলাম, সকালেই তো ফিরে যাচ্ছি। বাড়ি পৌঁছে লাগেজ গুছিয়ে নিতে পারব ঠিক সময়ে, সমস্যা কবে না। কিন্তু মানুষের ভিড়ে তখন সে পরিকল্পনা বিশ বাঁও জলে! বাড়িতেই তো পৌঁছতে পারছি না। ফলে ভিতরে ভিতরে টেনশনের চোরাস্রোত বইতে শুরু করল। অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে অবশেষে আমি আর অ্যামাউরি বাড়ি পৌঁছলাম। যখন ঢুকছি, বাড়ির সামনে একপ্রস্থ আবির খেলা চলছে। আমারও রেহাই পেলাম না। আমাকে আর অ্যামাউরিকে যেভাবে পারল সমর্থকরা আবির মাখিয়ে দিল। বৈশাখীতে বাড়ির সামনেটায় ছোট্ট একটা বারান্দা ছিল। সেখানেও আবিরের ছড়াছড়ি। সেই অবস্থাতেই বাড়ির ভিতরে ঢুকলাম। হাতে আর বিশেষ সময় নেই। লাগেজ গোছাব নাকি না মুখের রং তুলব? এর মধ্যে দেবাশিস চলে এসেছে, পরের মরশুমের চুক্তি নিয়ে কথা বলবে। সেইদিন হয়তো সই হবে না। কিংবা অগ্রিম কোনও টাকাও নেব না। কিন্তু পরের মরশুমের জন্য কথাবার্তা পাকা হয়ে যাবে। আর যে কথাটা হবে, সেটাই ফাইনাল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সল্টলেকের ব্রিটিশ ইনস্টিটিউটে ইংরেজি ক্লাস নিত শুভ্রা। মানে শুভ্রা দত্ত। সে জানত না, আমি এসেছি। ‘মোহনবাগানের ব্যারেটো’ এসেছে শুনেই আমার সঙ্গে আলাপ করতে এল শুভ্রা। সেই প্রথম আলাপ। আমার বন্ধু ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝল, তাতে প্রতিদিন প্র্যাকটিস আর ম্যাচ খেলে নিয়মিতভাবে ইংরেজি ক্লাস করা আমার সম্ভব নয়। আর ভাষা শিখতে গিয়ে একটা ক্লাস হাতছাড়া হলে আমার ক্ষতি, কারণ যে অধ্যায় পড়ানো হয়ে গিয়েছে, তা আর নতুন করে পড়ানো হবে না। ফলে ভাষাটা শিখতে সমস্যা হবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভাবলে অবাক লাগে এই মোহনবাগানও একদিন আমাকে ছাড়তে হয়েছিল। সেই গল্প অন্য একদিন বলব। এখনও মনে আছে। এক হাতে ছোট্ট তোয়ালেতে ময়েশ্চারাইজার নিয়ে মুখের রং তুলছি। অন্যদিকে দেবাশিসের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে কথা বলছি। সব পাকা হয়ে যেতে, বাড়ির বাইরে এসে সমর্থকদের দিকে হাত জোড় করে বললাম, এবার আমাকে একটু ফ্রি থাকতে দেওয়ার জন্য। না হলে রাতের ফ্লাইট মিস করব।
বৈশাখীতে এই বাড়িটাতে যেরকম শুরুতে ইগরের সঙ্গে কাটিয়েছি, সেরকম বহু গল্প রয়েছে এই বাড়িটা ঘিরে। যখন আমি মোটামুটিভাবে থিতু হয়ে গিয়েছি, তখন ছোট্ট নাতালিয়াকে কোলে নিয়ে ভেরোনিকা কলকাতায় এল। আমার মতো ভেরোনিকাও ইংরেজি জানে না। ফলে কলকাতায় কোথায় যাব, কী করব, কিছুই বুঝতে পারতাম না। এখন ভাবলে হাসি পায়। ঘরে টোস্ট বানাব, কিন্তু পাউরুটি কেনা নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে পাড়ার দোকানে গেলেই পাউরুটি নিয়ে আসা যায়। আমরা একটা ব্রেড কেনার জন্য বৈশাখী থেকে ট্যাক্সি নিয়ে চলে যেতাম নিউ মার্কেট। তখন আমাদের জীবনে যাবতীয় অগতির গতি ছিল নিউ মার্কেট। টুথপেস্ট কিনতে হলেও ছুটতাম নিউ মার্কেট। কিন্তু ক্রমে বুঝতে পারলাম এভাবে হবে না। এদেশে থাকতে হলে, একটা চলনসই গোছের ইংরেজি রপ্ত করতেই হবে। শেষে এক ব্রাজিলিয়ান-বন্ধুর সঙ্গে ভেরোনিকাকে নিয়ে গেলাম সল্টলেকের ব্রিটিশ ইনস্টিটিউটে। আসলে সবাই বলেছিল, ওখানে গেলে নাকি দৈনন্দিন কাজের কাজ চালানোর মতো চলনসই ইংরেজি শিখে নেওয়া যাবে।
পৌঁছে বুঝলাম, সেখানেও প্রচুর মোহনবাগান সমর্থক। ফলে আমি যেতেই তাদের দেখে মনে হল হাতে চাঁদ পেয়েছে! সবাই ক্লাস ছেড়ে আমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছুক। কিন্তু আমি চুপ করে আছি। সল্টলেকের ব্রিটিশ ইনস্টিটিউটে ইংরেজি ক্লাস নিত শুভ্রা। মানে শুভ্রা দত্ত। সে জানত না, আমি এসেছি। ‘মোহনবাগানের ব্যারেটো’ এসেছে শুনেই আমার সঙ্গে আলাপ করতে এল শুভ্রা। সেই প্রথম আলাপ। আমার বন্ধু ইনস্টিটিউটের সঙ্গে কথা বলে যা বুঝল, তাতে প্রতিদিন প্র্যাকটিস আর ম্যাচ খেলে নিয়মিতভাবে ইংরেজি ক্লাস করা আমার সম্ভব নয়। আর ভাষা শিখতে গিয়ে একটা ক্লাস হাতছাড়া হলে আমার ক্ষতি, কারণ যে অধ্যায় পড়ানো হয়ে গিয়েছে, তা আর নতুন করে পড়ানো হবে না। ফলে ভাষাটা শিখতে সমস্যা হবে।
তখন একটা বুদ্ধি বের করল আমার বন্ধু। শুভ্রা যেহেতু মোহনবাগান সমর্থক ছিল, তাই তাঁকে আমার বন্ধু রিকোয়েস্ট করল, বাড়িতে এসে আমাদের ক্লাস নেওয়ার জন্য। কার্যত ইনস্টিটিউটের নিয়মের বিরুদ্ধে গিয়েই বাড়িতে এসে আমাকে ইংরেজি পড়ানোর জন্য রাজি হয়ে গেল শুভ্রা। বলা যায়, এরপর থেকে কলকাতার অনেক কিছুই শুভ্রার চোখ দিয়ে জেনেছি। আর দীপেন্দু। ওর সঙ্গে মাঝে মধ্যে নাতালিয়া আর ভেরোনিকাকে নিয়ে নিকো পার্কে ঘুরে যেতাম। এভাবেই আস্তে আস্তে কলকাতা আমার জন্য পরিচিত হতে শুরু করল।
তবে প্রতি রবিবার সকালে পার্ক স্ট্রিটের ‘অ্যাসেম্বলি অব গড চার্চ’-এ যাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল আমার। মানে যাওয়া চাই-ই, চাই। রবিবার সকালে প্রভু যিশুর প্রার্থনা ওখানেই সারতাম, সেটা অবশ্যই কলকাতায় থাকলে। আর ম্যাচের দিন সকালে নিয়ম করে বাইবেল পড়া তো থাকতই।
(চলবে)
অনুলিখন: দুলাল দে
…তোতাকাহিনি-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। বারপুজোয় সমর্থকদের ভালোবাসার হাত থেকে বাঁচতে দৌড় লাগিয়েছিলাম টেন্টের দিকে
পর্ব ৮। মাঠে তো বটেই, ইয়াকুবু বাথরুমে গেলেও ফলো করবে স্যালিউ
পর্ব ৭। আর একটুর জন্য হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছিল জাতীয় লিগ জয়
পর্ব ৬। জাতীয় লিগের প্রথম ম্যাচেই বেঞ্চে বসে রইলাম
পর্ব ৫। আশিয়ানের আগে সুভাষ ভৌমিক প্রায়ই ফোন করত আমাকে, বোঝাত ইস্টবেঙ্গলে সই করার জন্য
পর্ব ৪। আর একটু হলেই সই করে ফেলছিলাম ইস্টবেঙ্গলে!
পর্ব ৩। মোহনবাগানের ট্রায়ালে সুব্রত আমায় রাখত দ্বিতীয় দলে
পর্ব ২। কলকাতায় গিয়েই খেলব ভেবেছিলাম, মোহনবাগানে ট্রায়াল দিতে হবে ভাবিনি
পর্ব ১। ম্যাচের আগে নাইটপার্টি করায় আমাকে আর ডগলাসকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ক্লাব
জাতি হিসেবে বাঙালি নির্বাক ছিল না কখনও, তার শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির দিকচিহ্নগুলিকে আবারও নতুন করে ফিরে দেখা সম্ভব হবে, বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে। পৃথিবীর তাবৎ সংস্কৃতি গবেষণার চিন্তন-ভূগোলে বাংলা ভাষা এবং বাঙালি সাংস্কৃতিক নতুনতর মাত্রা যোগ করবে– এ দাবি অহেতুক নয়।