উত্তর দিতে গিয়ে পড়লাম ফাঁপরে। বলার চেষ্টা করলাম, বহিরঙ্গের চেয়ে অন্তরের সৌন্দর্য যে আসল তাই-ই তো বলা গানটায়। শুধু মেয়েদের নিয়ে লেখা নয়। ঋতুদার এই কথাটা মনে ছিল বহুদিন। যেদিন ছেলেদের জন্য ফেয়ারনেস ক্রিম বেরল, তখন এ গান ছেলেদের উৎসর্গ করেই গাইতাম। ফলে ‘তানা না’ দেওয়ার সময় একটা দ্বিধা কাজ করছিল। শিল্পমানে না উতরোক, লাইভ স্টেজে গানটা ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। শেষমেশ ‘চ’ অ্যালবামে ছিল গানটা। সারাজীবন বহু নিন্দে-মন্দ শুনেছি গানটায়, ঋতুদার কাছেও। কমবয়সের কিছু হঠকারি পদক্ষেপ থাকে। এখন ফিরে দেখলে ওই সিদ্ধান্তর জন্য লজ্জা লাগে খুব।
৩১.
‘তারা’-র তার কেটে গিয়েছিল অনেক দিনই। কাজকম্ম সবই করছি, কিন্তু ঠিক জমছে না টাইপ। পুজোর প্রোমোগুলো অবশ্য কিছুটা প্রশংসা পেয়েছিল। অস্বীকার করে লাভ নেই, মূল আইডিয়াটা পুরোটাই ঝাড়া। ঋতুদা যে সময় ‘রেসপন্স’-এ, একটা বিজ্ঞাপন ডিজাইন করেছিল, সাধারণ মানুষকেই ভগবান সাজিয়ে। মানে কার্তিকের পুজো বলতে আসলে কার্তিক নামের এক শিশুশ্রমিকের ভাবা হয়েছিল। ক্যাম্পেনটা জনপ্রিয় হয়েছিল বেশ। এর অনেক বছর পর তারা-র জন্য আমি যে প্রোমো ক্যাম্পেন করলাম, তা অডিও-ভিস্যুয়াল, কিন্তু ভাবনাটা ওই একইরকমের। আমার গণেশ করেছিল বাবজি, তখন সবে তারা-তে এসেছে, কম্পিউটারের মাউস নিয়ে ব্যবসার ডায়লগ বলেছিল, কার্তিক রোডসাইড রোমিও, মেয়েদের পাত্তা না দেওয়া নিয়ে আক্ষেপ করেছিল– সেই রোলটায় দারুণ মানিয়েছিল দেবজ্যোতিকে। বাবজি এখন স্টেজ পারফর্মার, দেবজ্যোতি নামজাদা গদ্যলেখক। লক্ষ্মী হয়েছিল কলেজের বন্ধু অদিতি, লক্ষ্মীপ্রতিমার মতোই মুখশ্রী তার, রোলটা ছিল বাড়ির ব্যস্ত গিন্নির। আর সরস্বতী হয়েছিল কলেজের রিসার্চ স্কলার উষসী চক্রবর্তী– তখনও এত বড় নায়িকা হয়নি সে। সকলেই বিনা পারিশ্রমিকে এককথায় করে দিয়েছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
একটি জিনিস লাহিড়ীদা বলছে, যে ক্যাসেট বস্তুটি নাকি আস্তে আস্তে উঠে যাবে। ব্যাপারটা বুঝতেই পারছি না। ক্যাসেট বিক্রির খতিয়ান দিয়ে একজন শিল্পীর জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়, যদি সেই মহার্ঘ্য টেপই গায়েব হয়ে যায়, মানুষ শুনবে কী উপায়? শোনা যাচ্ছে, বিদেশের মার্কেট ‘সিডি’ বলে একটা কিছু দখল করে নিয়েছে– পুরো নাম ‘কমপ্যাক্ট ডিস্ক’। একটু বেশি দামি, মহুয়া বলছে, ক্যাসেট হিট হলেই আমাদেরও ডিস্ক বেরবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তখনও পর্যন্ত অডিও-ভিস্যুয়াল-এর একটা কৌলিন্য, সম্ভ্রম, ঠাঁটবাট যথেষ্ট ছিল। মোবাইল এসে যে রিলস বানিয়ে একদিন তাকে ছ’গোল দেবে, বোঝা যায়নি। ও, দুগ্গাঠাকুরের কথা বলা হয়নি। আমার দুগ্গা, কল্পনায় কিশোরী এক কন্যা, সদ্য আলতা পরা পায়ে সে হেঁটে যাবে গভীর কাশবনের ভেতর। ‘আজকাল’-এর এককালের সহকর্মী ও দাদা– অলোকপ্রসাদদাকে অনুরোধ করেছিলাম যদি তার বাচ্চা মেয়েটিকে এই প্রোমোয় অভিনয় করানো যায়। মোহরের তখন কতই বা বয়স– দশ বা এগারো হবে– কী সুন্দর করেছিল, আর তেমন অমলিন এক সারল্য ছিল চোখে। বড় হয়ে সেই মেয়েও যে ডাকসাইটে অভিনেত্রী হবে বুঝিনি, নাসিরুদ্দিন কিংবা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে সমানতালে অভিনয় করা সেই দুগ্গাকন্যা এখন নায়িকা অমৃতা চট্টোপাধ্যায়, যদিও ‘মোহর’ নামটা আমার বেশি পছন্দের।
তারা থেকে ছুটি নিয়ে আমাদের চতুর্থ অ্যালবামের কাজ শুরু করে দিয়েছি। রেকর্ডিং হচ্ছে কালিন্দির একটি স্টুডিও’য়– নাম ‘সোপ্রানো’। একসময়ের খুব নামী গায়ক তপন সিংহের স্টুডিও। ক্যাসেট প্রকাশ করবে আশা অডিও এবং এই বছর কোনও অজানা কারণে তারা আমাদের ওপর পেল্লায় খুশি! যতদিন ইচ্ছে স্টুডিও ব্যবহার করতে বলছে, প্রচুর প্রশংসা করছে– আমরা নিজেরাই ঘাবড়ে যাচ্ছি এসব শুনে! আর একটি জিনিস লাহিড়ীদা বলছে, যে ক্যাসেট বস্তুটি নাকি আস্তে আস্তে উঠে যাবে। ব্যাপারটা বুঝতেই পারছি না। ক্যাসেট বিক্রির খতিয়ান দিয়ে একজন শিল্পীর জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়, যদি সেই মহার্ঘ্য টেপই গায়েব হয়ে যায়, মানুষ শুনবে কী উপায়? শোনা যাচ্ছে, বিদেশের মার্কেট ‘সিডি’ বলে একটা কিছু দখল করে নিয়েছে– পুরো নাম ‘কমপ্যাক্ট ডিস্ক’। একটু বেশি দামি, মহুয়া বলছে, ক্যাসেট হিট হলেই আমাদেরও ডিস্ক বেরবে। এইসব ধোঁয়াটে কথাবার্তায় মন না দিয়ে ক্যাসেটে মন দিই।
এই প্রথম চন্দ্রবিন্দুর ক্যাসেটে একটা আস্ত গান গাইবে সোনা, যার গালভরা নাম অরুন্ধতী, কলেজ ফেস্ট থেকেই ওর গানের খুব ভক্ত আমরা। যে গানটা গাইবে, নাম ‘আদরের নৌকো’, চন্দ্রিলের লেখা, উপলের সুর। প্রথমবার রেকর্ড করা হবে ‘ভিনদেশি তারা’, বারবার মনে হচ্ছে, এ গানটা না দিলেও মনে হয় চলত, বাকি গানগুলোর পাশে খুব বেমানান না লাগে! উপল আবার বলেছে, এ গান একবারে গাইতে হবে, বারবার টেক করলে এসেন্সটা নষ্ট হয়ে যাবে, তাই যা হবে, একদানে। একটা ঘরে লাইভ গিটার বাজাবে সুরজিৎ, অন্য কনসোলে আমি গানটা গাইব। তাল ছাড়া, ছন্নছাড়া এক গান। প্রতি চন্দ্রবিন্দু ক্যাসেটে একটা করে আমরা কলেজ ক্যান্টিনের গান রাখতাম। মনে করতাম, ওটাই রুট, আইডেন্টিটি। ‘সুইটহার্ট’ থেকে ‘বাথরুম’– সেভাবেই এসেছে। এবারে হাতে আছে ‘তা না না’ গানটা। স্কটিশ কলেজের ফ্রেশার্স ওয়েলকামে বানানো গান। ভীষণই কাঁচা ও সেক্সিস্ট একটা গান। এই ‘সেক্সিস্ট’ শব্দটাও তখন সদ্য শেখা। নারীদের নিয়ে ব্যঙ্গ করা গান। পলিটিক্যালি ইনকারেক্ট। মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘এবং ঋতুপর্ণ’ অনুষ্ঠানে আমরা গেস্ট হয়ে গিয়েছি। সেই প্রথম বাংলা ব্যান্ড এমন অনুষ্ঠানে। ঋতুদা একথা-সেকথার পর আমায় ধরল ‘ত্বকের যত্ন নিন’ গানটা নিয়ে। এ গান সেক্সিস্ট, ছেলেদের নিয়ে এর’ম গান লিখতে পারবি তুই? উত্তর দিতে গিয়ে পড়লাম ফাঁপরে। বলার চেষ্টা করলাম, বহিরঙ্গের চেয়ে অন্তরের সৌন্দর্য যে আসল, তাই-ই তো বলা গানটায়। শুধু মেয়েদের নিয়ে লেখা নয়। ঋতুদার এই প্রশ্নটা মনে ছিল বহুদিন।
যেদিন ছেলেদের জন্য ফেয়ারনেস ক্রিম বেরল, তখন এ গান ছেলেদের উৎসর্গ করেই গাইতাম। ফলে ‘তা না না’ দেওয়ার সময় একটা দ্বিধা কাজ করছিল। শিল্পমানে না উতরোক, লাইভ স্টেজে গানটা ভীষণ জনপ্রিয় ছিল। শেষমেশ ‘চ’ অ্যালবামে ছিল গানটা। সারাজীবন বহু নিন্দে-মন্দ শুনেছি গানটার, ঋতুদার কাছেও। কম বয়সের কিছু হঠকারি পদক্ষেপ থাকে। এখন ফিরে দেখলে ওই সিদ্ধান্তর জন্য লজ্জা লাগে খুব। আরও লজ্জা লাগে, এমন গান প্রকাশ করেছিলেন স্বয়ং শঙ্খ ঘোষ। সঙ্গে ঋতুপর্ণ ঘোষ। সে আর এক কেলোর কীর্তি!
(চলবে)
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?