কবিতা! জামিল রন্জ্বারের জীবন! মুক্ত পাখির মতো উড়তে ভালোবাসতেন যে জামিল, তাঁর সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখাই হয়েছে ইরাকের কুখ্যাত আবু ঘ্রেব কারাগারে। আর অনেকটাই উত্তর ইরাকের পাহাড়ে ঘেরা পেশমেরগা ঘাঁটিতে। পেশমেরগা মানে যে মৃত্যুর জন্য তৈরি। তাই আকাশপথে মৃত্যু এসে একদিন ডেকে নিয়ে গেল তাঁকে। নিচের কবিতাটাই, সম্ভবত, শাহাদাতের আগে জামিলের লেখা শেষ কবিতা।
১৩.
জামিল রন্জ্বার। ইরাকি কুর্দিস্তান
‘পেশমেরগা’ মানে যে মৃত্যুর জন্য তৈরি। এটা কুর্দি শব্দ। কুর্দদের কোনও দেশ নেই। শুধু কিছু ভূমিখণ্ড আছে। ইরাক, ইরান, সিরিয়া আর তুরস্ক— এই চারটে দেশের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। কুর্দরা তাকে ‘কুর্দিস্তান’ বলে ডাকে। কেউ মানে, বেশির ভাগই তা মানে না। প্রত্যেক দেশেই তাদের দমিয়ে রাখার, না হলে গুঁড়িয়ে দেওয়ার, চেষ্টা অব্যহত থাকে। চারটে দেশেই তাই কুর্দরা লড়ে চলে। সিলারের পাপড়ির মতো কোমল ভালোবাসা আর ওকের গুঁড়ির দৃঢ়তা নিয়ে প্রতিদিন তারা পেশমেরগা হয়ে ওঠে। জামিল রন্জ্বার-এর মতো।
আসল নাম জামিল সালেহ্ আজিজ। উত্তর ইরাকের কুর্দ-অধ্যুষিত অঞ্চলের এক গ্রামে ১৯৪৭-এ জন্ম। ১৯৫৭-য় পরিবারের সঙ্গে ইরাকি কুর্দিস্তানের রাজধানী আরবিলে চলে আসা। পড়াশোনা করতে এসে কুর্দিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া। পড়া শেষ করে শিক্ষকতার চাকরি। ততদিনে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়েছেন ‘কুর্দ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি’র সঙ্গে। ঘর পেতেছেন সহ-শিক্ষক সাদাতির সঙ্গে, অন্যদিকে উঠে এসেছেন আরবিলের ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সংগঠনের দায়িত্বে। গোড়া থেকেই বাথ পার্টি সরকারের গোয়েন্দাদের শ্যেন-নজর পড়ল তাঁর ওপর, থোড়াই পরোয়া তাতে!
জামিল খুব হাসিখুশি মানুষ ছিলেন একজন। বন্ধুদের সঙ্গে হই-হই করে গাইতে, নাচতে ভালোবাসতেন। জীবনসঙ্গিনী সাদাতি স্মৃতিচারণ করেছেন— ‘খেতে, এবং ভাগ করে খেতে, বড্ড ভালোবাসতেন জামিল। প্রত্যেকবার জেলখানায় নতুন কিছু রান্না করে নিয়ে যেতাম ওর জন্য, আর প্রতিবারই দেখতাম একটা কবিতা হাতের মুঠোতে নিয়ে তৈরি হয়ে আছে। কবিতাটা আমাকে দিত, আর আমি অবধারিতভাবে দিতাম আমার মেয়ের হাতে গুঁজে, যাতে জেল গেটে কবিতাটাকে আটকাতে না পারে।’
কবিতা! জামিল রন্জ্বারের জীবন! মুক্ত পাখির মতো উড়তে ভালোবাসতেন যে জামিল, তাঁর সবচেয়ে বেশি কবিতা লেখাই হয়েছে ইরাকের কুখ্যাত আবু ঘ্রেব কারাগারে। আর অনেকটাই উত্তর ইরাকের পাহাড়ে ঘেরা পেশমেরগা ঘাঁটিতে। পেশমেরগা মানে যে মৃত্যুর জন্য তৈরি। তাই আকাশপথে মৃত্যু এসে একদিন ডেকে নিয়ে গেল তাঁকে। নিচের কবিতাটাই, সম্ভবত, শাহাদাতের আগে জামিলের লেখা শেষ কবিতা।
কুর্দ মেয়ের হাতে বোনা কার্পেটের মতো
শেষ সূর্যের আলো পাহাড়ের খাত বেয়ে গড়িয়ে পড়লে
চব্বিশজন পেশ্মেরগার ডিউটি বদল হয়।
এরপর তাদের গাইতে গাইতে খানা পাকানো আর
খেতে খেতে গান গাওয়ার সময়… মাঝরাত অবধি।
পাহাড় ওপর আকাশ জেগে থাকবে
পাহাড়ের নিচে পুরো দেশটা ঘুমোতে যাবে এখন।
ঘুমোও স্বভূমি! প্রতিটা পাহাড়ে আর টিলায়
চব্বিশজন করে পেশ্মেরগা জেগে পাহারা দিচ্ছে
যাতে কেউ তোমার ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায়।
আকাশের পুরোটা একদিন পরিষ্কার হয়ে যাবে
সবকটা তারা ঝকঝক করে উঠবে আর
পুরো দেশটার ওপর থেকে কালো ছায়া সরে যাবে
চিরতরে। ততক্ষণ চব্বিশজন পেশ্মেরগা দ্যাখো
ছেঁড়া বুট আর চলটা ওঠা রাইফেলের কুঁদো
ঠুকে ঠুকে কেমন গান গেয়ে চলেছে…
যাতে কেউ তোমার কাছ না ঘেঁষতে পারে।
…পড়ুন কবি ও বধ্যভূমি…
পর্ব ১২: ডানার পালকে সূর্যকে নিয়ে…
পর্ব ১১: প্রিয় কমরেড, এসো একসাথে মরি
পর্ব ১০: প্রাণভিক্ষা? বেছে নিই মৃত্যুর অহংকার বরং!
পর্ব ৯: তিমিরের অন্তে যদি তিমিরবিনাশ
পর্ব ৮: অক্সিজেন মৃতদের জন্য নয়!
পর্ব ৭: আকাশে তারারা জ্বলছে, ফ্যলাস্তিনকে ভয় দেখিও না!
পর্ব ৬: কোথায় লুকোবে কালো কোকিলের লাশ?
পর্ব ৫: আমার দুঃখের কথা কি পাথরকে বলব?
পর্ব ৪: আমি সেই মেয়ে, যে আর ফিরবে না
পর্ব ৩: আমাকে পোড়াতে পারো, আমার কবিতাকে নয়!
পর্ব ২: এস্তাদিও চিলে আর চল্লিশটা বুলেটের ক্ষত
পর্ব ১: বিপ্লব, প্রেম ও কবিতাকে আমৃত্যু আগলে রেখেছিলেন দ্রোণাচার্য ঘোষ