ঋতুদার বাড়ি গিয়ে দেখলাম বাড়ি জুড়ে শোরগোল! তার মানে সিনেমার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঋতুদার মনমেজাজ খুশ। ‘মধুরেণ’ থেকে শিঙাড়া এল, মিষ্টিও। ‘কবে শুরু করছ?’ ‘এখনও জানি না রে। আর একটু লেখা বাকি।’ ‘কী বিষয়? প্রেম?’ ঋতুদা হাসল। আন্দাজ করে বল। চেষ্টা করলাম এটা-সেটা, কোনওটাই লাগল না। ‘আরে বাবা, তুমিই বলে দাও না।’ মন্টুদা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছিল। সে-ই রহস্য ফাঁস করল। এইবার ডিফেক্টিভ সিনেমা বানাবে ঋতু। ডিফেক্টিভ মানে!
৩৬.
মিলেনিয়ামের দোরগোড়ায় আমি একটু উঠে দাঁড়ানোর সাহস পেলাম। ‘চ’ অ্যালবাম নিয়ে তখনও তোলপাড় চলছে! বাড়িতে ফোন আসার সংখ্যা বাড়ছে। ততদিনে বাড়ির কমন ফোন-এর বাইরে নিজের একটা টেলিফোন হয়েছে। মোবাইল নয়– ল্যান্ডলাইন। ফ্যানদের ফোনের সংখ্যাও দিনে দিনে বাড়ছে। এই আশ্চর্য দিনবদলে আমার মনে হল, এবার কিছু একটা করা উচিত। ঋতুদার বাড়ি গেলাম।
‘এবার চাকরিটা সত্যি ছাড়ছি কিন্তু!’
ঋতুদা হাসল। ‘আগে ছাড়, তারপর জানাস। বহুবার এই এক কথা শুনে শুনে কান পচে গেছে।’
তারপর একঘণ্টা ধরে প্রবল বকা দিল! কারণ, আমাদের গান গাওয়া। ‘‘তোর, উপল দু’জনের উচ্চারণই খারাপ। একজন বাঙাল, একজন খাস কলকাত্তাইয়া ঘটি। এত সুন্দর সব গান, উচ্চারণটা তো কানে লাগে না কি!’
খেপে গিয়ে বললাম, ‘কী খারাপটা করেছি?’
‘‘ভিনদেশি তারা শোন। তোমার কীসের এত তাড়া– ড-এ শূন্য ড়’টা ভাল করে বলতে হবে তো?’’
আমি তর্ক করে গেলাম সমানে। ‘যখন ল্যাটিন গায়কদের গান শোনো, কই তখন তো ইংরেজি উচ্চারণের ভুল ধরো না। আমাদের উচ্চারণ আলাদা, সেটাই মানুষ ভালোবাসছে।’
ঋতুদা আরও নানাবিধ যুক্তিজাল শানিয়ে, ১২১টা রবীন্দ্রসংগীতের উদাহরণ দিয়ে গলা তুলে চেঁচিয়ে গেল। এরপর বেশ কিছুদিন ঋতুদার বাড়ি যাইনি। এক সপ্তাহ পর ঋতুদার ফোন, ‘তুই রাগ করেছিস?’
আমি হেসে ফেললাম, গান নিয়ে ঝগড়া মিটে গেল। আমি একটু পিছনে লাগার জন্য বললাম, ‘তোমার চোখের বালি কি বালিচাপা পড়ে গেল?’
ঋতুদার গলাটা আনমনা শোনাল। ‘প্রচুর বাজেট হয়ে যাচ্ছে রে! বাংলায় কে করবে বল? ভাবছি হিন্দি করে দিই। তাহলে প্রোডিউসার পাব।’
আমি শঙ্কিত হয়ে উঠলাম। ‘হিন্দিতে চোখের বালি?’
আমায় বলল, ‘তুই একদিন সময় নিয়ে আয়। অন্য একটা ছবির স্ক্রিপ্ট লিখছি, গল্পটা শোনাব।’
‘উফ্ফ, আবার একটি লিখে ফেলেছ!’
ঋতুদা হাসল। ‘তাড়াতাড়ি আয়।’
তারা-র কাজে ব্যস্ত ছিলাম বেশ কিছুদিন। ফলে যেতে দেরিই হল। গিয়ে বুঝলাম বাড়ি জুড়ে শোরগোল! তার মানে সিনেমার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ঋতুদার মনমেজাজ খুশ। ‘মধুরেণ’ থেকে শিঙাড়া এল, মিষ্টিও।
‘কবে শুরু করছ?’
‘এখনও জানি না রে। আর একটু লেখা বাকি।’
‘কী বিষয়? প্রেম?’
ঋতুদা হাসল, ‘আন্দাজ করে বল।’
চেষ্টা করলাম এটা-সেটা, কোনওটাই লাগল না।
‘আরে বাবা, তুমিই বলে দাও না।’
মন্টুদা পাশে বসে মিটিমিটি হাসছিল। সে-ই রহস্য ফাঁস করল। এইবার ডিফেক্টিভ সিনেমা বানাবে ঋতু। ডিফেক্টিভ মানে! মন্টুদার স্বভাব ছিল যে কোনও বিষয় নিয়ে মজা করা। আমি আরও ঘোল খেয়ে গেলাম। আমার দশা দেখে হাসতে হাসতে ঋতুদা বলল, ‘ডিটেকটিভ ছবি করছি বলে মন্টুদা এইসব বলে যাচ্ছে।’ আমি তো পুরো হাঃ! ঋতুদা বানাবে গোয়েন্দা ছবি? তামাম বাঙালি যে লোকটার ইমোশন দেখে এত বড় প্রোমোশন দিল, সে বানাবে হুডানইট! ইয়ার্কি হচ্ছে!
ঋতুদা বলল, ‘গোয়েন্দা মানেই ছেলে হতে হবে কে বলল? আমার ডিটেকটিভ মহিলা।’
‘ও, তার মানে ফেলুদি কোনও?’
‘শুধু কমবয়সি হবে কেন, মাসিমা-পিসিমা কেউ গোয়েন্দা হতে পারে না বুঝি?’
বোঝো ঠ্যালা, মাসিপিসি ডিটেকটিভ নিয়ে ঋতুদা ছবি করছে শেষে! শেষমেশ ঝেড়ে কাশল পুরো ব্যাপারটা। আগাথা ক্রিস্টির ‘দ্য মিরর ক্রাক্ড’ গল্পটা নিয়ে একটা বাংলা ছবি। ‘পড়েছিস বইটা?’ মাথা নাড়লাম। ইংরেজি বই পড়ার অভ্যেস এমনিই আমার কম। ‘তবে গল্পটা শোন।’ গড়গড় করে গল্প শোনাতে শুরু করল। বলার ভঙ্গিটা ঋতুদার চিরকালই সুন্দর। মন দিয়ে শুনছিলাম গল্পটা। সিনেমার নাম দেওয়া হয়েছে– ‘রাঙাপিসিমা’।
‘কে করবেন?’
‘কথা চলছে, দেখা যাক।’
‘ভাইঝির রোলটার জন্য জুনকে ভেবেছি।’
‘জুন মালিয়া?’
মন্টুদা বলল, ‘হ্যাঁ, আনন্দবাজার যাকে মাল্যদান করেছেন।’
আবার একচোট হাসি!
‘পুলিশটা কে করছে?’
‘ভাবছি, রাজেশ শর্মা, কেমন হবে?’
রাজেশ আমার ভীষণ পছন্দের অভিনেতা, হইহই করে বললাম, ‘দারুণ। অন্য ছেলেটা?’
‘ও, শুভঙ্কর। মনে হচ্ছে রনি (রজতাভ দত্ত) করবে। গল্পটা শুনে গেছে ও। যদি কোনও কারণে না হয় তাহলে বাবান (কৌশিক সেন)।’
প্রচুর গপ্প মেরে বাড়ি ফিরলাম সেদিন। ঋতুদার গোয়েন্দা ছবি বানানোর ব্যাপারটায় তখনও ঠিক কনভিনস্ড নই।
এর কিছুদিন পর, দুমদাম কিছু ঘটনা ঘটল। এক দুপুরে অফিস গিয়ে তারা-র চাকরিটা ছাড়লাম। একটু মনখারাপ লাগছিল শেষদিন, কিন্তু ছাড়তে একদিন না একদিন হতই। চাকরি ছাড়ার পরদিনই ফোন পেলাম দেবাশিসের। অভিনন্দন জানিয়েই পরের প্রশ্ন, ‘ব্ল্যাকম্যাজিক’ জয়েন করবি? ওই সময়টায় এই নামটারই এক অন্য ম্যাজিক ছিল। রংগন চক্রবর্তী, অর্ঘ্যকমল মিত্র– বড় বড় সব নাম। বাংলা কনটেন্টের একটা নতুন দিশা দেখাচ্ছে ব্ল্যাকম্যাজিক। একটু অবাক হয়ে থেকে বললাম, ‘কী করব?’ দেবাশিস বলল, ‘যা করছিলিস এতদিন।’ ‘ডিরেক্ট করবি, নতুন প্রোগ্রাম প্ল্যান করবি, স্ক্রিপ্ট লিখবি– যা ইচ্ছে করে তোর!’ চোয়াল শক্ত করে বললাম, ‘করব।’
এ-ও হয়তো ওই সময়টার ম্যাজিক। চাকরি ছাড়ার পরদিনই নতুন চাকরির প্রস্তাব। দেবাশিস জানাল, ইন্টারভিউ দু’দিন পর। রংগনদা আর অর্ঘ্যদা নেবে। সেই প্রথম ব্ল্যাকম্যাজিক অফিসটায় পা রাখা। ওইরকম অবাক করা, রোদ্দুরে ভেসে যাওয়া একটা কাঠের মেঝে দেখা। রংগনদা আর অর্ঘ্যদা ইন্টারভিউ ঠিক নিল না। গল্প করল। কী করা যায় নতুন কিছু, এইসব। ফলে আমিও সহজভাবে অনেক কথা বললাম। এ-ও বললাম, চন্দ্রিল যদি জয়েন করে তাহলে একসঙ্গে কাজগুলো আরও ভালোভাবে করা যাবে। ওরা মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে বলল, ‘কিন্তু ও কি চাকরি করবে?’ আমি জোরের সঙ্গে বললাম, ‘আমি চন্দ্রিলকে বলব।’
আমি-চন্দ্রিল-দেবাশিস– দারুণ টিম হবে! রংগনদার কথা বলার ভঙ্গি খুব স্পষ্ট, চাঁচাছোলা ভাষায় জানাল, কত স্যালারি দিতে পারবে। তারা-র চেয়ে সামান্য বেশি। তা হোক, এর’ম একটা অফিস, হাতে জলজ্যান্ত চাকরি। মিন্টো পার্ক থেকে বেরিয়েই চন্দ্রিলের বাড়ি। তার বোধহয় দু’দিনের মধ্যে চন্দ্রিল জয়েন করে ব্ল্যাকম্যাজিক। উত্তাল একটা খুশি চলছে মনের ভেতর। অনেক কিছু নতুন ঘটতে শুরু করেছে।
একব্যাগ খুশির খবর নিয়ে ঋতুদার বাড়ি এলাম। নতুন চাকরি পেয়েছি ব্ল্যাকম্যাজিকে। ঋতুদার মুখ দেখে কেমন যেন আনমনা লাগল। আমি উত্তেজিত হয়ে বলে চলেছি নানা গল্প।
আমার সব উত্তেজনায় জল ঢেলে ঋতুদার গলা ভেসে এল– ‘অনিন্দ্য, তুই শুভঙ্করের চরিত্রটা করবি প্লিজ?’
…ঋইউনিয়ন-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৩৫: চন্দ্রবিন্দুর কোনও কাজ কি নির্বিঘ্নে হবে না!
পর্ব ৩৪: বিলক্ষণ বুঝতে পারছি, চ অ্যালবামটা মাথা খাচ্ছে ঋতুদার
পর্ব ৩৩: হাতে মাইক আর হাতে বন্দুক– দুটোই সমান বিপজ্জনক!
পর্ব ৩২: ‘চ’ রিলিজের সময় শঙ্খবাবু আমাকে দু’টি কড়া শর্ত দিয়েছিলেন
পর্ব ৩১: ত্বকের যত্ন নিন সেক্সিস্ট গান, বলেছিল ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩০: বাতিল হওয়া গান শোনাতে কার ভালো লাগে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৯: সামান্য দরকার থাকলেই মাথাখারাপ করে দিত ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৮: পত্রিকার ক্যাচলাইনের মতোই এডিটরের মুডও ক্ষণে ক্ষণে পাল্টায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৭: জয়দেব বসু ছাড়া আর কেই বা ছিল কলকাতার সঙ্গে মানানসই?
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৬: পাহাড় থেকে নেমে আসার আগে মিঠুনদা একদিন রান্না করে খাওয়াবেন– খবরটা চাউর হয়ে গেল
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৫: মেঘে ডুবে গেল শুটিং ইউনিট, শুরু হল গোধূলি সন্ধির গীতিনাট্য
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৪: মিঠুনদার উত্তাল সত্তরের গল্পে আমাদের অলিগলি মুখস্ত হয়ে যেত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২৩: প্রথম টেকে মিঠুনদা ফলস খেলেন!
ঋইউনিয়ন পর্ব ২২: মানুষ কালীভক্ত হয়, ঋতুদা শুধু লি ভক্ত
ঋইউনিয়ন পর্ব ২১: শুনলাম কঙ্কনা না কি খুবই নার্ভাস, ‘ঋতুমামা’র ছবি করবে বলে
ঋইউনিয়ন পর্ব ২০: ইউনিটে একটা চাপা উত্তেজনা, কারণ মিঠুন চক্রবর্তীর আসার সময় হয়ে গিয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৯: যে সময় ‘তিতলি’র শুটিংকাল, তখন পাহাড়ে ঘোর বর্ষা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৮: চিত্রনাট্য পড়ে শোনাল ঋতুদা, কিন্তু ‘চোখের বালি’র নয়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৭: তুই কি অ্যাসিস্ট করতে পারবি আমায় ‘চোখের বালি‘তে?
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৬: লিরিক নিয়ে ভয়ংকর বাতিক ছিল ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৫: জীবনের প্রথম চাকরি খোয়ানোর দিনটি দগদগে হয়ে রয়েছে
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৪: উত্তমের অন্ধকার দিকগুলো প্রকট হচ্ছিল আমাদের কাটাছেঁড়ায়
ঋইউনিয়ন পর্ব ১৩: সুপ্রিয়া-উত্তমের কন্যাসন্তান হলে নাম ভাবা হয়েছিল: ভ্রমর
ঋইউনিয়ন পর্ব ১২: ধর্মতলায় ঢিল ছুড়লে যে মানুষটার গায়ে লাগবে, সে-ই উত্তম ফ্যান
ঋইউনিয়ন পর্ব ১১: পার্ক স্ট্রিট ছিল আমার বিকেলের সান্ত্বনা, একলা হাঁটার রাজপথ
ঋইউনিয়ন পর্ব ১০: পরিচালক হলে খিস্তি দিতে হয় নাকি!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৯: সেই প্রথম কেউ আমায় ‘ডিরেক্টর’ বলল
ঋইউনিয়ন পর্ব ৮: শুটিং চলাকালীনই বিগড়ে বসলেন ঋতুদা!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৭: ঋতুদা আর মুনদির উত্তেজিত কথোপকথনে আমরা নিশ্চুপ গ্যালারি
ঋইউনিয়ন পর্ব ৬: মুনমুন সেনের নামটা শুনলেই ছ্যাঁকা খেতাম
ঋইউনিয়ন পর্ব ৫: আমার পেশার জায়গায় লেখা হল: পেশা পরিবর্তন
ঋইউনিয়ন পর্ব ৪: লাইট, ক্যামেরা, ফিকশন, সব জ্যান্ত হয়ে ওঠার মুহূর্তে ঋতুদার চিৎকার!
ঋইউনিয়ন পর্ব ৩: রবীন্দ্রনাথকে পার করলে দেখা মিলত ঋতুদার
ঋইউনিয়ন পর্ব ২: ‘চন্দ্রবিন্দু’র অ্যালবামের এরকম সব নাম কেন, জানতে চেয়েছিলেন ঋতুদা
ঋইউনিয়ন পর্ব ১: নজরুল মঞ্চের ভিড়ে কোথায় লুকিয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণ?