২০১৮ সালে তাঁর লেখার টেবিলটা পাল্টালেন ম্যাগি ও’ ফ্যারেল। অকশানে অমন সুন্দর একটা লেখার ডেস্ক পেয়ে যাবেন, ভাবতে পারেননি ম্যাগি। অন্তত ১৫০ বছরের পুরনো, যেন চালর্স ডিকেন্সের লেখার টেবিল। কিনে ফেললেন ম্যাগি। এই টেবিলে বসেই তিনি লিখছেন তাঁর ‘হ্যামনেট’ উপন্যাস। স্বয়ং উইলিয়াম শেক্সপিয়রের পুত্র ‘হ্যামনেট’ ১১ বছর বয়সেই বাবার কী কী গুণ পেতে পারে? এই প্রশ্ন মনে জাগতেই নতুন লেখার টেবিলটা যেন ভর করল তাঁর ওপর, মনে হল ম্যাগি ও’ ফ্যারেলের।
১৩.
উইলিয়াম শেক্সপিয়র প্রায়ই দুঃস্বপ্ন দেখেন। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। তিনি ধড়ফড় করে উঠে বসেন লন্ডনে তাঁর শোবার ঘরে। কখনও-কখনও লেখার টেবিলেও মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। তাঁর জন্মস্থান, স্ট্রাডফোর্ড-আপন-এভন্, অনেক দূরে। আর কারও জন্য মনকেমন নেই তাঁর। মনকেমন আর সব দুর্ভাবনা, তাঁর ১১ বছরের ছেলে হ্যামনেটের জন্য।
এত নাম থাকতে, তাঁর ছেলের নাম ‘হ্যামনেট’ কেন রাখলেন শেক্সপিয়র? ডেনমার্কের রাজার ছেলে ‘হ্যামনেট’-কে তিনি ভালবেসে ফেলেছেন। যাকে পান, রাজকুমার ‘হ্যামনেট’-এর গল্পটা তিনি বলেন, এক একবার এক এক ভাবে, নিত্য নতুন কল্পনার রং চড়িয়ে। তবে প্রতিবার গল্পটা শুরু করেন শেক্সপিয়র একইভাবে, একই ভাষায়:
“ওয়েল, ওয়ান্স দেয়ার ওয়াজ আ কিং অ্যান্ড হি হ্যাড আ সান অ্যান্ড দ্য সন্’স নেম ওয়াজ ‘হ্যামনেট’। এরপর গল্পটা একটু একটু বদলে যায়। ‘হ্যামনেট’ শেক্সপিয়রের কল্পনায় হয়ে ওঠে এক অসামান্য চরিত্র। সে দার্শনিক। সে কবি। জীবন নিয়ে সে গভীরভাবে ভাবে। প্রতিদিন সে নতুন করে অনুভব করে জীবনের গভীরতা, বেঁচে থাকার বিস্তার, যন্ত্রণা, নানাবিধ সংকট ও সংশয় এবং সে ক্রমাগত ভাবতে থাকে জীবন-মৃত্যুর কুহক প্রসঙ্গে।
হ্যামনেট এইভাবে রোজ নতুন আলোয় ও সম্ভাবনায় জন্মাতে লাগল শেক্সপিয়রের কল্পনায়। শেক্সপিয়র হ্যামনেটকে সযত্নে আগলে রাখেন কল্পনায়, বড় করেন কল্পনায়। এবং শেক্সপিয়র ভাবতেও পারেননি, হ্যামনেটকে ভালবাসবেন উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক ঔপন্যাসিক এবং শেক্সপিয়রের সেই ১১ বছরের ছেলেকে নিয়ে লিখে ফেলবেন ৩৭০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস। সেই উপন্যাসের নাম রাখবেন ‘হ্যামনেট’!
সেই উপন্যাস প্রকাশিত ২০২০ সালে। অর্থাৎ, ১৫৯৬-তে মাত্র ১১ বছর বয়সে হ্যামনেট-এর মৃত্যুর ৪২৪ বছর পরে! ‘হ্যামনেট’ উপন্যাসের লেখিকার নাম, ম্যাগি ও’ ফ্যারেল। তিনি তাঁর ‘হ্যামনেট’ উপন্যাসটি উৎসর্গ করেছেন উইলিয়াম শেক্সপিয়রকে। মাত্র দুটি অক্ষরে: ‘ফর উইল’। আমার এবারের ‘কাঠখোদাই’ দুটি লেখকের লেখার টেবিলে শুধু যাওয়া-আসা, শুধু স্রোতে ভাসা। একজন উইলিয়াম শেক্সপিয়র। অন্যজন একেবারে সমসময়ের ম্যাগি ও’ফ্যারেল (Maggie O’ Farrell)।
আমরা হঠাৎ মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমভাঙা শেক্সপিয়রের প্রসঙ্গ থেকে চলে এসেছিলাম ম্যাগি ও’ ফ্যারেলের ‘হ্যামনেট’ উপন্যাসে। আবার ফিরে যাচ্ছি শেক্সপিয়রের প্রসঙ্গে। ১৫৯৬ সালে লন্ডনে তাঁর লেখার টেবিলটি পাল্টালেন শেক্সপিয়র। নতুন টেবিলটা শেক্সপিয়র কিনেছেন একটা নিলাম থেকে। দেখতে ভারি সুন্দর। কিন্তু কিনে পর্যন্ত মনটা খুঁতখুঁত করছে। কেমন যেন খটকা, কিছুতেই যাচ্ছে না এই দুর্ভাবনা, কোনও অমঙ্গল ডেকে আনবে না তো এই লেখার টেবিল?
………………………………………………..
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমভাঙা শেক্সপিয়র তাঁর নতুন টেবিলটার পাশে বসেন। এবং টেবিলটার গায়ে ফুটে ওঠে ছবি। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান, ১৫৯৬-এর এক গ্রীষ্মের বিকেলবেলা স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন্-এভন-এ একটা ফাঁকা পোড়ো বাড়ির মধ্যে তাঁর ছেলে অসহায়ভাবে তাঁকে খুঁজছে। কিন্তু তিনি তো কত দূরে, লন্ডনে! ১১ বছরের ছোট্ট ছেলে ‘হ্যামনেট’ কী করে বুঝবে, লন্ডন থেকে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন্-এভন কত দূরের পথ!
………………………………………………..
কী আশ্চর্য, ২০১৮ সালে তাঁর লেখার টেবিলটা পাল্টালেন ম্যাগি ও’ ফ্যারেল। অকশানে অমন সুন্দর একটা লেখার ডেস্ক পেয়ে যাবেন, ভাবতে পারেননি ম্যাগি। অন্তত ১৫০ বছরের পুরনো, যেন চালর্স ডিকেন্সের লেখার টেবিল। কিনে ফেললেন ম্যাগি। এই টেবিলে বসেই তিনি লিখছেন তাঁর ‘হ্যামনেট’ উপন্যাস। স্বয়ং উইলিয়াম শেক্সপিয়রের পুত্র ‘হ্যামনেট’ ১১ বছর বয়সেই বাবার কী কী গুণ পেতে পারে? এই প্রশ্ন মনে জাগতেই নতুন লেখার টেবিলটা যেন ভর করল তাঁর ওপর, মনে হল ম্যাগি ও’ ফ্যারেলের। তিনি তরতর করে লিখে ফেললেন, “Hamnet’s mind is quick: he has the tendency to slip the bounds of the real, tangible world around him and enter another place.” ছেলেটার দেহটা একটা ঘরের মধ্যে থাকলেও সে কিন্তু মনে মনে অন্য জায়গায় চলে যেতে পারে, হয়ে উঠতে পারে অন্য মানুষ, এবং এমন এক স্থানে, যে-জায়গা সে-ই শুধু চেনে। অন্য কেউ চেনে না। অন্যরা অনেক ডাকাডাকি করলে সে ফিরে আসে, ‘he re-enters the world, when he glances around to find that he is back–’ এই তো তার বাড়ি, এই তো তার চেনা টেবিল, চারধারে চেনা মানুষ।
মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুমভাঙা শেক্সপিয়র তাঁর নতুন টেবিলটার পাশে বসেন। এবং টেবিলটার গায়ে ফুটে ওঠে ছবি। তিনি স্পষ্ট দেখতে পান, ১৫৯৬-এর এক গ্রীষ্মের বিকেলবেলা স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন্-এভন-এ একটা ফাঁকা পোড়ো বাড়ির মধ্যে তাঁর ছেলে অসহায়ভাবে তাঁকে খুঁজছে। কিন্তু তিনি তো কত দূরে, লন্ডনে! ১১ বছরের ছোট্ট ছেলে ‘হ্যামনেট’ কী করে বুঝবে, লন্ডন থেকে স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন্-এভন কত দূরের পথ! কিন্তু তার মা কোথায়? নিশ্চয় কাজে গেছে দূরে কোথাও? শেক্সপিয়রের ইচ্ছে করে ছেলের কাছে ছুটে যেতে।
আশ্চর্য ভাষা এবং ইঙ্গিতে ম্যাগি তাঁর উপন্যাসে ফুটিয়ে তুললেন শেক্সপিয়রের বালক-পুত্রের এই অসহায়তা এবং একাকিত্ব। ম্যাগির মনে হল, একটা ছবি যেন উঠে এল তাঁর লেখায় তাঁর নতুন-কেনা প্রাচীন টেবিলটার বুক থেকে: হ্যামনেট, ছোট্ট হ্যামনেট, একটা ফাঁকা বাড়িতে তার বাবাকে খুঁজতে খুঁজতে পড়ে গেল। মাথা কেটে রক্ত পড়ছে। ম্যাগি জানেন, বুঝতে পারেন, টেবিলটাই তৈরি করছে হ্যামনেটের রক্তঝরা এবং নিঃসঙ্গ অসহায় বেদনার সেই মুহূর্তের ছবি: “Hamnet is aware of streaks in his vision – red, orange, the colours of fire, streaming in from the corner of his eye – before he feels the pain. Tears burst forth from Hamnet’s eyes.”
শেক্সপিয়র তাঁর নতুন লেখার ডেস্কে। কালিতে কলম ডোবালেন। শব্দগুলো টেবিল থেকে উঠে এসে ঝরে পড়ল টেবিলের উপরে রাখা সাদা কাগজের ওপর:
I am dead:
Thou livest, …
draw thy breath in pain,
To tell my story.
হ্যামনেট নয়, হ্যামলেট, – হ্যামলেট নামেই ছেলে হ্যামনেট-কে অমর করে রেখে যেতে চান শেক্সপিয়র। মাত্র ১১ বছর যে ছেলে বাঁচল, সেই ছেলেকে কালজয়ী, মৃত্যুজয়ী করতে চান উইলিয়াম শেক্সপিয়র! কেন মারা গেল হ্যামনেট এত তাড়াতাড়ি? কী এমন অসুখ যা সারল না?
‘হ্যামনেট’ উপন্যাসের শেষে লিখছেন ম্যাগি ও ’ ফ্যারেল: ‘It is not known why Hamnet Shakespeare died: his burial is listed but not the Cause of his death.’
ব্ল্যাক ডেথ, রহস্যময় কালো মৃত্যু বা মহামারী যা শেক্সপিয়রের সময়ে সমাজ-সংসার আচ্ছন্ন করে দেখা দিত, তার একটিবারও উল্লেখ নেই শেক্সপিয়রের লেখায়, “The Black Death or ‘pestilence’ is not mentioned once by Shakespeare, in any of his plays or poetry! I have always wondered about this absence and its possible significance.” – এই অনুপস্থিতির তাৎপর্য নিয়ে আমি সব সময়ে ভেবেছি। এবং সেই ভাবনারই ফসল এই উপন্যাস।
আরও একটি অত্যন্ত দামি কথা জানিয়েছেন ম্যাগি: ‘Hamnet and Hamlet are in fact the same name, entirely interchangeable in Stratford records in the late sixteenth and early seventeenth centuries.’ তাই ‘হ্যামলেট’ নাটকে বালক পুত্র হ্যামনেট-কেই অমরত্ব দিয়ে গেছেন শেক্সপিয়র। এইটুকু মনে রাখলে আমরা বুঝতে পারব হয়তো এই চারটি পংক্তি লিখতে কী নিদারুণ বেদনা পেয়েছিলেন উইলিয়াম শেক্সপিয়র:
He is dead and gone, lady,
He is dead and gone:
At his head a grass-green turf,
at his heels a stone.
(Hamlet, Act IV, Scene V)
ম্যাগি ও’ ফ্যারেল মারাত্মক দুটি লাইনে মনে করিয়ে দিচ্ছেন:
The boy, Hamnet, died in 1596, aged eleven.
Four years or so later, the father wrote
a play called ‘Hamlet’.
…………………………………………..
ফলো করুন আমাদের ফেসবুক পেজ: রোববার ডিজিটাল
……………………………………………
‘হ্যামনেট’ উপন্যাসের গোড়াতেই ম্যাগি লিখছেন, হ্যামনেটের বাবা-মা কেউই জানেন না, হ্যামনেট আর এক সপ্তাহর বেশি বাঁচবে না। উইলিয়াম শেক্সপিয়র শুধু জানেন, তাঁর পুত্র ‘হ্যামনেট’ ‘হ্যামলেট’ নামে বেঁচে থাকবে অনন্তকাল। তার কোনও মরণ নেই। অন্তত ততদিন, যতদিন ইংরেজি ভাষা বেঁচে থাকবে বিশ্বজুড়ে! যতদিন হ্যামলেট নিয়ে যেতে পারবে আমাদের অস্তিত্ববাদের এই সারাৎসারে, এই গোড়ার কথায়: To be or not to be, that is the question!
এমন একটি পংক্তি লিখে শেক্সপিয়র কৃতজ্ঞবোধ করেন তাঁর টেবিলটির প্রতি। তাঁর মনের খটকা কেটে যায়। তিনি জানেন, এই উচ্চারণ মরবে না কোনওদিন। অনন্তে ভাসবে।
…………………….. পড়ুন কাঠখোদাই-এর অন্যান্য পর্ব ……………………
পর্ব ১২: রবীন্দ্রনাথের লেখার টেবিল চিনতে চায় না তাঁর আঁকার টেবিলকে
পর্ব ১১: আর কোনও কাঠের টেবিলের গায়ে ফুটে উঠেছে কি এমন মৃত্যুর ছবি?
পর্ব ১০: অন্ধ বিনোদবিহারীর জীবনে টেবিলের দান অন্ধকারের নতুন রূপ ও বন্ধুত্ব
পর্ব ৯: বুড়ো টেবিল কিয়ের্কেগার্দকে দিয়েছিল নারীর মন জয়ের চাবিকাঠি
পর্ব ৮: অন্ধকারই হয়ে উঠলো মিল্টনের লেখার টেবিল
পর্ব ৭: কুন্দেরার টেবিলে বসে কুন্দেরাকে চিঠি
পর্ব ৬: মানব-মানবীর যৌন সম্পর্কের দাগ লেগে রয়েছে কুন্দেরার লেখার টেবিলে
পর্ব ৫: বিয়ের ও আত্মহত্যার চিঠি– রবীন্দ্রনাথকে যা দান করেছিল লেখার টেবিল
পর্ব ৪: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের টেবিল আর তারাপদ রায়ের খাট, দুই-ই ছিল থইথই বইভরা
পর্ব ৩: টেবিলের গায়ে খোদাই-করা এক মৃত্যুহীন প্রেমের কবিতা
পর্ব ২: লেখার টেবিল ভয় দেখিয়েছিল টি এস এলিয়টকে
পর্ব ১: একটি দুর্গ ও অনেক দিনের পুরনো নির্জন এক টেবিল